সুরজগতে নক্ষত্রপতন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। গানের কোকিল, গানে পাখি, সুর সম্রাজ্ঞী, কুইন অব মেলোডি, সুরের নাইটেঙ্গেল, সুরের সরস্বতী, সুরের ঈশ্বরী কত নামেই না তাকে ডাকা হয়েছে। কিন্তু কোনো নামেই যেন তার শিল্পীসত্তার প্রকৃত পরিচয়কে তুলে ধরা যায়নি। তার সংগীত ও সুরের কীর্তিকে কোনো বিশেষণ বা অভিধা দিয়েই তুলে ধরা যায় না।
লতা মঙ্গেশকর, যিনি সুরকে সংজ্ঞায় বেঁধে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সুরের মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রজন্মের পর প্রজন্মের আশা ও হতাশার কথা বলেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি সুরের আরাধনা করেছেন।
১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর একজন দক্ষ থিয়েটারের গায়ক ছিলেন। পাঁচ বছর বয়সে লতার বাবার কাছেই গান শেখার হাতেখড়ি। বোন আশা, ঊষা ও মীনাও তার কাছে শিখতেন। পড়াশোনা করেছেন প্রথমে আমিন আলি খান সাহেব এবং পরে অমানত খানের কাছে। লতা মঙ্গেশকর সব সময় প্রকৃতিপ্রদত্ত সুরেলা কণ্ঠস্বর, প্রাণবন্ত অভিব্যক্তি দ্রুত বোঝানোর অবিশ্বাস্য ক্ষমতার উদাহরণ রেখেছেন। এই কারণেই তার প্রতিভা খুব তাড়াতাড়ি স্বীকৃতি পায়। ১৯ বছর বয়সে ‘মজবুর’ চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেয়ার মাধ্যমে প্লেব্যাকে হাতেখড়ি হয় তার। ক্যারিয়ারে লতা মঙ্গেশকর ৩৬টি ভাষায় প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন। ১৯৭৪ সালে সবচেয়ে বেশি গানের শিল্পী হিসেবে গিনেস বুকে স্থান পান তিনি।
পদ্মভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ড, ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা, পদ্মবিভূষণ, এনটিআর জাতীয় পুরস্কার এবং ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ভারতরত্ন পেয়েছেন তিনি। এছাড়া ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘অফিসার দে লা দি’ অনারসহ দেশি-বিদেশি অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন এই কিংবদন্তি। যদিও শত কোটি মানুষকে যিনি গান দিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন, তার জন্যে পুরস্কার বা পদবি আসলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। মানুষের ভালোবাসা পাওয়াটাই আসল বিষয়। সুরের মায়াজাল সৃষ্টি করে তিনি কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।
আমাদের ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার পথে লতা মঙ্গেশকর ছিলেন এক স্বপ্নের রানি। ভালোলাগার, ভালোবাসার শিল্পী। যিনি গান দিয়ে সম্মোহিত করে রাখতেন, কণ্ঠের জাদুতে মোহিত করে রাখতেন। তার গান অভিব্যক্তি, তার সবকিছুই আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হতো। তিনি সুর ধরেছেন সূক্ষ্মতম বিন্দু থেকে। সঙ্গে নিখুঁত উচ্চারণ ও শব্দের সঙ্গে চমৎকার বোঝাপড়া। যেন এক পৃথিবী বেদনা পুরে রেখেছেন ‘তেরে বিনা জিন্দেগি’তে। অনুভবের জোরে দুটো পঙ্ক্তির খেলায় মাত করেছেন— ‘আজ ফির জীনে কি তমন্না হ্যায়, আজ ফির মরনে কা ইরাদা হ্যায়।’
