কাজী আনোয়ার হোসেন ইন্তেকাল করার প্রেক্ষাপটে সাইবার প্রজাবৃন্দ আবার সেই আলোচনাটাকে সামনে এনেছেন: বাংলাদেশে পাঠকবৃদ্ধিতে তার ভূমিকা বা এরকম। এইরকম আলাপ-আলোচনা বছর দুয়েক আগে শেখ আবদুল হাকিমের সঙ্গে তার স্বত্বাধিকারের আইনি লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটেও একবার উঠেছিল। এ দফায় তফাৎ হলো, সাইবার হৈ-চৈয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা ছিল হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তার প্রভাব-প্রতিপত্তির তুলনা। সারাংশে, কাজী আনোয়ার হোসেন আর হুমায়ূন আহমেদ দুজনের মধ্যে পাঠকসৃষ্টির রাজমুকুট কার মাথায় চড়ানো যাবে তাই নিয়ে এই বিতর্ক। দু-চারজন নেটপ্রজা হয়তো নেহায়েত রঙ্গরসের মুডে ছিলেন; উত্তরটা তাদের জরুরি তা ভঙ্গিতে বা স্বরে মনে হয়নি আমার। কিন্তু অন্য অনেক নেটপ্রজা এই বিতর্কের আশুনিষ্পত্তি ঘটানোর জন্য মরিয়া ছিলেন। যেন, রাজমুকুটটা তখনই দুজনের মধ্যে তার পছন্দের জনকে না দিতে পারলে পরকালে গুরুতর স্ট্যাটাস সংকটে পড়ে যাবেন লেখক।
পরিচিত অনেকেই লাগাতার বলতে থাকেন যে সাইবার হৈ-চৈ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নাই। কিংবা এটাকে তারা সিরিয়াসলি নেন না। কিংবা এখানকার কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভেবে তিনি সময় ‘নষ্ট’ করেন না। আমি দীর্ঘকাল এই মতামত-প্রতিক্রিয়াগুলোকে প্রতিহত করেছি। কখনও আলাপের চেষ্টা করেছি। এটা অনেকটা লেগুনার যাত্রীদের অপছন্দ করার মতো, কিংবা পাবলিক বাসের যাত্রীদের। নিশ্চয়ই কেউ সেটা করতে পারেন। কিন্তু কোনো একটা যানবাহন নিজে যাত্রীর গুণাগুণ বা বৈশিষ্ট্য উৎপাদন করে না; করে কেবল মূল্যমান। ফলে, ফেসবুক বা সাইবার জগতের আলাপ-আলোচনাকে, মূল্যায়নকে যারা না-গুরুত্ব দেবার ঘোষণা দিতে থাকেন, তাদের কোথাও কিছু একটা বাধে।
তাহলে কী দাঁড়ালো? আমি একে ধন্বন্তরী বা ঐশীবাণী মর্যাদায় দেখি? অবশ্য, এটা ভালো প্রশ্ন হলো না। কারণ, তাতে ঐশীবাণী বা ধন্বন্তরীকে আমি কীভাবে দেখি তার আলাপ করা লাগে। আমি, সাইবার রাজ্যের প্রতিক্রিয়াকে জগতের সকল প্রতিক্রিয়ার মতোই পাঠযোগ্য হিসাবে দেখি। অবশ্যই সেগুলোকে শতায়ূ বা দীর্ঘস্থায়ী হিসাবে দেখি না। কিন্তু হ্রস্বস্থায়ী মাত্রই গৌণ নয়। মশার আয়ু সাত দিন আর কাছিমের ৫০০ বছর বলে আমরা যে খাবার টেবিলে বসে কাছিমের জীবন নিয়েই অধিক আলাপ-আলোচনা করি, মশার তুলনায়, তার প্রমাণ পাওয়া মুশকিল।
মুক্তধারা বা পুঁথিঘরের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? কিংবা ঝিনুক পুস্তিকা? অথবা বুক কো-অপারেটিভ? এটা কয়েকটা মাত্র নাম। নাম নেয়াটাও ইচ্ছাকৃত। বাস্তবে স্বাধীন বাংলাদেশে, কিংবা তার আগেই বাংলা ভাষায় কয়েক ডজন প্রকাশকের নাম নেয়া যায়; একটু খোঁজখবর করলেই তা সম্ভব। এদের সকলেরই বিপুল পরিমাণ বই বের হতো। এবং একেকটা বইয়ের বিপুল সংখ্যক কপি ছাপা হতো। উদাহরণ হিসাবে সত্যেন সেনের মতো সিরিয়াস এবং শ্রমিক-ইতিহাসনির্ভর বইগুলোও হেসেখেলে কয়েক হাজার কপি বিক্রি হতো। মহকুমা শহরগুলোতে গণ-গ্রন্থাগার বা পাবলিক লাইব্রেরির অস্তিত্ব এই ধরনের বইয়ের পাঠকবিস্তারে সহায়তা রেখেছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাঠাগারগুলোর ভূমিকা রয়েছে ধারাবাহিক ও নিয়মনিষ্ঠ পাঠক তৈরিতে। সত্যেন সেনের নামটাও আমার তরফে একটা বাছাই মাত্র, নিজের পছন্দের দিক থেকে। কিন্তু সেখানেই সীমিত নয়।
