বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

প্রকাশো হে প্রসন্ন মুখচ্ছবি

  • ড. কালিদাস ভক্ত   
  • ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৩:০১

সরস্বতী দেবীকে বলা হয়েছে ‘জাড্যাপহা’। জাড্য মানে জড়তা। এখানে জাড্য মানে মূর্খতা। অপহা মানে অপনাশকারিণী। সরস্বতী দেবী আমাদের মূর্খতা দূর করে আমাদের মন জ্ঞানের আলোকে আলোকিত করেন। সংস্কৃত সাহিত্যে সরস্বতীকে নিয়ে অনেক কাহিনি ও উপাখ্যান রয়েছে। নৈষধচরিত মহাকাব্যে দেখা যায় তিনি স্বয়ং ভীমরাজের রাজসভায় একজন প্রতিভাদীপ্ত উপস্থাপিকা। এমনি আরও অনেক উপাখ্যানে দেখা যায়, অনেক মূর্খ ব্যক্তিও সরস্বতীর কৃপা লাভ করে বিখ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিক-মহাকবি হয়েছেন। তাই আমরা বিদ্যার দেবীর শ্রীচরণে প্রার্থনা জানাচ্ছি- তিনি আমাদের অন্তরের ভিতরকার অজ্ঞান শক্তিকে বিনাশ করে শুভ শক্তির উদ্বোধন করুন।

মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীর পুণ্য তিথি শ্বেতশুভ্র কল্যাণময়ী বিদ্যাদেবীর অর্চনার আরাধ্য দিন। পলাশ, কুন্দ, গাঁদা প্রভৃতি নানা ফুলের মনোরম শোভায় প্রকৃতি এক নতুন সাজে সজ্জিত হয়। ঘণ্টা কাঁসর আর শঙ্খনিনাদে মুখরিত হয় দেশের পূজা মণ্ডপগুলো। ঊষালগ্ন থেকেই আনন্দালোকে-মঙ্গলালোকে উদ্ভাসিত ধূপ-ধুনোর গন্ধে মাতোয়ারা ধরণীতে বেজে ওঠে শান্তির মোহনীয় সুর। ব্রহ্মমুহূর্তে, আবাহন সম্পন্ন হয় দেবীর, শঙ্খে শঙ্খে মহিমাময় সুরে। সদ্য প্রস্ফুটিত পলাশ ও কুন্দ, গাঁদাসহ শীতকালীন নানা ফুল দিয়ে হয় মায়ের পূজা। হংস সমভিব্যাহারে দেবী আসছেন।

আমরা রোমাঞ্চিত হৃদয়ে শ্রদ্ধা ভক্তির পুষ্পাঞ্জলি নিয়ে তার শ্রীচরণ দর্শনের প্রত্যাশায় অপেক্ষমাণ। তাকে কেন্দ্র করে আমাদের অন্তরে অপরিমেয় আনন্দ-অনুভূতি উদ্ভাস ছড়িয়ে পড়ে। তার সেই আগমনী বার্তা নিনাদিত হচ্ছে অনলে অনিলে সলিলে নভোনীলে। তার আবির্ভাবের ইতিহাস বৈদিক যুগ থেকেই।

বেদে যেসব দেবতার কথা বলা হয়েছে তাকে বৈদিক দেবতা বলে। যেমন- অগ্নি, ইন্দ্র, মিত্র, রুদ্র, বরুণ, বায়ু, সোম প্রভৃতি। বৈদিক দেবী হিসেবে সরস্বতী, ঊষা, অদিতি, রাত্রি প্রভৃতি। বৈদিক দেবতাদের কোনো মূর্তি ছিল না। দেবতাদের শরীর ছিল মন্ত্রময়। হোমানল প্রজ্জ্বলিত করে বা অগ্নির মাধ্যমে দেবতাদের আহ্বান করা হতো। প্রজ্জ্বলিত যজ্ঞাগ্নিতে বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশে ঘৃত, পিঠা, পায়েস, মাংস প্রভৃতি অর্পণ করা হতো। বৈদিক ঋষিরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কার্যাবলিকে এক বৃহৎযজ্ঞ বলে মনে করতেন। তাই তাদের যাগকর্ম বিশ্বযজ্ঞের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