কিশোর কুমার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে সংগীত বানিয়ে নিতেন। লতা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন সংগীতে। অতৃপ্ত শৈশব, অপূর্ণ সম্পর্ক, অভিযোগ, কুৎসা— কিছুই তাকে সাধনাভ্রষ্ট করেনি। যে লক্ষ্যে স্থির না থেকে ঝরে গিয়েছেন গীতা দত্ত। সুরসম্রাজ্ঞী জীবনের বিষপান করে তুলে এনেছেন সুরের অমৃতকলস, তাই ছড়িয়ে গিয়েছেন আট দশক। প্রায় এক শতাব্দী ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীতভক্তদের সুরের মায়াজালে বেঁধে রেখেছিলেন।
লতার মৃত্যুতে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা প্রায় একই অনুভূতি ও ভাষায় শোক প্রকাশ করেছেন। কারণ তার সুর ও সংগীত এ উপমহাদেশের মানুষের মনে একই রকম আবেশ ও অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল। সীমান্তের কাঁটাতার অতিক্রম করে যা পৌঁছে গিয়েছে অগণিত মানুষের মর্মমূলে।
‘প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে’ গানটি ছিল তার গাওয়া প্রথম বাংলা গান। তিনি দুশরও অধিক বাংলা গান গেয়েছেন। এর বেশিরভাগই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে। বাংলা গান গাওয়ার জন্য তিনি অনেক পরিশ্রম করেছেন, বাংলা উচ্চারণ শিখেছেন। এ ব্যাপারে তাকে সর্বোতভাবে সাহায্য করেছেন আরেক কিংবদন্তি শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
এক বিস্ময়কর প্রতিভা ছিলেন লতাজি। ১৫ বছর বয়সে যে কণ্ঠস্বর ছিল, ৮০ কিংবা ৯০ বছর বয়সেও সেই একই কণ্ঠস্বর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বরেরও পরিবর্তন হয়। কিন্তু লতাজি ব্যতিক্রম। তার কণ্ঠস্বর চিরকাল একই রকম থেকে গেছে। অল্প বয়সি লতাজির কণ্ঠে ব্যথা-বেদনা, ভালোবাসা-অনুরাগ যেভাবে খেলা করেছে, পরিণত বয়সেও ঠিক একই রকম শুনিয়েছে সেগুলো। পার্থক্য বোঝা যায়নি কখনও। বিরল এক ক্ষমতার অধিকারী লতা মঙ্গেশকর।
দীর্ঘ ৯০ বছরে অনেকে লতা হতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি। এক্ষেত্রে নূরজাহান, গীতা দত্ত, সুমন কল্যাণপুর প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। লতার সঙ্গে তুলনা প্রসঙ্গে নূরজাহান বলেছিলেন, ‘লতা তো লতা হ্যায়’ তার সঙ্গে আমার তুলনা চলে না। সুমন কল্যাণপুরের গলার সঙ্গে লতার গলার খুব সামান্য তারতম্য ছিল। এই সামান্য তারতম্যের কারণে সুমন কিংবদন্তি হতে পারেননি। লতার গানের তুলনা লতা নিজেই।
আশা ভোঁশলেও কম যাননি। কিন্তু লতা হতে পারেননি। আশা নিজেই তার বড় বোন সম্পর্কে বলছেন, ‘দিদি আমার থেকে ৪ বছরের বড় হলেও গানে আমার থেকে ১০০ বছরের বড়।’ বলিউডের সংগীত জগতে লতা একটি অবিস্মরণীয় নাম। তার গানের সাম্রাজ্যের আজও কোনো দ্বিতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হয়নি।
আসলে লতা মঙ্গেশকর পৃথিবীতে একজনই। সব ক্ষেত্রেই তিনি অনন্য অসাধারণ। তার শৃঙ্খলাবোধ, পেশার প্রতি ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা, নিষ্ঠা ছিল প্রবাদতুল্য। তার স্বদেশপ্রেম যেমন ছিল অসাধারণ, মানবতার প্রতি মমত্ব ও শ্রদ্ধাবোধও ছিল অপরিসীম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি আমাদের অকুণ্ঠ সহযোগিতা করেছেন। এ ব্যাপারে কলকাতার বিশিষ্ট শিক্ষিকা এবং সমাজসেবী মৃন্ময়ী বোসের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করা যেতে পারে।