‘ঝিনুক পুস্তিকা’ থেকে নজরুল থেকে শুরু করে শরৎ পর্যন্ত সকল রচনাবলী অতিশয় সুলভ মূল্যে বিপণন-সরবরাহ করা হয়েছিল। জীবনীগ্রন্থের একটা বড় চালান আসতো এবং সেগুলোর বিশাল পাঠক বাহিনী ছিল। বাংলাবাজারের এসব প্রকাশকের বিপণন-নেটওয়ার্ক ছিল সারা বাংলাদেশ ঘিরে। ৩০০ কপি বই ছেপে লেখক পয়দা করার পুরা প্রক্রিয়াটাই ৯০ পরবর্তী শাহবাগ-কাঁটাবনকেন্দ্রিক প্রকাশনা-বিস্তারের আশু ফসল। অনুবাদের একটা বিস্তর গ্রহণযোগ্যতা ছিল। বাংলা একাডেমি এই বিষয়ে অগ্রগণ্য হলেও মুক্তধারাকেও পাশাপাশিই রাখতে হবে। মনে করতে পারা ভাল যে, এমনকি ইসমত চুগতাই বা সাদত হাসান মান্টোর উর্দু সাহিত্যের অনুবাদও ১৯৭২-এর বাংলাদেশে সুলভ এবং এর পাঠক সংখ্যা ছিল বিশাল। আর কিছু বাদ দিলেও বাংলাদেশে সাদত হাসান মান্টোর যে বিশাল একটা পাঠক বাহিনী ছিলেন, সেটা টের পাবার জন্য কারো বিশেষ কোনো রকমের গবেষণা করারই দরকার পড়বে না।
আমার মনে পড়ে, জনৈক সদরুল্লাহ, যিনি মাণিকগঞ্জের কোনো এক পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার ছিলেন, তিনি সংস্কৃত থেকে জয়দেব অনুবাদ করেছিলেন, আর চাইলে আরবি থেকেও অনুবাদের দক্ষতা তার ছিল বলে খোঁজ পেয়েছিলাম। ‘গীতগোবিন্দ’ বইয়ের সেই অনুবাদটি ১৯৮৭ সালে নিউ মার্কেটের একটা দোকান থেকে আমাকে আমার অগ্রজ বন্ধু ফিরোজ কিনে দিয়েছিলেন। বইটিতে কিছু চিত্রসংযোজন ছিল। সেগুলো আমার অত পছন্দের ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই যে আজ এত বছর পর যখন বইটি আর খুঁজে পাই না, আমি অনুবাদক সদরুল্লাহ সাহেব কিংবা প্রকাশক জয়বাংলা প্রকাশনী নিয়ে অনেকের কাজে জিজ্ঞাসা করেছি। এদের খোঁজ আমি পাইনি। হয়তো আমি যাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছি, তার বাইরে কেউ বলতেও পারতেন।
পশ্চিমবাংলার প্রকাশনীগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে আলাপ করলে অনেকেই গাল ফোলাতে পারেন। কিন্তু বাদ দিয়েই বা আলাপ হবে কীভাবে! পশ্চিমবাংলা আর বাংলাদেশের মধ্যকার প্রকাশনা ও বিপণনের সম্পর্কের ম্যানিপুলেশন নিয়ে স্বতন্ত্র আলাপের দরকার আছে। তারপরও সেই আলাপ পুস্তক উৎপাদকদের করাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। কিন্তু যখন আমরা পাঠকবিস্তারের প্রসঙ্গে কথা বলছি, তখন তো আর বিদ্যমান প্রবণতাকে উড়িয়ে বা এড়িয়ে আলাপ চলতে পারে না। যদি অন্য কোনো প্রকাশকের কথা বাদও দিই, মিত্র ও ঘোষ এবং দে’জ প্রকাশনীর সুবিপুল পুস্তক সংখ্যা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের প্রসঙ্গ সামনে আনতেই হবে। বিশেষত, সেই সময়ে এটা আরো প্রাসঙ্গিক যখন ভারতীয় বইয়ের দাম বাংলাদেশে মুদ্রিত মূল্যমানের সাড়ে তিন গুণ ছিল। মিত্র ও ঘোষ কেবল