বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ওটিটি সংস্কৃতি নিয়ে কিছু কথা

  • অনিমেষ আইচ   
  • ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৯:২৭

নীহাররঞ্জন গুপ্ত কিংবা আর্থার কোনান ডয়েলের রহস্য-রোমাঞ্চ অপ্রতিরোধ্য ছিল, কিন্তু তাদের পাশাপাশি রবিঠাকুর কিংবা মিলান কুন্ডেরা তো অপ্রয়োজনীয় ছিলেন না নিশ্চয়ই? সব  ধারার  শিল্প সৃষ্টি হওয়া অতি আবশ্যকীয়। আমরা যেন শুধু ক্রাইম থ্রিলারের বৃত্তে আটকে না থাকি। শিল্প হোক উন্মুক্ত, খোলা জানালার মতো।

সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি আধুনিক গান, আধুনিক চলচ্চিত্র আর আধুনিক সমাজব্যবস্থার কথা। আধুনিকতার শেষ আসলে কোথায়? তা আমি যেমন জানি না, তেমন আপনারাও। এখন এই মুহূর্তে আমরা যে শিল্পচর্চার ধরন নিয়ে কথা বলছি, তাকেই মনে করছি আধুনিক এবং সর্বশ্রেষ্ঠ। আর যা কিছু পুরাতন, সবকিছুই সেকেলে আর অচলমাত্র। ওটিটির ক্ষেত্রেও কি তাই? নাকি ওটিটি কনসেপ্ট আত্মার মতোই অদৃশ্য এক আধ্যাত্মিক অনুভূতির নাম?

পরিষ্কার মনে আছে, নব্বইয়ের দশকের কথা। আমরা তখন থাকতাম সেন্ট্রাল রোডে। বাড়ির উল্টো দিকে ‘ভিডিও নিডস’ নামের একটি ভিডিও ক্লাব ছিল। সেখানে আড্ডা মারত আমাদের পাড়ার যুবক বড় ভাইয়েরা। বড় ভাইদের স্নেহ ছিল আমাদের প্রতি, তাই যখন-তখন ভিডিও ক্লাবে ঢুকতাম আর বের হতাম। কৈশোরের বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম সেলফে সাজিয়ে রাখা ভিডিও ক্যাসেটগুলোর দিকে, তাকিয়ে থাকতাম ভিডিও ক্লাবের দেয়ালে লাগিয়ে রাখা ছোট ছোট সিনেমার পোস্টারে দিকে।

একটি ভিএইচএস ক্যাসেট ভাড়া নিতে হলে দশটি টাকা গুনতে হতো, সুতরাং একটি ক্যাসেট ভাড়া করার আগে দশবার ভাবতে হতো। এতগুলো টাকা খরচা করে ভুল-ভাল বিনোদন কিনছি না তো? হয়তো অনেক সময় দেখা যেত, একটি সিনেমা এনে অতি দ্রুত ফাস্ট ফরওয়ার্ড করে সিনেমা রহস্যময়তা এক ঝলকে দেখে নিয়ে ফেরত দিতে যেতাম সেই ভিডিও ক্লাবে। ক্যাসেট বদলে নিয়ে আসতাম আরেকটি। এভাবেই কি আমরা ভিডিও অন ডিমান্ড প্রথা রদ করেছিলাম!

তারপর পদ্মা, মেঘনায় অনেক জল বয়ে গেছে, নদীবক্ষে কনক্রিটের সেতু বদলে দিয়েছে নদীর গতিপথ। তেমনি করে আমাদের জীবনযাপনেও একে একে সংযুক্ত হয়েছে বিবর্ণ আধুনিকতা। আমরা শত শত টেলিভিশন চ্যানেলের হাতছানিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছি ওটিটি নামক (সো-কলড) সর্বোচ্চ আধুনিকতার দিকে।

তারপর আমরা বিবেচনা করতে বসি কোনটা বেশি ভালো ছিল? কোনটা সর্বাধুনিক?

কিছুকাল এই জগৎ দেখার পর যে অন্ধ হয়েছে, আর যিনি জন্মান্ধ– তাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক। জন্মান্ধ যেটা করে, তা হলো তারা শব্দের উৎস থেকে একটি দেখার জগৎ তৈরি করে। আর পরে যিনি অন্ধ হয়েছেন, তিনি দেখা জগৎকে রিকানেক্ট করার চেষ্টা করেন মাত্র। সিনেমা/টেলিভিশনের দর্শকরা ছিলেন জন্মান্ধ সুতরাং তাদের যা কিছু দেখানো হয়েছে তাকেই তারা ধ্রুব বলে মনে করেছেন আর ওটিটি দর্শকরা টিভি/সিনেমাকে (অডিও-ভিজ্যুয়াল) রিকানেক্ট করার চেষ্টা করছেন মাত্র, তা কেবল তাদের সুবিধাজনক সময়ে।

ওটিটি একটি সময়ের দাবি ছাড়া আর কিছুই নয়, হয়তো অতি অচিরেই এই অগ্রযাত্রাকে অতি পুরাতন বলে মনে হবে আমাদের। ‘ওভার দ্য টপ’– এই কনসেপ্টের শুরুর গল্পটা অনেকটা এসেছে নেটফ্লিক্সের হাত ধরে। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে একটা সময় ছিল, যখন নেটফ্লিক্স সিডি-ডিভিডি এসব কিছু ভাড়া দেয়ার একটি বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান ছিল। তাদের সঙ্গে আরও অনেকগুলো কোম্পানি এই সিডি/ডিভিডি রেন্টাল সার্ভিসে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাজারে টিকে ছিল। সে সময় নেটফ্লিক্স নিজেদের বিক্রি করে দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। কিন্তু তখনও অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো এর ভবিষ্যৎ দেখতে পায়নি। তাই তারা কেউ নেটফ্লিক্স কেনার সাহস করেনি।

পরবর্তীকালে যখন ইন্টারনেট উচ্চগতি পায় এবং বৈশ্বিক দর্শকদের সময় এবং রুচির পরিবর্তন হয়, তখন নেটফ্লিক্স একটি নিজস্ব ভিডিও লাইব্রেরি অর্থাৎ অরিজিনাল কনটেন্ট তৈরিতে মনোনিবেশ করে। ফলে ২০২২ সালে এসে নেটফ্লিক্সের অপ্রতিরোধ্য মনোভাব সত্যিই দেখার মতো বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

যা কিছু ব্যবসাসফল এবং জনপ্রিয় তার দিকে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়বে– এটাই স্বাভাবিক। ফলে বর্তমান বিশ্বে নেটফ্লিক্সের মতো করে শত শত ওটিটি কনটেন্ট প্রোভাইডার উৎপন্ন হতে থাকে এবং তারা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বৈশ্বিক দর্শকদের কনটেন্ট পরিবেশন করে যাচ্ছে। অবশ্যই এটা আমাদের সময়ের চাহিদাকে পূরণ করছে এবং আমরা আমাদের সুবিধামতো সময়ে উপভোগ করতে পারছি সিনেমা, অরিজিনাল শো এবং লাইভ কনটেন্ট।

একবার বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেই তারকোভস্কিকে তারই একজন ছাত্র জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কীভাবে একটি ভালো ছবি তৈরি করা যায়?’ আন্দ্রেই মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তো কাউকে শেখানো যায় না, অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। তবে তুমি যদি খুব ভালো ছাত্র হও, তাহলে অন্তত শিখতে পারো কী করে খারাপ ছবি না বানাতে হয়। সৃষ্টি করা বেঁচে থাকার মতোই একটা ব্যাপার। ভালোভাবে বেঁচে থাকা কাউকে শিখিয়ে দেয়া যায় না। হয়তো তাকে খারাপভাবে না বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়া যায় মাত্র।’

