বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নির্ভরশীলতাই কি দুঃখ-কষ্টের উৎস?

  • ইকরাম কবীর   
  • ৩১ জানুয়ারি, ২০২২ ২৩:৩৪

আধুনিক জীবনযাত্রায় নির্ভরশীলতা বেশিরভাগ সময় বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়। বিজ্ঞাপনে বলে – শরীরের পুষ্টি মেটাতে প্রতিদিনই দুধপান করতেই হবে, মাংস থেকে আমিষ আহরণ না করলে শরীরে শক্তি আসবে না, এই ফেইস ক্রিমটি মাখলে চেহারা জ্বল-জ্বল করবে, ইত্যাদি।

বলছেন কি?! নির্ভর করলেই কষ্ট পাব? যে সমাজে বসবাস করি, সেখানে নির্ভরতা ছাড়া জীবন চালাব কেমন করে?

ধরুন, যারা নানা রকম মাদকে আসক্ত, একদিন তার মাদক কেনার অর্থ নেই কিংবা কোনো কারণে সেদিন দ্রব্যটি নেই, সেই মাদকহীন দিনটি তার কেমন যাবে? শারীরীক এবং মানসিক যাতনা তাকে আষ্টেপৃষ্টে পিষে ফেলবে। সেই দ্রব্যটি, যার ওপর তিনি নির্ভরশীল, তা আবার সেবন না করা পর্যন্ত তিনি যন্ত্রণামুক্ত হবেন না।

আবার ধরুন, আপনার বাড়িতে খাবার প্রস্তুত করেন আরেকজন মানুষ। এমন কি আমাদের বিকেলের চা-ও তৈরি করে দিচ্ছেন অন্য কেউ। হতে পারে আমাদের গৃহকর্মী, সন্তান বা স্ত্রী। অফিসে আমাদের অফিস-সহকারী চা বানিয়ে না দিলে বা দোকান থেকে খাবার কিনে এনে না দিলে আমাদের কী অবস্থা হবে? অসহায়ত্ব জেঁকে বসবে। মেজাজও চড়ে যাবে। অফিস-সহকারী সাত দিনের ছুটিতে গেলে আমাদের কেমন লাগে?

অফিসে আরও অনেক বিষয়ে আমরা অন্যের ওপর নির্ভর করি। আমি যদি কোনো টিমের নেতৃত্বের আসনে থাকি, তাহলে বেশির ভাগ কাজ আমার টিমের সহকর্মীরাই করবে। তবে তারা যতক্ষণ কোনো একটি কাজ শেষ না করছে, ততক্ষণ আমি মানসিকভাবে উৎকণ্ঠিত থাকব।

ছোটবেলায় বাবা আমাকে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বদলে ফেলার কাজ শিখিয়েছিলেন। আমি সিলিং-ফ্যান, ঘরের যে কোনো সুইচ নষ্ট হলে নিজেই বদলে ফেলতে পারতাম। একটা সময় এলো ওই কাজগুলো আমার আর করতে ভাল লাগতো না। বাবা নিজেই করতেন। বাবা কিন্তু আমার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন না। তিনি আমায় শিখিয়েছিলেন মাত্র এবং আমি করতাম দেখে আমাকে করতে দিতেন। তিনি যখনই দেখলেন আমি আর করছি না, তিনিই করতেন। তার কষ্ট হয়নি।

এখন বাবা নেই। আমার বাড়িতে বৈদ্যুতিক কাজ কেয়ারটেকার বা মিস্ত্রি এসে করে। তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় কাজটি আমি ভুলে গেছি। এখন আর পারি না।

হয়তো বলবেন, খাবার না খেলে মানুষ মরে যাবে। খাবারের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে উপায় কী? খাবার ব্যাপারে নির্ভরশীলতা একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যাপার। চাকার মতো। এ চাকা চলতেই থাকে। আমাদেরকে খেতেই হবে। তবে ধরুন, আমি মাংস ছাড়া আর কিছুই খাই না। বা কোনো একটি খাবারে আমি আসক্ত। একদিন সেই খাবার নেই। আমার কেমন লাগবে?