অপেক্ষাকৃত কম দামে নানাবিধ রচনাসমগ্র হাজিরই করেনি, উপরন্তু বাংলাদেশে বাহ্যত অজনপ্রিয়-থাকতে-পারতেন এমন দুইজন কর্ণধারের দুর্দান্ত বাংলা রচনার সাথে পাঠককে পরিচিত করিয়েছেন – যথাক্রমে গজেন্দ্রকুমার মিত্র এবং সুবোধ ঘোষ। খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, গজেন মিত্র এমনকি বাংলাদেশের প্রথম দিকের স্যাটেলাইট জমানাতেই ধারাবাহিকের বিষয়বস্তু হয়েছিলেন – আফসানা মিমি পরিচালিত ‘পৌষ ফাগুনের পালা’। টেলিভিশনে চিত্রায়নের সূত্র ধরে কোনো কিছু প্রমাণ করতে চাইছি না আমি। কিন্তু বাংলাদেশের টেলিভিশনে গড়ে ধ্রুপদী সাহিত্যনির্ভর কাহিনির যে প্রবণতা, তাতে পশ্চিমবাংলার অপেক্ষাকৃত বড় তারকার বাইরে কারো সাহিত্যকে অধিগ্রহণ পরিচালকীয় সাহিত্যরুচিকে যেমন স্পষ্ট করে; তেমনি পাঠকবিস্তারের প্রসঙ্গটাকে বুঝতে এটা সহগ উপাদান।
সুবোধ ঘোষ তার বন্ধুর মতো উপন্যাসনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন না। তুলনায় ভ্রমণকাহিনি আর ছোটগল্পের ওস্তাদ তিনি। ভ্রমণকাহিনিকে উপন্যাসের/ফিকশনের স্বাদে পুষ্ট করাতে তিনি ঈর্ষণীয় দক্ষতারও ছিলেন। আমি যে সুবোধ ঘোষের ‘রম্যাণী বীক্ষ’ গ্রন্থটির প্রায় সবগুলো খণ্ডই (সম্ভবত ২৩টা) পড়ে ফেলেছিলাম, সেটারও কারণ এই যে, ওই মহকুমা (পরে জেলা) পাবলিক লাইব্রেরিতেই সুবোধ ঘোষ সংযোজিত ছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদ যে তখন জন্মেছিলেন কোনোই সন্দেহ নেই, তবে কিতাব লিখেছিলেন কিনা খোঁজ নিতে হবে। ‘মাসুদ রানা’ তখন বিরাজেন, লাইব্রেরির তাকে শোভা পান, এবং প্রচুর তরুণের প্রথম পছন্দের তাক সেগুলো। আমি ‘মাসুদ রানা’র ভক্ত ছিলাম না, সেটা দৈবাৎ হিসাবে দেখি। কোনো কিছু লঘুগুরু প্রমাণের চেষ্টায় বলছি না। এটা আমার একটা প্রস্তাব যে, ‘মাসুদ রানা’র জনপ্রিয়তার সাথে ১৯৭৫ পরবর্তী সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক জমিনে মার্কিনী তারুণ্য ও সামরিকমনস্ক যুবকত্ব একটা প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু এটা প্রমাণের জন্য যতটা কাঠখড় পোড়াতে হবে, তা এক্ষুনি আমি চাইছি না।
বাংলাদেশের পাঠকসংখ্যা এখানকার জনসংখ্যার সাপেক্ষে নিশ্চয়ই কম। কিন্তু জনসংখ্যাকে সাপেক্ষ ধরে আলাপগুলো বিশেষ সুবিধার হয় না। তাহলে ক্রীড়ানৈপুণ্য কেবল ভারত আর চীনেরই দেখাতে পারার কথা। ফিলিস্তিনি বা আলবেনীয় সাহিত্য নিয়ে, জামাইকান সঙ্গীত নিয়ে কিংবা জর্জীয় চলচ্চিত্র নিয়ে আলাপ বা আগ্রহের মানেই হয় না।
যা হোক, যেসব হামানদিস্তা চিন্তাকাঠামো নিয়ে আমার সমস্যা, সেগুলো নিয়ে বলতে গিয়েই এই উল্লেখ করলাম মাত্র। এই কম সংখ্যক পাঠকের দেশেও পাইরেটেড বইয়ের গুরুত্বও সমধিক। সেটা অনুধাবনের জন্য একদম লেটারপ্রেসের কালেই যেতে হবে আমাদের। পাইরেসি সংক্রান্ত যে নৈতিক চাপ সেগুলো অনেক কম ছিল। কিন্তু এখানে আমি চাই পাঠকেরা মনোযোগ দিন অন্য একটা জায়গায়। একটা বইয়ের কপি হাতে পাবার পর সেটাকে পড়ে পড়ে নিকটবর্তী কোনো অপেক্ষাকৃত সস্তা বিনিয়োগের একটা ছাপাখানায় আদ্যোপান্ত বইটির হরফ পুনর্সজ্জিত হলো; সেটাকে