দুর্বল নেতৃত্ব দিয়ে যে একটি বড় দল পরিচালনা করা যায় না ইতিহাসে তার উদাহরণ হয়ে থাকবে বিএনপি। বিএনপি নেতৃত্ব কতটা অধঃপতিত তার অন্তিম প্রমাণ ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নানা ঢাক গুরগুরের পর এই দলের পাঁচ সংসদ সদস্যের চারজনের সংসদে শপথ নেয়া। সবচেয়ে করুণদশা লক্ষ করা গিয়েছিল শেষ চার বিএনপি সদস্য শপথ নেয়ার পর বিএনপি মহাসচিবের আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিষ্প্রাণ করুণ বয়ান। বিএনপি নেতা ও বিএনপির মিত্রদের পূর্বাপর বক্তব্য শুনলে মনে হবে হতাশার অতলান্তে ডুবে যাচ্ছে দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি দল।
বিএনপি দলটির রাজনৈতিক অবস্থান কখনও সুখকর ছিল না। তবে ২০০৬ থেকে যে অবক্ষয় শুরু হয়েছিল তারপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বিএনপির সৌভাগ্য দেশজুড়ে এই দলের অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মী-সমর্থক আছে। আর দুর্ভাগ্য জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এমন দলের নেতৃত্বের দুর্বলতা দিনে দিনে প্রকট হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে কিছুটা ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু দূরদর্শিতার অভাব ও চারপাশে সুবিধাবাদীদের বলয় তাকে শক্ত ভিত্তি দেয়নি। প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবিধা পেয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু নিজপরিবার ও চারপাশ দুর্নীতির চর্চা ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল দলটিকে। দিনে দিনে বিএনপি নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকট হচ্ছিল।
সেসময় রাজনীতিসচেতন মানুষ সাধারণ অঙ্ক বিচারেই বলছিল নিকট অতীত থেকে দুর্বল হয়ে যাওয়া বিএনপি- যার অদূর ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা ফিকে হয়ে যাচ্ছে সেই দলের প্রতীকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ নেয়া থেকে বিরত রাখা যাবে না। প্রথম যখন ধানের শীষে পাস করা জাহিদুর রহমান দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে শপথ নিলেন তখন বিএনপির কঠিন প্রতিক্রিয়া অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি। এই শপথের আগেই অনেকেরই ধারণা ছিল দলের যা অবস্থা তাতে মির্জা ফখরুল ইসলাম ছাড়া সবাই হয়ত শপথ নেবেন। তাই বিএনপি নেতাদের বলা উচিত ছিল যে ‘আমাদের নির্বাচিত সদস্যরা শপথ নেবে কি না তা সময়েই বোঝা যাবে।’ কিন্তু একজিটের কোনো পথ তখন রাখেননি নেতারা।
এত যে ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ নামে জেনে বুঝে মিথ্যাচার করেন আমাদের রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা আর ধরা পড়লে বলেন ‘কৌশল’- এ ক্ষেত্রে তাও প্রয়োগ করেননি। আসলে নেতৃত্ব স্বদেশ-প্রবাসে নানা জায়গায় থাকলে চিন্তার সমন্বয় হবে কেমন করে! আবার কোন নেতা দলের প্রয়োজনে, আর কোন নেতা ব্যক্তি বা পরিবারের প্রয়োজনে নীতিনির্ধারণ করেন তাও বোঝার বিষয় রয়েছে। আসলে বিএনপির রাজনীতি এতটা লেজেগোবরে হয়ে গিয়েছিল যে নেতারা নীতিনির্ধারণী কথাও সকাল বিকাল পাল্টে যাচ্ছিলেন। এমন অস্থিরতা এখনও কাটেনি। এতে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী-সমর্থকদের হতাশা যে দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে সে খোঁজ কি বিএনপি নেতারা ভাবছেন?
গত নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি যে ঐক্যফ্রন্ট করা হয় তাও এক সময় তৈরি করেছিল অস্বস্তি। বিএনপির সে সময়ের বন্ধু ঐক্যফ্রন্টভুক্ত কোনো কোনো নেতার নির্বাচনকালীন বক্তব্য শুনে মনে হতো যেন বিএনপির চেয়েও বড় বিএনপি হয়ে গেছেন তারা। পরে বিএনপির নির্বাচিত এমপিদের শপথ নেয়া এবং তাতে দলীয় সমর্থনের ঘোষণা দেয়ায় তারা যুগপৎ হতাশা ও ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করছিলেন।
দলীয় পরিপ্রেক্ষিত ও আচার ব্যবহারে যে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বন্ধুত্ব মানায় সেখানে গণফোরাম বা নাগরিক ঐক্যের বন্ধুত্ব টেকে কেমন করে! যেখানে বিএনপি নেতাদের তাবৎ সিদ্ধান্ত লন্ডনি নেতার এক ধমকে বাতিল হয়ে যায় সেখানে শ্রদ্ধেয় ড. কামাল হোসেন আর মাহমুদুর রহমান মান্নাদের মতো প্রতিশ্রুতিশীল নেতাদের সম্মান থাকে কোথায়! এমন আশঙ্কা থেকে নির্বাচনের আগেই আমরা এই সম্মানিত নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখেছিলাম। কিন্তু অভাজনদের কথা কে শোনে!
সে পর্বে গণফোরাম নেতাদের দুঃখের কথা বলার জায়গা ছিল না। নিজদলের নির্বাচিত দুজন সংসদ সদস্য শপথ গ্রহণ করায় বিএনপির চাপে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হলো অথচ বিএনপি শেষ ভূমিকা কী রাখল? প্রথম বিএনপির এমপি জাহিদুর রহমান শপথ গ্রহণের সময় লন্ডনি সিদ্ধান্ত অন্য ছিল। তাই বেচারাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে তাকে ‘গণদুশমন’ বলে আখ্যায়িত করেন। যখন দেখলেন বাকি চারজনকে আর আটকে রাখা যাচ্ছে না, বরং দলে বিদ্রোহ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বাড়বে- এর বাইরে সরকারের সঙ্গে কোনো আঁতাতও হতে পারে তখনই লন্ডনি হুকুম চলে এল।
তাই তড়িঘড়ি আজ্ঞাবহরা ঐক্যফ্রন্টের বন্ধুদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করেই বিদ্রোহীদের বুকে তুলে নিলেন। মুহূর্তে গণদুশমনের তকমা কপাল থেকে সরিয়ে বিজয়ী বীরের মুকুট পরিয়ে দিলেন। আর যথারীতি এক লহমায় সব হয়ে গিয়েছিল ‘রাজনৈতিক কৌশল’। মাঝখান থেকে হারাধনের শেষ ছেলে হয়ে আম-ছালা দুটোই হারিয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব। সকলকে কৌতুকের আনন্দ দিয়ে বলেছিলেন, এটাও একটি রাজনৈতিক কৌশল।
বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব নতুন নয়। ২০০৬-এর সময়টাকে স্মৃতি থেকে যদি সামনে আনি তবে দেখব ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কতই না কূটকৌশল করেছিল বিএনপি ও তার চারদলীয় জোট। সিইসি চিারপতি জনাব আজিজকে দিয়ে ভুয়া ভোটার তালিকার রেকর্ড করেছিল। নিজদলীয় রাষ্ট্রপতিকে একাধারে তত্ত্ববধায়ক সরকারের প্রধান বানিয়েছিল। সেসময়ের জ্বালানি উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে নির্বাচনি গোপন ছক কাটতে গিয়ে সব ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। যা সে সমসয় উত্তরা কাণ্ড নামে পরিচিত ছিল।
কোনো দেশপ্রেমিক রাজনীতিক দল ও দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দেশকে ভয়ংকর অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে না। বিএনপি-জামায়াত জোট তাই করেছিল। স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনে যাওয়ার সাহস তারা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছিল। তাই এ সময়ের মতোই বিপর্যস্ত দশা আমরা দেখতে পেয়েছিলাম বিএনপির মধ্যে।
২০০৭-এ বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে সবচেয়ে বেশি দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল বিএনপি। অল্প কয়েক দিনেই দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলটির ইমেজ নামতে নামতে তলানিতে এসে ঠেকে। নেতা-নেত্রীদের এত দিনকার মাঠকাঁপানো বক্তৃতা তখন চরম মিথ্যাচার ছিল বলে মানুষের কাছে প্রতীয়মান হয়।
দেশটি বার বার দুর্নীতিগ্রস্ততার বিচারে বিশ্বসেরা হওয়ার কলঙ্ক গায়ে মেখেছিল প্রধানত কাদের জন্য তা আর কাউকে বলে বোঝাতে হয়নি। বাঘা বাঘা বিএনপি নেতারা সব দুর্নীতির দায়ে একে একে অন্তরীণ হচ্ছিলেন জেলে। দুদিন আগেও ধরাকে সরা জ্ঞান করতে অভ্যস্ত বেগম খালেদা জিয়াকে সেসময় একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রায় ‘অনুচর সহচর’শূন্য অবস্থায় পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করতে দেখে বড় মায়া হয়েছিল।
এ সময় স্বাভাবিকভাবেই বিভ্রান্তি পেয়ে বসে খালেদা জিয়ার মধ্যে। পরিবারতন্ত্রের ছককে ভুলতে পারলেন না তিনি। ত্রিশঙ্কু অবস্থায় দাঁড়িয়ে একে একে ভুল করতে থাকলেন। কনিষ্ঠ ভ্রাতা সাঈদ এস্কান্দারকে বানিয়ে দিলেন দলের সহসভাপতি। আর গ্রেপ্তার হওয়ার আগমুহূর্তে মান্নান ভূঁইয়াসহ কজন সিনিয়র নেতাকে বহিষ্কার করে মূলত নিজহাতে দলকে বিভক্ত করে দিলেন।