আমি নিজে ভিগ্যান (নিরামিষাশী) জীবন যাপন করি। আমার খাবারে কোনো দুধ, ডিম, মাছ-মাংস নেই। শাক-সব্জিই আমার খাবার। আমি নির্ভরশীল। কোনো বিয়েবাড়িতে যেতে আমার কুণ্ঠা হয়। গেলেও আমাকে পকেটে করে একটা-দুটা আপেল বা কলা নিয়ে যেতে হয়। চিন্তা করুন আমার যন্ত্রণা। বিয়েবাড়িতে অনেকেই আমাকে দেখে ঠাট্টা করবে – তা আরেক যন্ত্রণা।

ইনসুলিন নিতে হয় এমন ডায়াবেটিকদের দেখেছেন নিশ্চয়ই। ইনসুলিন না নিলে তাদের রক্তে শর্করা বেড়ে যাবে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আবার বেশি নিলেও শর্করা কমে গিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থা তৈরি হবে।

ঘুমোনোর সময় মশারি টাঙাতে অনেকেরই ইচ্ছে করে না। তাহলে কি করব? মশা মারার ওষুধ স্প্রে করতে হবে। স্প্রের মধ্যে কোন কোন রাসায়নিক দ্রব্য আছে তা চিন্তা না করে স্প্রে করব – স্প্রের ওপর নির্ভরশীল হব।

মানসিকভাবেও অনেকে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন, ডিপেনডেন্ট পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার (ডিপিডি)। যদিও মনের চিকিৎসকদের মনের বিষয়ে সব কথা বিশ্বাস করা ঠিক নয়, তারা বেশিরভাগ সময় পুস্তক-নির্ভরশীল। তবে যাদের ডিপেনডেন্ট পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার আছে, তারা অন্যের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না কী কাপড় পরবেন, বাসে চড়বেন না রিকশায় যাবেন।

আধুনিক জীবনযাত্রায় নির্ভরশীলতা বেশিরভাগ সময় বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়। বিজ্ঞাপনে বলে – শরীরের পুষ্টি মেটাতে প্রতিদিনই দুধপান করতেই হবে, মাংস থেকে আমিষ আহরণ না করলে শরীরে শক্তি আসবে না, এই ফেইস ক্রিমটি মাখলে চেহারা জ্বল-জ্বল করবে, ইত্যাদি।

বুঝতে হবে ব্যবসা-বাণিজ্য বা ব্র্যান্ডগুলোও আমাদের তাদের ওপর নির্ভরশীল করতে চায়।

নির্ভরশীল না হলে কী হয়? যেই দূরত্ব যেতে দশ টাকা রিকশা ভাড়া খরচ করতে হয়, তা না হয় হেঁটেই গেলাম। ঘর্মাক্ত হব? ক্লান্ত হব? তা না হয় হলাম, কিন্তু নির্ভরশীল তো হব না। নিজের চা নিজে বানিয়ে নিয়ে কী হয়? লকডাউনের সময় প্রায় সবাই নিজের বাড়ির মেঝে নিজে ঝাড়ু দিয়েছি, মুছেছি। আমার তো মনে হয় লকডাউনে আমরা অনেক স্বাধীন ছিলাম। নিজের কাজ নিজে করেছি। কারও ওপর নির্ভরশীল ছিলাম না।

চিন্তাগুলো বেশি বড় করব না; এখুনি শেষ করে দিচ্ছি কয়েকটি প্রশ্নের মাধ্যমে। প্রশ্নগুলো পড়ে আপনারাই চিন্তা করুন এবং নিজেদেরকেই উত্তরগুলো বলুন বা লিখে ফেলুন।

মানব ইতিহাসে নির্ভরশীলতা প্রথম কেমন করে শুরু হয়েছিল? ঈশ্বরকে দিয়ে? স্বর্গের প্রতি নির্ভরশীলতা? প্রকৃতি? পরিবার?

কেন এই নির্ভরশীলতা? সুখ-শান্তি দেয়? না যন্ত্রণা?

ইকরাম কবীর: গল্পকার, যোগী ও যোগাযোগ পেশায় নিয়োজিত।

এ বিভাগের আরো খবর