বোম্বাইয়ের (মুম্বাই) কামবালা হিলস, ডোর বেলটা চেপেই দুরুদুরু বুকে বন্ধ দরজার সামনে অপেক্ষা করতে লাগলেন মৃন্ময়ী বোস। বন্ধ দরজাটা জগদ্বিখ্যাত সংগীতশিল্পী, কুইন অব মেলোডি খ্যাত লতা মঙ্গেশকরের বাড়ির। সাক্ষাতের এপয়েনমেন্ট সলিল চৌধুরীর মাধ্যমে আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। তারপরও নার্ভাস বোধ করছেন। ব্যক্তিগত চেনাজানা ছাড়া এত বড় মানুষের কাছে আবদার নিয়ে আসা, তাও আবার সুদূর কলকাতা থেকে বোম্বাই। প্রত্যুত্তরে কেমন আচরণ পাবেন সেই দুঃশ্চিন্তা ঘিরে আছে তাকে।
দরজা খুললেন লতা মঙ্গেশকর স্বয়ং। মুখে সেই চিরপরিচিত মিষ্টি হাসি। রিনিঝিনি কিন্নর কন্ঠে শুধালেন, ‘ভালো আছো? কেন এসেছো?’ “আমরা বাংলাদেশের জন্য ফান্ড কালেক্ট করছি। শরণার্থী এবং আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা হবে এই ফান্ড থেকে। আপনারও সাহায্য চাই দিদি।”
মৃন্ময়ীকে বসিয়ে রেখে ভেতরে চলে গেলেন লতা মঙ্গেশকর। বেরিয়ে আসলেন চেক বই হাতে। গুটিগুটি হাতে চেক লিখে এগিয়ে ধরলেন। অংকের ঘরে চোখ পড়তে কিছুটা চমকেই উঠলেন মৃন্ময়ী বোস। এক লাখ রুপি! ১৯৭১ সালে এক লাখ রুপি মানে কম টাকা ছিল না।
কিন্তু আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছে মৃন্ময়ী বোসের জন্য। নিজের গাওয়া কিছু বিখ্যাত গানের রয়্যালিটি লতা মঙ্গেশকর সেদিন লিখে দিয়েছিলেন ফান্ডের নামে। যতদিন মুক্তিযুদ্ধ চলবে ততদিন এসব গান থেকে প্রাপ্ত অর্থ জমা হবে ফান্ডে। বাংলাদেশের ফান্ডে।
এখানেও শেষ নয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপনেও অর্থ সাহায্য করেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে অজন্তা শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্লেনে চেপে বিভিন্ন স্থানে গান পরিবেশন করে বাঙালি রিফিউজিদের জন্য তহবিলও সংগ্রহ করেছিলেন এই কিংবদন্তি। পাশাপাশি গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা।
২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর টুইটারে লতা মঙ্গেশকর ১৯৭১ সালে অজন্তা শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে তার বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বিখ্যাত অভিনেতা সুনীল দত্তের গ্রুপের সঙ্গে এসেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘নমস্কার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হতেই আমি সুনীল দত্তের গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশ গিয়ে অনেক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলাম। সে সময়ে সেনাবাহিনীর উড়োজাহাজে করে সব জায়গায় গিয়েছিলাম।’
লতাজি শুধু সফল এক জীবনমাত্র নয়। বরং তিনি জীবনভর অনেককে জীবন দিয়ে গিয়েছেন। তার দুরন্ত প্রতিভা দিয়ে কোটি কোটি মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে গিয়েছেন। আমাদের কাছে জীবন সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে আসার পরে অন্যের মুখে হাসি ফোটানো, আনন্দবেদনার অবলম্বন হওয়া- এটাই তো সবচেয়ে অপূর্ব! লতাজি সেই কাজটাই করে গিয়েছেন জীবনভর।
লতাজির চলে যাওয়া সত্যিই নক্ষত্রপতন। লতাজি এক স্তম্ভ, যে স্তম্ভের নিচে আমরা সবাই মাথা নত করি। পৃথিবীর সংগীত যতদিন থাকবে, লতা মঙ্গেশকর আমাদের মধ্যেও ততদিন থাকবেন।
লেখক: প্রবন্ধকার, সাবেক ছাত্রনেতা ও রম্য লেখক