ছাপাখানায় তুলে নিউজপ্রিন্টে ছাপা হলো। পেপারব্যাক বা নরম বাঁধাই হলেও একটা দ্বিরঙা পাতলা প্রচ্ছদ ছাপানো হলো। তারপর লঞ্চঘাট কিংবা রেলস্টেশনে গরিব ফিরিওয়ালার কাঁধে চেপে-চেপে বইগুলো বিক্রি হচ্ছে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় লগ্নিকারের যদি কোনোরকম লভ্যাংশের সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে এই কাজটাতে তিনি হাত দেবেন কেন? এই ধরনের বইয়ের বিপুল একটা বাজার ছিল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত থেকে নিমাই ভট্টাচার্য, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় থেকে বিমল মিত্র, কখনও কখনও এমনকি আশাপূর্ণা দেবী।
যে ধরনের ছাপাখানা থেকে এই ‘বেআইনি’ বইগুলো মুদ্রিত হতো, সেই একই ধরনের ছাপাখানা থেকে নূরানি নামাজ-শিক্ষার বই, বিখ্যাত ব্যক্তিদের বাণীমালা কিংবা পঞ্জিকাও বের হতো – তারাচাঁদ পঞ্জিকা, লোকনাথ পঞ্জিকা। এসব পঞ্জিকার একটা ছিল পকেট সংস্করণ, আরেকটা বড় সংস্করণ। পঞ্জিকার মুদ্রণকে ঠিক হাজারের সংখ্যা দিয়ে বোঝা সম্ভব হতো না। সম্ভবত ওগুলো ছিল লাখের অংকে। এখন কেউ চাইলে পঞ্জিকাকে পাঠাভ্যাসবিস্তারী কোনো পুস্তক হিসাবে দেখতে নাও চাইতে পারেন। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি যে, দুপাতা পঞ্জিকা তিনি দক্ষপাঠ করে প্রমাণ দিতে পারবেন না যে ‘পড়তে পারেন’। পঞ্জিকার ক্রমবর্ধমান চাহিদার মধ্যে একটা ফিউশনও ঘটে – মোহাম্মদী পঞ্জিকার আবির্ভাব ঘটে এবং এরও বিপুল পাঠক।
আচ্ছা, নিকট অতীতে তসলিমা নাসরিনকেই বা কোথায় রাখব? তসলিমা নাসরিন বহুলপঠিত, অতিশয় জনপ্রিয়, নতুন পাঠক সৃষ্টিকারী লেখক ছিলেন। এই সারসত্যটিকে না দেখতে পারার জন্য অহংকারী পুরুষ ও পুরুষালি আধিপত্যের নিবিড় প্রজা হওয়া দরকার। তসলিমা যে একজন অতিকায় প্রপঞ্চ ছিলেন, সেটা বোঝার জন্য ‘ক’ উপন্যাস পরবর্তী বিশাল পত্রিকা হাউজগুলোর পক্ষ থেকে তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টার আয়োজনের বহর থেকেই বোঝা যায়। এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসটির গুণমাণ এবং লিঙ্গ-রাজনীতি নিয়ে স্বতন্ত্র আলাপ হতে পারে। কিন্তু তাকে প্রতিহত করার আয়োজনে আমার মনোযোগ পড়েছে আরও বেশি। কিন্তু আমি আরও আটপৌরে চিত্র হাজির করি বরং। হুমায়ূন আহমেদ সাহেবের জনপ্রিয়তার আগেই তসলিমা নাসরিন জনপ্রিয় ছিলেন। গদ্যের জন্য যেমন, কবিতার জন্যও তেমন। যশোলোভী পুরুষ সাহিত্যিকদের জন্য অশান্তির হলেও এটাই বাস্তব। এমনিতে হুমায়ূন সাহেবের সাহিত্যিক জনপ্রিয়তাকে দেখা দরকার প্যাকেজ নাটক ও স্যাটেলাইট উত্থানের সাথে মিলিয়ে। এটা একটা প্রস্তাব মাত্র, এবং উপেক্ষা-অযোগ্য প্রস্তাব। এখানে তুলবার কারণ হলো, তসলিমার জনপ্রিয়তা এসব মাত্রাও পায়নি। তার আগে দৈনিকের পর্যালোচনার পাতায় হাতেগুণে সম্ভবত এক দুইজন নিয়মিত নারীকে পাওয়া গেছে – আনোয়ারা সৈয়দ হক একজন। মনে পড়ে, পত্রিকার পাতায় তাকে কলামিস্ট হিসাবে আনবার কৃতিত্ব জাহিরি কিছু বক্তৃতাও ‘ক’-উত্তর কালে দুচারজন সম্পাদক ঝাড়ছিলেন। এই হলো ঢাকা!
