বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পুরুষ বনাম নারী চিত্রনাট্যকার

  • তাবাসসুম ইসলাম   
  • ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ২২:১০

বেচডেল টেস্টের জরিপ দেখতে গেলেই বোঝা যায়, নারীরা নারীর চরিত্র ভালো লেখেন, যথার্থভাবে পর্দায় তুলে ধরেন। বেশিরভাগ পুরুষ নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার এতে ব্যর্থ। তবে কি এখন নারীরাই শুধু নারীদের চরিত্র লিখবেন?

সামনে মেডিটেরেনিয়ান সাগর। নীল জলরাশি। চারপাশে নানা দেশের, নানা বয়সী মানুষ। ছানাপোনারা দৌড়ে বেড়াচ্ছে, বালির প্রাসাদ গড়ছে-ভাঙছে-গড়ছে। কোথাও চলছে বিচ ভলিবল, কোথাও সানগ্লাস চোখে স্রেফ বসে থাকা। জলের কাছে ফেরার উৎসব। রোদ পোহানোর উৎসব। এমন আনন্দযজ্ঞে বসে কবিতা লিখতে পারলে বেশ হতো। কিন্তু ভাবনায় ফেলে দিলো ছোট্ট দুই ভাইবোন, জেরেমি আর জেসেমি। এরা বেশ অনেকক্ষণ আমার কাছাকাছি বসেই খেলছে। কী খেলছে, কী করছে তেমন খেয়াল করে দেখিও নি। সমস্ত মনোযোগ নিয়ে ঘুরে তাকালাম আসলে একটা মাত্র কথা শুনে। ‘চিকো সালভারা আ চিকা’। ‘বয় সেভস দ্য গার্ল’। ‘ছেলেরাই মেয়েদেরকে উদ্ধার করে’।

দুই ভাইবোনের ঝগড়া তখন তুঙ্গে। জেসেমি ছোট বোন। তার এক দফা, এক দাবি: তার পুতুলকে উদ্ধার অভিযানে যেতে দিতে হবে। কেন? কারণ দুইবার তার পুতুল বালির প্রাসাদে বন্দী ছিল, বড় ভাই জেরেমির পুতুল তাকে উদ্ধার করেছে। আর দশ বছর বয়সী জেরেমির সহজ, স্বাভাবিক (!) উত্তর, ‘ছেলেরাই মেয়েদেরকে উদ্ধার করে।’ ভেবে দেখলাম, জেরেমির উত্তরের পক্ষে রেফারেন্সও আছে অনেক। আমাদের রাজপুত্র থেকে শুরু করে জেমস বন্ডরা যুগ যুগ ধরে রাজকন্যা এবং বন্ডগার্লদের উদ্ধার করে আসছে। জেরেমির হাতে ধরা স্পাইডারম্যানের অ্যাকশন ফিগার। সে বেচারাকে আমি নিজেই ২০০২ থেকে নায়িকা উদ্ধারে নিয়োজিত দেখছি, জেরেমির আর কী দোষ!

‘উদ্ধারের অপেক্ষায় থাকা’ এই নারী চরিত্রের প্রয়োজন কেন? কারণ এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় পুরুষের বীরত্ব, তার ভালোমানুষি। অর্থাৎ নারী চরিত্রের উপস্থিতি শুধুমাত্র পুরুষ চরিত্রটির গল্প বলবার জন্যই। ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় নারী মানেই সে নায়কের প্রেমিকা, স্ত্রী, মা, বোন বা স্রেফ ‘সাইড কিক’। নায়কের সাথে নারীর সম্পর্ক, নায়কের চোখে নারীর যে রূপ তা-ই সেসব চরিত্রের একমাত্র পরিচায়ক। আবার প্রায়ই গল্পে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা না থাকার পরও ভীষণ সুন্দরী নায়িকারা পর্দায় আসেন। হাইহিল আর ঝাঁ-চকচকে পোশাকের নায়িকারা যখন হেঁটে যান, ক্যামেরা তার পা থেকে প্যান করে কপাল পর্যন্ত উঠে যায়। এই পরিবেশনা কতটা বাস্তব বা রুচিসম্মত সেই আলোচনা করা হয় না, কেননা পর্দার ‘অর্নামেন্টেশনের’ জন্য আকর্ষণীয় নায়িকার উপস্থিতি প্রয়োজন।

এই প্রথার বিশ্লেষণে পঞ্চাশের দশকের নির্মাতা বাড বয়েট্টিচার বলে গিয়েছেন, ‘পর্দায় নারীর উপস্থিতি প্রয়োজন, কেননা তারাই পুরুষ চরিত্রটির মধ্যে প্রেম, যৌন অনুভূতি বা ভয় জাগাবে। পর্দার সেই নারী চরিত্রটির জন্য নায়ক যা অনুভব করে, সেটিই তো দর্শক অনুভব করবে।’

আরও পরে ১৯৭৫ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও গবেষক লরা মালভিও লিখলেন সিনেমায় ‘মেল গেজ’-এর প্রাবল্যের কথা। মালভির মতে, মেল গেজ বা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পর্দায় নারীদেরকে ‘সেক্সুয়াল অবজেক্ট’ হিসেবে তুলে ধরে। নারীকে ‘সেক্স সিম্বল’ হিসেবে দেখতে গিয়ে এই মেল গেইজ তাকে আর ‘চরিত্র’ হিসেবে দেখতে পায় না। ফলে সৌন্দর্য, যৌন আবেদনময়তার বাইরে তার চরিত্রের আর কোনো দিকই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না।

বিষয়টিকে আরও সহজ করে বুঝিয়ে বলেছেন প্রযোজক ও পরিচালক ড্যানিয়েল পালাডিনো। পালাডিনো বললেন, ‘আপনার সিনেমার কোনো দৃশ্যে আপনি একটি চেয়ার ব্যবহার করলেন। এর কারণ হতে পারে দুটো। এক, অভিনেতারা সেটি বসতে, হেলান দিতে বা ছুড়ে ফেলতে ব্যবহার করবে। দুই, অভিনেতারা সেটি ছুঁয়েও দেখবে না। তবে সুন্দর একটি চেয়ারের ব্যবহারের কারণে হয়তো দৃশ্যটি সুন্দর লাগবে। পর্দায় নারীর উপস্থিতি আর চেয়ারের উপস্থিতিতে কোনো পার্থ্যক্য নেই। কেননা পর্দায় নারী মানেই অনুষঙ্গ বা অলংকার।’

কিন্তু এর কারণ কী? ইতিহাস বলে, আমাদের চারপাশের মতো নাট্যজগত, সিনেমাজগত, মিডিয়াও বরাবরই পুরুষতান্ত্রিক। মিডিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের তুলনায় অনেক কম। তাই যুগের পর যুগ আমরা পর্দায় যে নারীদের দেখি, তারা মূলত পুরুষের চোখে দেখা, পুরুষের লেখায় ফুটে ওঠা, পুরুষ দর্শকের জন্য তৈরি নারী চরিত্র। সোজা কথায়, এরা পুরুষ যা দেখতে চায়, সে কথা ভেবে তৈরি নারী চরিত্র। এখানে নারীর বাস্তবতা নেই, নারীর নিজস্ব গল্প নেই। ঠিক যেমনটা পালাডিনো বলেছিলেন, এই নারী চরিত্রদের ব্যাপ্তি ও গভীরতা ততটুকুই। এরা অনুষঙ্গ অথবা অলংকার অথবা দুটোই।

তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, লেখক, চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, নির্দেশক পুরুষ না নারী, এ বিবেচনা কেন আলোচনায় আসবে? আসত না, আসার কথাও না। সমতায় বিশ্বাসী কোনো মানুষই সিনেমা দেখবার আগে, নাটক দেখবার আগে, বিজ্ঞাপন দেখবার আগে ভেবে দেখবেন না এটি নারী নির্মাতার তৈরি নাকি পুরুষ নির্মাতার। কিন্তু এ কথাও সত্যি যে, নারীরা যখন নারী চরিত্র সৃষ্টি করেন, তারা পুরুষের নির্মিত নারী চরিত্রের তুলনায় অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়ে ওঠেন। ঠিক শুনেছেন, আমি বলছি, বেশিরভাগ পুরুষ চিত্রনাট্যকার ও নির্মাতাই নারী চরিত্রের প্রতি সুবিচার করতে পারেন না (চানও না)।

তাই বেলার মতো চরিত্র সৃষ্টি করার জন্য ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর একজন লিন্ডা উলভারটনকে প্রয়োজন হয়। লিন্ডা যখন বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট (১৯৯১) এর চিত্রনাট্য লেখেন, বেলা তখন সিন্ডারেলা বা স্নো হোয়াইটের মতো ‘ড্যামসেল ইন ডিস্ট্রেস’ হয়ে যায় না, স্লিপিং বিউটির মতো রাজপুত্রের অপেক্ষায় জীবন কাটানোই তার একমাত্র কাজ হয় না। বেলা বই পড়ে, বেলার নিজস্ব ভাবনার জগতটা আমাদের সামনে আসে। রাজপুত্রের সাথে রোম্যান্টিক সম্পর্কই তার চরিত্রের একমাত্র দিক না। বেলা বাবাকে ভালোবাসে, বাবাকে রক্ষা করতে চায়। বেলা নিজের সুরে বন্ধুদের সাথে গান গায়, গল্প করে; সেই গান বা গল্পের মূল উদ্দেশ্য রাজপুত্রের সন্ধান করা নয়। মোট কথা, বেলা স্রেফ নায়িকা না, একটি পূর্ণাঙ্গ চরিত্র। নায়কের পার্শ্ববর্তী ‘সুন্দর অলংকার’ হওয়া ছাড়াও তার কিছু বলার ছিল।

এখানে বলতেই হয় যে, বেলার স্রষ্টা লিন্ডা উলভারটন ছিলেন অ্যানিমেটেড সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা প্রথম নারী। অথচ লিন্ডা চিত্রনাট্য লেখার আরো ষাট বছর আগে থেকে যাত্রা শুরু করেছে ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্স, লিন্ডার বিউটি আন্ড দ্য বিস্ট-এর আগে আরও ১৭৮টি সিনেমা ডিজনি থেকেই প্রযোজিত হয়েছে। তার কোনোটিতেই বেলার মতো নারী চরিত্রের দেখা মেলে না। তারা রাজপুত্রের অপেক্ষায় থাকা সুন্দরী রাজকন্যা হয়েই রয়ে যান।

শুধু ডিজনি কেন, এবার মূলধারার হলিউডে ফিরি। হলিউডে ‘বেচডেল টেস্ট’ নামে ভারী মজার এক পরীক্ষা বেশ জনপ্রিয়। ফিকশনে নারী কীভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে তাই নিয়ে এক কমিক স্ট্রিপ আঁকতে গিয়ে আশির দশকে এই টেস্টের উদ্ভাবন করেন কার্টুনিস্ট অ্যালিসন বেচডেল। নারীকে পুরুষের অনুষঙ্গ নয়, বরং স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে দেখানো হচ্ছে কিনা, তা যাচাই করতে ফিকশনকে তিনটি সহজ শর্ত পূরণ করতে হবে।

এক, ফিকশনে অন্তত দুটি নারী চরিত্র থাকতে হবে।

দুই, এই নারী চরিত্রগুলোর মাঝে কথোপকথনের অন্তত একটি দৃশ্য থাকতে হবে ।

তিন, এই কথোপকথনের বিষয়বস্তু হতে হবে পুরুষ চরিত্রটি ছাড়া অন্য কোনো কিছু।

চলচ্চিত্র গবেষক ম্যাট ড্যানিয়েলসের নেতৃত্বে এই বেচডেল টেস্টের আওতায় আনা হয় ১৯৯৫-২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সবচেয়ে ব্যবসা সফল ২০০টি হলিউডি চলচ্চিত্রকে। ফলাফল প্রকাশিত হয় তিন ধাপে। এক, যে চলচ্চিত্রগুলোর চিত্রনাট্য লেখার টিমে কোনো নারী ছিলেন না, সেগুলোর মধ্যে ৪৭ শতাংশ এই বেচডেল টেস্টে সফল। দুই, যে চলচ্চিত্রগুলোর চিত্রনাট্য লেখার টিমে অন্তত একজন নারী ছিলেন, সেগুলোর মধ্যে ৬২ শতাংশ বেচডেল টেস্ট উতরে যায়। তিন, যে চলচ্চিত্রগুলোর চিত্রনাট্য লেখার টিমে শুধুমাত্র নারীরাই ছিলেন, তার সবগুলো অর্থাৎ ১০০ শতাংশ বেচডেল টেস্টে সফল। ম্যাট ড্যানিয়েলসের এই পরীক্ষাটি একটি সহজ বিষয় স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে। পুরুষদের নিয়ে চিন্তাভাবনা বা কথা বলা ছাড়াও যে নারীদের জগতে অন্য কিছু থাকতে পারে, এই অতি স্বাভাবিক বিষয়টিও হলিউডের বেশিরভাগ পুরুষ চিত্রনাট্যকার বুঝতে চান না বা পারেন না।