মহান দার্শনিক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা আন্দ্রেই তারকোভস্কি ভালো আর মন্দের তফাত বোঝাতে গিয়ে এই কথাগুলো বলেছিলেন। আমরা বেহুদাই ওটিটি কিংবা টেলিভিশনের যান্ত্রিক অবস্থানের তর্কে না জড়িয়ে বরং কথা বলতে আগ্রহী হই এর অন্তর্গত সৌন্দর্যের বিষয়ে। অর্থাৎ বর্তমানে কী কনটেন্ট বাজার খাচ্ছে অথবা গ্রাস করছে, সে বিষয়ে। অথবা ভালো ছবি হয়ে ওঠার চাইতেও কী করে খারাপ ছবি/কনটেন্টের ভূত ঘাড় থেকে নামানো যায়, সে বিষয়ে। ক্রাইম থ্রিলার, টুইস্টস অ্যান্ড টার্নস বর্তমান বাজারের সবচাইতে চলতি বিষয় এবং এটা অতি অবশ্যই আমাদের ওটিটি প্ল্যাটফর্মের একটি বিক্রয়যোগ্য কনটেন্ট।

গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমান বিশ্বের দর্শকরা এই থ্রিলার জনরার প্রেমে মজেছেন ভীষণভাবে। সুতরাং আমাদের দেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো এই হাতছানি থেকে দূরে থাকবে কেন? তারা ভীষণভাবে উৎসাহিত করছে এই ধারার কাজকে।

এখন আমার প্রশ্ন হলো, নীহাররঞ্জন গুপ্ত কিংবা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের রহস্য-রোমাঞ্চগুলো ছিল অপ্রতিরোধ্য, কিন্তু তাদের পাশাপাশি রবিঠাকুর কিংবা মিলান কুন্ডেরা তো অপ্রয়োজনীয় ছিলেন না নিশ্চয়ই? সব ধারার শিল্প সৃষ্টি হওয়া অতি আবশ্যকীয়। আমরা যেন শুধু ক্রাইম থ্রিলারের বৃত্তে আটকে না থাকি, শিল্প হোক উন্মুক্ত, খোলা জানালার মতো। ওটিটির আলমিরায় থরে থরে সাজানো থাক নানান স্বাদের খাবার, দর্শক কিংবা গ্রাহক তার পছন্দসই খাবারটি সেখান থেকে বেছে নিক তার আপন স্বাধীনতায়। তাহলেই নতুন এই মাধ্যমের জয় হবে।

উদাহরণ হিসেবে আমি বলতে চাই, আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে চরকি নামক যে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম যাত্রা শুরু করেছে, তাদের বেশ কিছু কনটেন্টের মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে শিবব্রত বর্মণের রচনায় এবং রবিউল আলম রবির পরিচালনায় উনলৌকিক নামক অ্যান্থলজি সিরিজটি। আবার ভালো লাগেনি এমন কনটেন্টেরও অভাব নেই এই প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু আমার পছন্দ-অপছন্দ দিয়ে সব দর্শকদের রুচি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর উচিত সব ধরনের দর্শকের কথা মাথায় রাখা। কারণ কোন জিনিস কখন কার মনে ধরবে, তা বোঝা মুশকিল।

কেবল পুঁজিবাদের সঙ্গে সমঝোতায় যেন কেটে না যায় শিল্পীর অপচয়ের জীবন। শিল্পীকে দিতে হবে পূর্ণ স্বাধীনতা, যেন সে তার কথাটা অকপটে বলতে পারে। ওটিটি হোক কিংবা টেলিভিশন, সব মাধ্যম কেবল বিনোদনের ভেতর দিয়ে সময়ের দর্শনকে প্রচার করে মাত্র। সুতরাং মাধ্যমের ত্রুটি না খুঁজে তার বিষয়গত সৌন্দর্যের দিকে আমাদের মনোযোগী হওয়া উচিত বেশি করে।

অনিমেষ আইচ: চলচ্চিত্র নির্মাতা

এ বিভাগের আরো খবর