যাদের মনে নেই, তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিই, ওই সময়কালে তসলিমা কার্যত নিষিদ্ধ ছিলেন। বাস্তবে মানুষজনের মনে পড়বে যে ‘ক’ নিষিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তার জীবনে নিষিদ্ধ হওয়া নতুন কিছু নয়। ‘লজ্জা’ আমার পছন্দের উপন্যাস নয়; কিন্তু নিষিদ্ধ হওয়াতে খুশিও হইনি। সেটা ১৯৯৩ সালে। ১৯৯৯ তে ‘আমার মেয়েবেলা’ও নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু কথা আসলে বই নিষিদ্ধ নিয়ে হচ্ছে না। কার্যত পুস্তক ব্যবসায়ীদের একাংশ কোনো না কোনো কারণে তসলিমাকে ‘বয়কট’ করে রাখছিলেন।
‘লালন আখড়া রক্ষা আন্দোলন’-এর গুরুত্ব যাই হোক, আমি ছিলাম একজন কর্মী। পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলাতে সমন্বয়ের কাজ নিয়ে গেছি। ১৩ এপ্রিল ২০০১-এর নৈশ বাসে। যে বাড়িতে শেষরাতে আশ্রয় নিয়েছি, স্থানীয় একজন কলেজ শিক্ষক, সকালে ঘুম থেকে উঠে তার বাড়িতে নাস্তা করে বেরোনোর কথা। ঠিকঠাকমতো নাস্তা করার আগেই রমনা বটমূলের কথিত ‘মৌলবাদী’ হামলার খবর এসেছে। লালন আখড়া আন্দোলন মাথায় উঠল, আসলে নাস্তাও বিশেষ রুচল না মুখে। এ ছাড়া, অস্বীকার করব না, ‘মৌলবাদী হামলা’ থিসিসটার প্রতি গুরুত্বপূর্ণ আস্থা বজায় রাখতেও পারছিলাম না। সারাদিন ভুমমারা মুখে বসে আছি এখানে-ওখানে। রাতের বাস ধরব। বিকাল নাগাদ বসে আছি স্থানীয় একটা বইয়ের দোকানে। থমথমে মুখে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আলাপ করছি দোকানের কর্ণধার, একজন সাংবাদিক, একজন শিক্ষক, আমি – ভ্রমণকারী সংগঠক। বোদা কলেজ থেকে দুজন ছাত্রী এলেন। মাথায় ওড়না পেঁচানো। তখনো হিজাব নিখিল বাংলাদেশি জনপ্রিয় পোশাক হিসাবে আবির্ভূত হয়নি। নিচু গলায় তারা জানতে চাইলেন, যে বই দুটো বলে গেছিলেন তা আনা হয়েছে কিনা। বিক্রেতাও বেশি কথা না বাড়িয়ে কাগজের ঠোঙায় দুইখানা তসলিমার বই সরবরাহ করে দিলেন। তসলিমা নাসরিন এমনই এক লেখকের নাম। একেবারেই নিকট অতীতের বাংলাদেশে।
খুবই হ্রস্বস্মৃতির মানুষজন চারপাশে। প্রতি বছরই যেমন মানুষ বলতে থাকেন ‘এ বছরের মতো গরম আমার বাপের জন্মে দেখিনি।’ এসব কথাকে বস্তুগত সত্য হিসাবে গ্রহণ বা অনুধাবন করা যাবে না। জাস্ট কথার কথা আরকি!
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক