সমসাময়িক পশ্চিমা সাহিত্যের ক্রাইম থ্রিলার জনরা এমন একটা গর্তে পড়েছে যে সেখান থেকে আর উঠতে পারছে না। সেটা বই বা উপন্যাসের ক্ষেত্রেই হোক, কি হোক টিভি সিরিজের ক্ষেত্রে। সেটারই ব্যবচ্ছেদ করার একটা উপলক্ষ তৈরি করে দিয়েছে নেটফ্লিক্সের নতুন বছরের একটি সিরিজ- দ্য উওম্যান ইন দ্য হাউজ অ্যাক্রস দ্য স্ট্রিট ফ্রম দ্য গার্ল ইন দ্য উইন্ডো।
বোঝাই যায়, এরকম উদ্ভট নাম আসলে সচেতনভাবে রাখা হয়েছে। সমসাময়িক ক্রাইম থ্রিলার বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার জনরাকে প্যারোডি করার উদ্দেশ্যেই এই নামকরণ। প্যারোডির ব্যাপারটা একটু স্পষ্ট করি- নামটার দিকে ভালো করে নজর দিলেই দেখা যায় নামটা আসলে দুইটা জনপ্রিয় সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার উপন্যাসের নামের ম্যাশআপ। এর একটি এ জে ফিনের ২০১৮ সালের দ্য উওম্যান ইন দ্য উইন্ডো এবং অপরটি পলা হকিন্সের ২০১৪ সালের দ্য গার্ল ইন দ্য ট্রেইন। এই দুই উপন্যাস ভালোই জনপ্রিয় হয়েছিল এবং দুটি উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমাও হয়েছে, প্রথমটা থেকে ২০২১ সালে ও পরেরটা থেকে ২০১৬ সালে।
এই জনরার সমসাময়িক কাহিনীগুলিতে যেসব ক্লিশে, একঘেয়ে ও বিরক্তিকর জিনিস দেখা যায়, সেগুলির প্রত্যেকটাকে ধরে ধরে ব্যঙ্গ করা হয়েছে এই সিরিজটাতে।
এই সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্র অ্যানা নামের এক উচ্চ মধ্যবিত্ত আমেরিকান নারী যে আবার ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে কথা বলে। সে ভিড় বা জনসমাগম খুব ভয় পায়। তার কাজ বা আয়ের উৎস কী সেটা পরিষ্কার না, কিন্তু সে থাকে শহরের বাইরে খুব বিলাসবহুল একটা বাড়িতে। অ্যানা তার একমাত্র মেয়েকে হারিয়েছে এবং সেই শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অতিরিক্ত মদ্যপানের মাধ্যমে সেই শোক ও একাকীত্বের যন্ত্রণা কাটানোর চেষ্টা করে সে আর খুব সন্দেহের চোখে প্রতিবেশীদের উপর নজর রাখে।
এরই মধ্যে খুব স্মার্ট ও আকর্ষণীয় এক লোক তার প্রতিবেশী হয়ে আসে। এই সব কিছুর মধ্যেই অ্যানার চোখের সামনে একটা খুনের ঘটনা ঘটে এবং সেই ঘটনা শুধুমাত্র সেই প্রত্যক্ষ করে। স্বাভাবিকভাবে মানুষজন কেউ অ্যানার কথা বিশ্বাস করে না। আনার একমাত্র এবং নিবেদিতপ্রাণ ‘বেস্টফ্রেন্ড’ এগিয়ে আসে তখন, তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়। অ্যানার প্রতিবেশীদের মধ্যে তাকে নিয়ে বিভিন্ন গুঞ্জন চলতে থাকে। হত্যারহস্য উদঘাটন করতে গোয়েন্দা পুলিশের জড়িত হওয়া, সফট-কোর যৌনদৃশ্য, ডার্ক ফ্ল্যাশব্যাক, বোকা বোকা টুইস্ট – সব মিলিয়ে এই জনরার সমসাময়িক কাহিনীগুলির এমন কোনো ক্লিশে নেই, যেটা এই সিরিজে বাদ পড়েছে। সম্ভবত এই সিরিজের ক্রিয়েটর বা নির্মাতারা বেশ হোমওয়ার্ক করে ক্লিশেগুলির একটা বড় চেকলিস্ট তৈরি করে নিয়েছিলেন।
এখন এই ক্রাইম থ্রিলার ও সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার জনরাতে, এই ক্লিশেগুলি কীভাবে তৈরি হয়েছে এবং পরবর্তীতে আস্তে আস্তে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং শেষ পর্যন্ত এসে একটা বিরক্তিকর কাঠামোতে পরিণত হয়েছে, সেটা দেখানোর জন্য আমি একটু পিছনের দিকে ফিরে যাব। আর কিছু উদাহারণ তুলে আনব।
আমরা সাহিত্যের যে নির্দিষ্ট জনরা নিয়ে কথা বলছি- সেই জনরাতে নর্ডিক থ্রিলার ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান থ্রিলার খুবই প্রসিদ্ধ, সমাদৃত ও জনপ্রিয়। এই জনরার ইংরেজি উপন্যাস ও সিরিজগুলিতেও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান থ্রিলারের সরাসরি প্রভাব দেখা যায়। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সিরিজগুলির ইংরেজি রিমেইকও হয় অনেক।
একটি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় আমেরিকান টিভি সিরিজ আছে ২০১১ সালের – দ্য কিলিং। সেই সিরিজে সারাহ লিন্ডেন নামের এক ডিটেকটিভ- যে কিনা সিংগেল মাদার, বিভিন্ন জটিল খুনের রহস্য সমাধান করতে থাকে। দ্য কিলিং সিরিজটি ছিল ২০০৭ সালের একই নামের একটি ড্যানিশ টিভি সিরিজের রিমেইক। ২০১৩ সালের দ্য ব্রিজ নামের একটি আমেরিকান টিভি সিরিজ আছে, যেটার কেন্দ্রীয় চরিত্র এক ধরনের মানসিক ডিজঅর্ডারে ভোগা এক নারী ডিটেকটিভ। দ্য ব্রিজ সিরিজটাও ছিল একই নামের একটা সুইডিশ সিরিজের রিমেইক। এরকম আরও অনেক নর্ডিক বা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান থ্রিলার সিরিজ পাওয়া যাবে, যেগুলির কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন নারী ডিটেকটিভ, যে আবার কোনো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বা অন্য কোনো সমস্যার মধ্যে আছে। পুরো কাহিনীতেই সে একইসাথে হত্যারহস্যের সমাধান ও নিজস্ব সমস্যা ডিল করার জন্য স্ট্রাগল করতে থাকে। যেমন মিডনাটসোল (২০১৬), কোলাটেরাল (২০১৮), ডেডউইন্ড (২০১৮), চেস্টনাট ম্যান (২০২১), আর্কটিক সার্কেল (২০১৮) সহ এরকম আরও বেশ কয়েকটি ছবি।
এমনকি বিবিসির তৈরি করা নিউজিল্যান্ডের খুব জনপ্রিয় সিরিজ টপ অব দ্য লেইক (২০১৩) ও আইরিশ লেখিকা টানা ফ্রেঞ্চের উপন্যাস থেকে তৈরি ডাবলিন মার্ডারসও (২০১৯) প্রায় একই ধরনের।
আমার আসলে এতকিছু বলার উদ্দেশ্য হলো ক্রাইম থ্রিলার জনরাতে একটা কমন ফরম্যাট তৈরি হয়েছে এবং আস্তে আস্তে সেটা ছড়িয়ে পড়েছে। ফরম্যাটটা এরকম: কেন্দ্রীয় চরিত্র হবে একজন নারী, যে কোনো না কোনো সমস্যা, বিশেষ করে সাইকোলজিক্যাল কোনো সমস্যায় জর্জরিত। সেই নারী কোনো পারিবারিক সমস্যার মধ্যেও থাকতে পারে বা সে হতে পারে ভীষণ অ্যালকোহল আসক্ত। এই ফরম্যাটের অসংখ্য উদাহারণের মধ্যে সর্বশেষ সফল উদাহারণ হল কেট উইন্সলেট অভিনীত এইচবিওর মেয়ার অব ইস্টটাউন (২০২১)।