সরস্বতী বৈদিক দেবী। পৌরাণিক যুগ থেকে দেবীর বিগ্রহ আমরা পাই। আদি যুগ থেকেই সরস্বতীর বন্দনা করা হয়। অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে, বেদের মন্ত্র উচ্চারণ করে, শ্রদ্ধা জানাতে, তার কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করা হয়। ঈশ্বর যে শক্তিরূপে জ্ঞানকে প্রকাশ করেন, তার নামই দেবী সরস্বতী।

বেদে সরস্বতী দেবীর যে উল্লেখ আছে, সেখানে তিনি নদী স্বরূপা। পুরাণে সরস্বতী দেবীর বিস্তৃত বর্ণনা আছে। তিনি বিদ্যা, সংগীত, নাট্যকলা, চিত্রকলা, ভাস্কর্যসহ সব সৃষ্টিশীল বা সুকুমার শিল্প এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানের দেবী। তিনি আমাদের সব রকম জ্ঞান দান করেন। তবে জ্ঞান লাভের জন্য আমাদের শ্রদ্ধাবান হতে হবে। এ সম্পর্কে পবিত্র গীতায় বলা হয়েছে ‘ শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানং তৎপরো সংযতেন্দ্রিয়ঃ।

জ্ঞানং লব্ধা পরাং শান্তি অচিরেণাধিগচ্ছতি॥’ ৪/৩৯

অর্থাৎ, একনিষ্ঠ শ্রদ্ধাবান সংযত-ইন্দ্রিয় ব্যক্তিই জ্ঞানলাভ করতে পারেন। জ্ঞানলাভ করে তিনি পরম শান্তি লাভ করেন।

সরস্বতী দেবীর গায়ের রং শুক্ল বা শুভ্র অর্থাৎ সাদা চন্দ্রের মতো শোভা তার। শুক্ল তার বসন। সরস্বতী দেবী শ্বেতপদ্মের ওপর উপবিষ্ঠ থাকেন। তার হাতে পুস্তক ও বীণা। বীণা হাতে থাকে বলে সরস্বতী দেবীর আরেক নাম বীণাপাণি। তার বাহন শ্বেত রাজহংস। সবকিছু মিলে সরস্বতী দেবী সর্বশুক্লা। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী দেবীর পূজা করা হয় বলে, এ পঞ্চমী তিথিকে শ্রীপঞ্চমী তিথি বলা হয়। দুর্গা পূজার সময়ও সরস্বতী পূজা করা হয়। তার প্রণাম মন্ত্রে বলা হয়-

‘ওঁ সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমলালোচনে।

বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোস্তুতে॥’

অর্থাৎ, ‘হে মহাভাগ সরস্বতী, বিদ্যাদেবী, পদ্মফুলের মতো চক্ষুবিশিষ্টা হে বিশ্বরূপা, বিশাল চোখের অধিকারিণী, আমাকে বিদ্যা দাও। তোমাকে প্রণাম।’

সরস্বতী জ্যোতিস্বরূপ। নদী ও দেবী রূপেও সরস্বতীর নামকরণ করা হয়েছে। তিনি বাগ্দেবী ও বিদ্যার অধিষ্টাত্রী দেবীরূপেও বর্ণিত। সরস্বতী বিশেষভাবে বিদ্যার্থীদের উপাস্য দেবী। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সাড়ম্বরে সরস্বতী পূজা করা হয়। তিনি শিল্পকলার দেবীরূপে কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, অভিনেতা, নৃত্যশিল্পীসহ কলাকারদের দ্বারা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হন। তিনি সর্বশুক্লা, সুচিতা ও পবিত্রতার প্রতীক তাই যে জ্ঞান অর্জন করতে চায় তাকেও মনে-প্রাণে শুদ্ধ ও পবিত্র হতে হবে। নইলে সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন করা যায় না। সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস। রাজহাঁসকে জল আর দুধ মিশিয়ে দিলে দুধ গ্রহণ করে জল ত্যাগ করে। জ্ঞানী তেমনি জ্ঞানের জগৎ থেকে অসার বস্তু বাদ দিয়ে সার গ্রহণ করেন।

সরস্বতী দেবীকে বলা হয়েছে ‘জাড্যাপহা’। জাড্য মানে জড়তা। এখানে জাড্য মানে মূর্খতা। অপহা মানে অপনাশকারিণী। সরস্বতী দেবী আমাদের মূর্খতা দূর করে আমাদের মন জ্ঞানের আলোকে আলোকিত করেন। সংস্কৃত সাহিত্যে সরস্বতীকে নিয়ে অনেক কাহিনি ও উপাখ্যান রয়েছে। নৈষধচরিত মহাকাব্যে দেখা যায় তিনি স্বয়ং ভীমরাজের রাজসভায় একজন প্রতিভাদীপ্ত উপস্থাপিকা। এমনি আরও অনেক উপাখ্যানে দেখা যায়, অনেক মূর্খ ব্যক্তিও সরস্বতীর কৃপা লাভ করে বিখ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিক-মহাকবি হয়েছেন। তাই আমরা বিদ্যার দেবীর শ্রীচরণে প্রার্থনা জানাচ্ছি- তিনি আমাদের অন্তরের ভিতরকার অজ্ঞান শক্তিকে বিনাশ করে শুভ শক্তির উদ্বোধন করুন।

বিদ্যার দেবীর অবির্ভাব তিথিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নতুন সাজে সজ্জিত হয়। শীতের এই পুণ্য লগ্নে সব ভক্ত ও অনুরাগী এবং বিদ্যার্থীদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। আমরা যেন বৈশ্বিক করোনা মহামারিকে অতিক্রম করে সাম্য, মৈত্রী, অহিংসা ও পরার্থপরতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হতে পারি। মায়ের সন্তানরূপে নিজেদের পরিচয় দিতে পারি। নিছক উৎসব-আড়ম্বরে মত্ত না হয়ে আমরা যেন নিজেদের অন্তরে এই বিদ্যাশক্তির উদ্বোধনে নিয়ত ব্যাপৃত রাখতে পারি।

সেই সঙ্গে মায়ের কাছে আকুল আর্তি, সাম্প্রতিক বিশ্ব যে বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে, তা থেকে আমরা যেন সুস্থ সুন্দর জীবনে ফিরে আসতে পারি, নিপীড়িতদের দুঃখে আমরাও মর্মে মর্মে সমবেদনা অনুভব করি। বর্তমান সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে, দুর্ভাগ্যবশত মানুষ স্বার্থপরতা, হিংসা, মিথ্যাচার ও সংঘর্ষে ক্রমাগত আন্দোলিত। সুস্থ চিন্তাশীল, হৃদয়বান মানুষ আজ ভীত-সন্ত্রস্ত-মর্মাহত। এমতাবস্থায় ঘন মেঘের আঁধার ভেদ করে শীতে সূর্যের আলোক প্রকাশের মতোই আমাদের সংশয়দীর্ণ হৃদয়ে দিব্যোজ্জ্বল জ্ঞানের প্রকাশ হোক বিদ্যাদেবীর আবির্ভাব তিথি উপলক্ষে এই শুভকামনা। সর্বশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় প্রার্থনা-

‘‘তুমি মানসের সাঝখানে আসি

দাঁড়াও মধুর মুরতি বিকাশি,

কুন্দবরণ-সুন্দর-হাসি

বীণা হাতে বীণাপাণি।’’

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এ বিভাগের আরো খবর