নরম মাটিতে পাইলিং ছাড়া তর তর করে বেড়ে উঠেছিল বিএনপির প্রাসাদ। নিয়মের আবর্তেই সামান্য ভূমিকম্পে ধসে পড়ার কথা এ প্রাসাদটির। তারই আলামত তখন দ্বিধাবিভক্ত বিএনপি নেতাদের হতাশার ভেতর স্পষ্ট হয়েছিল। আওয়ামী লীগ যখন ঘর গুছিয়ে নির্বাচনি প্রস্তুতিতে মনোযোগী তখন সংস্কারবাদী পক্ষ ও অসংস্কারবাদী পক্ষের বিএনপি নেতারা ব্যস্ত ছিলেন ঘরোয়া ঝগড়ায়। কারা আসল আর কারা নকল বিএনপি তা নিয়ে চলছে রশি টানাটানি। উভয় দলের কমন নেতা জিয়াউর রহমানের মাজারে মারামারি করে বিএনপি নামের জাহাজের ডুবন্ত অবস্থা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তখন।
এরপর থেকে বিএনপি নেতৃত্ব আর সবল অবস্থানে দাঁড়াতে পারেনি। আসলে দীর্ঘকাল ধরে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বাইরে সারা দেশে আর কেউ বিএনপির নেতা হয়ে উঠতে পারেননি। দণ্ডিত আসামি তারেক রহমান যখন লন্ডনে পাড়ি জমালেন তখনও বিএনপি-অন্তপ্রাণ অনেক কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে তারেক রহমানের নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে যায়নি।
ধীরে ধীরে যখন এই বিএনপি নেতার অর্থপাচার প্রকাশ্য হতে থাকে এবং লন্ডনে বিশাল বাড়ি নিয়ে বছরের পর বছর শানশওকতে কালাতিপাতের কথা প্রকাশ পেতে থাকে তখনই মোহ কাটতে থাকে অনেক বিএনপি সমর্থকের। দেশের ভেতর বেগম জিয়া দলের হাল ভালোভাবেই ধরে রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে এঁটে উঠতে হলে যে বিকল্প রাজনীতির প্রয়োজন তেমন মেধা জোগান দেয়ার সক্ষমতা বিএনপি নেতাদের মধ্যে দেখা যায়নি।
‘আপসহীন’ খেতাব দিয়ে দিনে দিনে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল বেগম জিয়াকে। তাই ২০১৪ নির্বাচনের সময় যথেষ্ট সুযোগ থাকার পরও কোনো কৌশলই গ্রহণ করেনি বিএনপি। এর বদলে স্থূল সিদ্ধান্তে বিএনপি-জামায়াত জোট সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে গণেশ উল্টে দিতে চেয়েছিলেন।
বিএনপির শেষ দুর্দশা শুরু হয় এখান থেকে। এসময় থেকে লন্ডনি নেতৃত্ব ও অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব একে একে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে থাকে। অপরদিকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল বেগম জিয়াকে একটি অদৃশ্য বেষ্টনীর ভেতর আটকে ফেলে। এতকালের দুই নেতানেত্রীর দল থাকায় এই ক্রান্তিকালে সাধারণ বিএনপি কর্মী-সমর্থকদের সামনে আর কেউ নেতা হয়ে উঠতে পারেননি।
ফলে যখন দল গুছিয়ে সংগঠিত করে মাঠের রাজনীতি তপ্ত করে ফেলার কথা তখন চার দেয়ালের ভেতর বসে হুংকার দিতে থাকেন বিএনপির এসকল নিষ্প্রভ নেতা। কোনো কোনো নেতা নিরলসভাবে প্রতিদিন লিখিত বিবৃতি পাঠ কারার মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা শেষ করেন। প্রতিপক্ষ এই দুর্বলতার সুযোগ পুরোটাই গ্রহণ করে। তাই আওয়ামী লীগের জালের বেষ্টনীতে আটকে যেতে থাকে বিএনপির সব দুর্বল প্রয়াস।
এরই শেষ নাটক মঞ্চস্থ হয় গত নির্বাচনের পর। ‘অবৈধ নির্বাচন আর অবৈধ সংসদ’ বলতে বলতে তখন সেই সংসদেই পাঠাতে বাধ্য হয় নিজদলীয় এমপিদের। শপথ না নিয়ে আসন হারান বিএনপি মহাসচিব। বাইরে দাঁড়িয়ে এই সংসদকে কি আর অবৈধ বলার তেমন মনের জোর পাবেন! তবে সাধারণ মানুষ যতই বিরক্ত হোক গলার জোর ঠিকই রয়ে গেছে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কণ্ঠে।
বাস্তবতা বিবেচনায় ঘুরে দাঁড়াতে হলে বিএনপি নেতৃত্বের প্রয়োজন আত্মসমালোচনা। বিএনপি নেতৃত্ব নিজ প্রেক্ষাপট থেকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে যৌক্তিক রাজনীতির পথে হাঁটলে তা দলের জন্য এবং দেশের জন্যই উপকার হবে। পাশাপাশি আমরা বলব এই সব দৃষ্টান্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের জন্যও উপকারে লাগতে পারে। এই দলটির নেতৃত্ব যদি হামবড়া ভাব থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের ভুলগুলো এ বেলা শুধরে না নেয় তবে মনে রাখতে হবে গণমানুষের মন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার নানা উপাদান কিন্তু কালো ভান্ডারে প্রতিদিন জমা হচ্ছে।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়