এই দুই সিনেমার নামের প্যারোডি করে তৈরি করা হয়েছে নেটফ্লিক্সের নতুন সিরিজ
আমার হিসাবে, এই ফরম্যাটটাই কিছুটা বিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়ে থ্রিলার জনরার সাহিত্যে এসে একটা ভয়াবহ ক্লিশেতে পরিণত হয়েছে।
এখনকার সময়ের জনপ্রিয় আমেরিকান লেখিকা জিলিয়ান ফ্লিনের ২০০৬ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস শার্প অবজেক্ট-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ক্যামিলি প্রিকার ছিলেন অ্যালকোহল আসক্ত, পারিবারিক সমস্যার কারণে মারাত্মকভাবে মানসিক অবসাদগ্রস্ত একজন সাংবাদিক। এই ক্যামিলি প্রিকারই এক জটিল সিরিয়াল কিলিংয়ের রহস্য সমাধান করেন। ফ্লিনের পরবর্তী উপন্যাস ২০০৯-এ প্রকাশিত ডার্ক প্লেসেস-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র লিবি ডে-ও অনেকটা একই রকম – ট্রমাটাইজড একজন নারী। প্রথম উপন্যাসটি নিয়ে এইচবিও একটা সিরিজ করেছে এবং পরের উপন্যাসটা থেকে একটি সিনেমা তৈরি হয়েছে।
ফ্লিনের এই উপন্যাসগুলির উপাদান ও কাঠামো ব্যবহার করে পরবর্তী বছরগুলোতে বেশকিছু ক্রাইম থ্রিলার বা সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার উপন্যাস রচিত হয়। সেগুলোরই একটা হল ২০১৫ সালের পলা হকিন্সের লেখা দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেইন এবং ২০১৮ সালের এ জে ফিনের লেখা দ্য উওম্যান ইন দ্য উইন্ডো। এই উপন্যাস দুটি থ্রিলার বাজারে বেশ হাইপ তৈরি করে এবং পরবর্তীতে এগুলোর অনুকরণে আরও অনেক উপন্যাস আসে।
২০০৬ থেকে ২০১৯ – বিশেষ করে ২০১০ পরবর্তী সময়ে এই একই ফরম্যাটে বাজারে অনেক থ্রিলারই এসেছে, যেগুলো একটা থেকে আরেকটাকে আলাদা করা সম্ভব না। মনে হবে বিভিন্ন লেখক আসলে একই চরিত্র আর একই কাহিনীকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই লেখাই লিখছেন।
সম্ভবত এই ব্যাপারটাকে প্যারোডি ও মিমিক করার জন্যই তিনজন ক্রিয়েটর হিউ ডেভিডসন, ল্যারি ডর্ফ ও রাচেল রামরাস নেটফ্লিক্সের এই সিরিজটা তৈরি করেছেন অনেকটা ডার্ক কমেডির আদলে। এবং সেটা করতে গিয়ে ক্লিশে জিনিসগুলিকে এমনভাবে মিমিক করেছেন, প্রতিটা ক্লিশেকে এই কাহিনীতে এতো সিরিয়াসলি এনেছেন যে সহজেই মনে হতে পারে, তারা আসলে কোনো ব্যঙ্গ করেননি, বরং একটা মার্ডার মিস্ট্রি বা হত্যারহস্যের কাহিনিই তারা দেখাতে চেয়েছেন। কাহিনি এমনভাবে এগিয়েছে ও হত্যারহস্যের ব্যাপারটি এমনভাবে উন্মোচন হয়েছে, অনেক সময় মনে হতে পারে যেই জনরার ক্লিশেগুলোকে প্যারোডি করতে চেয়েছে এই সিরিজ, শেষপর্যন্ত তা সেই জনরারই আরেকটা জিনিসে পরিণত হয়েছে।
নিঃসঙ্গ, অবসাদগ্রস্ত, অ্যালকোহলিক নারী পশ্চিমা থ্রিলারের নতুন ক্লিশে
কাহিনিতে রিয়ালিটি ও ফ্যান্টাসির মধ্যকার টেনশন ধরে রাখা, কাহিনীর রোমান্টিক ও সেক্সুয়াল দিক, মূল রহস্য শেষপর্যন্ত টান টান রাখার চেষ্টা করা, টুইস্ট – ফরমুলা অনুযায়ী সব মিলিয়ে একটা সিরিয়াস মার্ডার মিস্ট্রি সিরিজের সবই আছে এখানে। মূল চরিত্র অ্যানার ইমোশোনাল ভূগোলও কাহিনিতে খুব ভালোভাবে ছড়িয়েছে। তবে কাহিনীর মেলোড্রামাটিক বর্ণনাভঙ্গি, সন্দেহজনক প্রতিবেশী, ভয়ংকর এক থেরাপিস্ট, হাস্যকর টুইস্ট এবং আট পর্বের প্রতি পর্বেই মোটাদাগে একটা হাসির ব্যাপার – সব মিলিয়ে এটাকে একটা সিলি, অ্যাবসার্ড জিনিস ও সত্যিকারের প্যারোডি বানানোর চেষ্টার ব্যাপারেও কোনো কমতি নেই।
এখন প্রশ্ন আসে, একটা প্যারোডির চরিত্রদের সাথে দর্শকদের কোনো ইমোশনাল কানেকশন কি তৈরি হওয়া সম্ভব? বা প্যারোডির কাহিনী-প্লটকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার কিছু আছে কি? দুটি প্রশ্নের উত্তরই এখানে ‘না’।
প্যারোডি করতে গিয়ে এখানে দুটি ব্যাপার ঘটেছে: রহস্য ধরে আগাতে গিয়ে মাঝপথে কমেডি চলে এসেছে এবং কমেডি করতে গিয়ে মাঝখানে রহস্য চলে এসেছে। কখনও কখনও এটাও মনে হয় যে, সিরিজটার কমেডিই এই যে এখানে নাম ছাড়া আসলে কোনো কমেডি নেই।
কমেডি এখানে কাজ না করার আরেকটা উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, সিরিজের কাহিনীর একটা ডার্ক বা অন্ধকার দিক। আগেই বলেছি, এখানে দেখা যায় অ্যানার একমাত্র মেয়ে মারা গেছে এবং অ্যানা এখনও সেই শোকের মধ্যে আছে। মেয়ের মৃত্যুর পরে অ্যানার বিয়ে ভেঙে গেছে, আর্টিস্ট হিসাবে তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। প্রশ্ন হলো, অ্যানার মেয়ে কীভাবে মারা যায়? মেয়েটার বাবা ছিল ফরেনসিক সাইকোলজিস্ট এবং মেয়েটা তার বাবার সাথে জেলখানার ভিতরে গিয়েছিল। তখন এক সিরিয়াল কিলার মেয়েটাকে খুন করে খেয়ে ফেলে। বীভৎস, তাই না? এই বীভৎস এবং অস্বস্তির বিষয়টা সিরিজে বারবার ঘুরেফিরে আসতে থাকে অ্যানার কাজকর্মে। আনা অযথাই স্কুলের গেটে চলে যায়। সে তার বেডরুমে তার মৃত মেয়েকে খেলতে দেখে, তখন তাকে চুমু খেতে বলে এবং সেই মৃত মেয়ে অস্বীকার করে যে ‘আমি চুমু দিতে পারব না, কারণ আমি মৃত’। এইসব কারণে সিরিজে একটা ডার্ক আবহ তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত এটা আর কমেডি হয়ে উঠতে পারে না।
অবশ্য গতানুগতিক প্যারোডির মতো সরাসরি কমেডিতে গেলে সম্ভবত এই সিরিজটার উদ্দেশ্য পূরণ হত না। শেষপর্যন্ত এই সিরিজটা আসলে যা করতে চেয়েছে তা সে করতে পেরেছে- এই জনরার অ্যাবসার্ড, হাস্যকর ও ক্লিশে জিনিসগুলিকে উন্মোচিত করা এবং তা নিজেকে অ্যাবসার্ড বানানোর মধ্য দিয়ে হলেও। উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে সিরিজটাকে সফল বলা যায়। দর্শক বিচারেও হয়ত এটাকে সফল বলা যায়। কারণ, জানুয়ারির ২৮ তারিখে নেটফ্লিক্সে আসার পরে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও সিরিজটা এখনও নেটফ্লিক্সের চার্টে সবার উপরে আছে।
আশরাফুল আলম শাওন: লেখক, আইটি প্রফেশনাল