বলিউডও ব্যতিক্রম নয়। সেখানে একজন মেঘনা গুলজার যখন সিনেমায় সারোগেসির গল্প বলেন, সৃষ্টি হয় ফিলহাল (২০০২)। সন্তান ধারণ নিয়ে গল্প বলতে এসেও মেঘনা নারী চরিত্রদের স্রেফ মাতৃত্বের তাড়নায় ভুগতে থাকা লিঙ্গ হিসেবে রেখে দেননি। তাদের নিজস্ব গল্প আছে, বন্ধুত্বের বন্ধন আছে, মাতৃত্বের হাহাকারের বাইরেও তাদের অন্যান্য অনুভূতি আছে। এই সারোগেসিকে যখন পুরুষ নির্মাতার চোখ দিয়ে দেখা হয়, তৈরি হয় হার দিল জো পেয়ার কারেগা (২০০০), চোরি চোরি চুপকে (২০০১)। দুটি সিনেমাতেই নারী চরিত্রের ব্যাপ্তি প্রেমিকা, স্ত্রী, পুত্রবধূ এবং মা হয়ে ওঠা পর্যন্তই। বংশ রক্ষা ও নায়কের প্রতি প্রবল প্রেমের চার দেয়ালে তারা এমনভাবে বন্দী যে তাদের আর কোনো স্বপ্ন নেই, অনুভূতি নেই, গল্পও নেই। যদি গল্প থেকেও থাকে, সেটিও যৌন আবেদনময়তার মোড়কে এমন করে মুড়িয়ে দেয়া যে সূক্ষ্ম সব অনুভূতি সেখান থেকে দৌড়ে পালায়। অথচ জুহি চতুর্বেদীর লেখা ভিকি ডোনার (২০১২) দেখে অবাক হয়ে যাই। প্রায় সমপর্যায়ের সংবেদনশীল বিষয় স্পার্ম ডোনেশন নিয়ে নির্মিত এই সিনেমায় নায়ক বা নায়িকা কেউই অনর্থক যৌন আবেদনময় হয়ে উঠছে না। নায়ককেন্দ্রিক কমার্শিয়াল সিনেমা বলে জুহির গল্পে নারীরা স্ত্রী, প্রেমিকা, মা, দাদী হিসেবে থেকে যান না। ভিকির সত্তোর্ধ্ব বিজিকেও (দাদী) আমাদের মনে রাখতে হয়। কেননা, হিন্দি-পাঞ্জাবির মিশেলে কথা বলতে থাকা আধুনিক বিজিরও নিজস্ব একটা গল্প আছে। আর সেই গল্প শুধু নায়কের সাথে তার সম্পর্কের সংজ্ঞায় শেষ হয়ে যায় না।

প্রবাসী গৃহবধূরা কী করেন? কেমন জীবন তাদের? সেই গল্প দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে (১৯৯৫)তে চাইলে খানিকটা আদিত্য চোপড়াও বলতে পারতেন। বলেননি। অমন মা ও গৃহবধূদের গল্পটা শুনতে তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে গৌরি শিন্দের ইংলিশ ভিংলিশ (২০১২) এর জন্য। প্রাপ্তবয়স্কা অবিবাহিত নারীরা কেমন হয়? সারাক্ষণ বিয়ের জন্য পাগল হয়ে থাকেন? কারান জোহরের মিসেস ব্র্যাগেনজার মতো কর্মক্ষেত্রেও তারা যৌন অনুভূতি ছাড়া তেমন কিছু ভাবতে পারেন না? অবিবাহিত, যৌন আবেদনসম্পন্ন নারী মানেই কি অপ্রকৃতিস্থ কমিক রিলিফ? এই প্রশ্নের সংবেদনশীল উত্তর পেতেও আমাদের অপেক্ষা করতে হয় কামনা চন্দ্র ও তনুজা চন্দ্রের কারিব কারিব সিঙ্গেল, জুহি চতুর্বেদীর পিকুর জন্য। কারিব কারিব সিঙ্গেল-এর জায়া প্রেম করতে চায় বলে বোধবুদ্ধি খোয়ায়নি! বলিউডের জন্য সে কী অবাক করা কথা!

জুহির পিকুও সিনেমার নায়িকা বটে, তবে তার তেমন কোনো নায়ক নেই। প্রেমের সম্পর্ক বা সংসার তার চরিত্রের মূল দিক না। বরং বৃদ্ধ বাবার সাথে তার সম্পর্কের গল্পই এই সিনেমার মূল উপজীব্য। পিকুকে আমরা নায়িকা না, নিজস্ব গল্প এবং মতামত সম্বলিত পূর্ণাঙ্গ চরিত্র হিসেবে দেখি। তাকে অফিস যেতে হয়, ঘর সামলাতে হয়, বাবার খেয়াল রাখতে হয় বলে যে সে প্রেম করতে চায় না তা-ও না। পিকুর সেক্সুয়াল নিডকে জুহি আড়ালে সরিয়ে রাখেননি, আবার সেক্সুয়াল নিড আছে বলেই বলিউডের চিরাচরিত নারী চরিত্রগুলোর মতো তাকে সেক্স সিম্বল হিসেবে তৈরি করেননি।

ইদানিং বলিউডে দেশকে বাচাঁনোর, সমাজকে বাঁচানোর সিনেমার জয়জয়কার। সেখানে নারী চরিত্ররা কী ভূমিকা রাখেন? তারা সাধারণত অক্ষয় কুমার, সালমান খান বা অজয় দেবগনের পাশে তাদের ‘লাভ ইন্টারেস্ট’ হয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেন। অক্ষয় কুমার যখন পর্দায় স্যানিটেশন নিয়ে বিপ্লব করছেন, নায়িকা ভূমি পেডেঙ্কারের আবদার করা ছাড়া কোনো ভূমিকা থাকে না। অক্ষয় কুমার যখন পর্দায় স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে সচেতনতা বাড়াচ্ছেন, মেয়েদের জন্য করা এই বিপ্লবেও রাধিকা আপ্তে শুধুমাত্র স্ত্রী ও সোনম কাপুর শুধুমাত্র ‘দ্য আদার ওম্যান’। এমনকি ভারতের মঙ্গলগ্রহ অভিযানে নারীদের অবদান নিয়ে নির্মিত মিশন মংগল-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র কে জানেন? অক্ষয় কুমার! চার-চার জন গুণী অভিনেত্রীর উপস্থিতি সত্ত্বেও পুরুষের জন্য, পুরুষের দ্বারা নির্মিত এই সিনেমায় দিনশেষে ‘হিরো’ হয়ে ওঠেন একজন আলফা মেলই!

অথচ মেঘনা গুলজার যখন রাজি (২০১৮) নির্মাণ করছেন, নারী চরিত্রটি স্বচ্ছন্দে ‘হিরো’ হয়ে উঠছে। সে জন্য তাকে সিনেমার পুরুষ চরিত্র নির্মাণে অবহেলা করতে হয়নি, তাদের দুর্বল পুরুষ হিসেবে দেখাতে হয়নি। আলিয়া ভাট কেন্দ্রীয় চরিত্র বলে ভিকি কৌশলের চরিত্রটির কোনো গল্প নেই, সে ‘স্বামী’ মাত্র - এমন তো হয়নি! তবে রোহিত শেঠির সিম্বা (২০১৮) তে কেন সারা আলী খানের মুখে আমরা ডায়ালগের চেয়ে বেশি গান শুনি? কারণ বেশিরভাগ পুরুষ চিত্রনাট্যকার ও নির্মাতারা নারী চরিত্র লিখতে জানেন না!

লেখা শুরু করেছিলাম জেরেমি আর জেসেমির গল্প দিয়ে। তাদের কাছেই ফেরত যাই। জেরেমির পৃথিবীতে স্বাভাবিক সত্য হচ্ছে ছেলেরাই মেয়েদেরকে রক্ষা করবে। আমি কি তবে এর উল্টোটা চাইছি? রাজকন্যারা রাজপুত্রদের ঘুম ভাঙবে? ওয়ান্ডার ওম্যানরূপী গ্যাল গাডোটরা সুপার হিরো হবে? হতেই পারে। হোক, তাতে জেসেমিদের পক্ষেও রেফারেন্স পাওয়া যায়।

তবে রক্ষাকর্ত্রী হয়ে ওঠা নিয়ে আসলে এই আলোচনা না। সিনেমা নারীকেন্দ্রিক হলেই সেখানে নারীর উপস্থাপন যথার্থ হবে তাও না। হলিউড এখনও ভাবছে নারীকেন্দ্রিক সিনেমা মানে পুরুষালি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, যুদ্ধংদেহী এক নারী। ‘ইয়াং লেডি’ ডাকায় ক্যাপ্টেন মার্ভেলকে তাই চোখমুখ শক্ত করে হুমকি দিতে হয়। হলিউডের পুরুষ নির্মাতারা যেন ধরেই নিয়েছেন নারীর শক্তির প্রথম পরিচায়ক হলো ‘নারীত্ব’কে ছুঁড়ে ফেলা!

বলিউড ভাবছে নারীর যথার্থ উপস্থাপন মানে তাকে দেবীজ্ঞান করতে হবে। তাকে মা দুর্গা হতে হবে, অথবা অন্তত স্বরস্বতী! অথচ নারীকে রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে দেখতে শিখলেই বিরোধ মিটে যায়। নারীকে আলাদা করে নারী না, মানুষ হিসেবে দেখেছেন বলে অ্যামি শারমান-পালাডিনো দ্য মার্ভেলাস মিসেস মেইজেল লিখতে পারেন, জোয়া আখতার গালি বয় লিখতে পারেন, অপর্ণা সেন পারমিতার একদিন লিখতে পারেন। সেখানে লিঙ্গাত্মক বিরোধ থাকে না, কেউ কারো ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায় না।

দাবি করেছিলাম, বেশিরভাগ পুরুষ নির্মাতা, চিত্রনাট্যকাররা নারী চরিত্র নির্মাণ করতে জানেন না। উল্টো উদাহরণ টানার আগেই বলে নিচ্ছি, ব্যতিক্রম উদাহরণও আছে। তাই ফারাহ খানের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় দুর্দান্ত পুরুষতান্ত্রিক ম্যায় হু না বা ওম শান্তি ওম নির্মিত হয়। হলিউডের দীর্ঘদিনের চর্চিত নীতি ‘ক্যারিয়ারিস্ট নারী মানেই অনুভূতিহীন, রুঢ়, অসুখী নারীর’ স্টেরিওটাইপ মেনে নিয়ে অ্যালিন ব্রশ ম্যাকেনাও লেখেন ডেভিল উইয়ারস প্রাডা। আবার ঝলমলে, উচ্ছ্বসিত যে নায়িকারা নায়কের জীবন পালটে দেন, তাদেরও যে নিজস্ব যুদ্ধ থাকে, সেই গল্পটা পর্দায় প্রথম বলেছেন পরিচালক মাইকেল গন্ড্রি। রোজা ডিয়াজ, অ্যামি স্যান্টিয়াগো, জিনার মতো দুর্দান্ত, বাস্তবিক নারী চরিত্রগুলো পর্দায় এসেছে নির্মাতা ড্যান গুর আর মাইকেল স্কারের হাত ধরে। আরতি, অদিতি বা দয়াময়ী তো সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টি। আমি যখন জুহি চতুর্ভেদীর পিকু বা ভিকি ডোনার-এর কথা বলছি, তখন এও তো বলতে হয় যে দুটো সিনেমারই নির্মাতা সুজিত সরকার।

কিন্তু ব্যতিক্রমের দোহাই দিলে আর চলছে না। বেচডেল টেস্টের জরিপ দেখতে গেলেই বোঝা যায়, নারীরা নারীর চরিত্র ভালো লেখেন, যথার্থভাবে পর্দায় তুলে ধরেন। বেশিরভাগ পুরুষ নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার এতে ব্যর্থ। তবে কি এখন নারীরাই শুধু নারীদের চরিত্র লিখবেন? অ্যামি শারমান প্যালাডিনো ২০১১ সালের এক সাক্ষাতকারে সেই উত্তর দিয়ে রেখেছেন, ‘যা জানেন না বা বোঝেন না, তা নিয়ে লিখতে হলে রিসার্চ করে লিখুন।’

তাবাসসুম ইসলাম: পোস্টগ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অফ বার্সেলোনা

এ বিভাগের আরো খবর