মুনা (ছদ্ম নাম) একটি কলেজ থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছে। বাবা-মা ভালো পাত্র পেয়ে তৃতীয়বর্ষে ওঠার পর ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। পাত্র লন্ডনে চাকরি করে বলে মুনা ল’ প্র্যাকটিস না করেই লন্ডনে চলে যায়। বিয়ের পর লন্ডনে যাবে এই ভাবনায় মুনা খুশি মনেই বিয়েতে সম্মত হয়েছিল। বাবা-মা প্রচুর টাকা খরচ করে ‘রাজপুত্র’ বর পেয়ে তাদের ‘রাজকন্যা’ মেয়েকে তার হাতে তুলে দেন।
কিন্তু বিধিবাম। সেখানে সেই ভালো ছেলে ও তার পরিবার দিনরাত মুনাকে সন্দেহ করত। তাকে বাইরেও কোনো কাজ করতে দেয়নি এবং শেষ পর্যন্ত মুনা দেখে তার স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত।
মুনা এক সন্তান কোলে নিয়ে যখন দেশে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসে, তখন তার উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা এতোটাই হ্রাস পেয়েছে যে নিজে আইন নিয়ে পড়লেও মামলা করার ব্যাপারে সাহস পায়নি। এ ক্ষেত্রে মুনার বাবা বলেছিলেন, ‘দোষ আমাদের। প্রবাসী পাত্র পেয়ে মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দিলাম। ভাবলাম এতো পড়াশোনা করে জজ-ব্যারিস্টার হয়ে কী হবে? এর চেয়ে সংসার করুক। ভালো বউ হোক।’
এই ভালো বউয়ের ধারণা থেকে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত কেউ বেরিয়ে আসতে পারেননি। অভিভাবকরা তো নয়ই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীরাও নয়। নরসিংদীর মেয়ে ফিরোজা যখন নার্সের চাকরি করত, তখন দুইবার তার বিয়ে ভেঙে যায় রাতে ডিউটি করতে হয় বলে। বাবা-মা জোর করে চাকরি ছাড়িয়ে ব্যবসায়ী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন। বিয়ের আগে বেশ অনেকদিন রূপচর্চা করতে হলো চাকরিজীবীর কঠিন চেহারা মুছে ফেলার জন্য।
বিয়ের পর ফিরোজাকে কঠিন পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল, চাকরি জীবনে তার সতীত্ব যে রক্ষিত ছিল তার প্রমাণ দেয়ার জন্য। শ্বশুর-শাশুড়ি ক্রমাগত অভিযোগ করতেন কয়েকটা টাকার জন্য বেশি বয়সী মেয়ে বিয়ে করিয়ে তার ছেলের সুখ নষ্ট করেছেন তারা। এই ‘সুখ’ কী, তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না। আমরা যতই সমাজ পরিবর্তনের কথা বলি না কেন, বড় একটা অংশ এই বোধকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে আছে।
অথচ আমাদের আশপাশের এশিয়ান কিছু দেশে মেয়েদের চিন্তা-ভাবনা অনেকটাই পাল্টে গেছে। ব্যাংককে একটি প্রশিক্ষণে গিয়ে পরিচয় হলো দুই থাই ছেলের সঙ্গে। দুজনের বয়স চল্লিশের মতো। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, তারা কেউ বিয়ে করেননি। কারণ মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবলাম হয়তো আমাদের দেশের মতো তাদের চাহিদামতো রূপে-গুণে অনন্যা মেয়ে পাওয়া যায়নি, তাই বিয়ে হয়নি।
কিন্তু পরে বুঝলাম সে দেশে মেয়েরাই বিয়ে করতে চাইছে না। তাই তারা বিয়েতে ইচ্ছুক হয়েও মেয়ে পাচ্ছেন না। তারা জানালেন, থাই মেয়েরা এখন নিজেদের মতো চলতে চায়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। পারিবারিক মূল্যবোধে পরিবর্তন এসেছে তাদের। মেয়েরা ভাবে, সংসার করে দায়িত্ব পালন করব আমরা, বাইরে কাজ করব আমরা, রান্না করব আমরা, বাচ্চা জন্ম ও লালন-পালন করব আমরা, তাহলে আর বিয়ের মতো এই ঝামেলা মাথায় নেব কেন? থাই মেয়েরা এখন একা থাকার পক্ষে।
বাংলাদেশে বিয়েটা সাধারণত মেয়ের ইচ্ছায় হয় না, হয় অভিভাবকের ইচ্ছায়। ছোটবেলা থেকেই একটি মেয়েশিশুকে কনে সাজিয়ে, ঘরকন্নার কাজ শিখিয়ে, আদব-লেহাজ চর্চা করিয়ে এমনভাবে বড় করা হয়, যেন সেই মেয়েটি একজন ভালো বউ হতে পারে। আমাদের সমাজে নারীর পড়াশোনা শেখা ও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেয়েও বিয়ে করে ভালো ‘বর’ ও ঘর পাওয়াটা জরুরি। অপরদিকে একটি ছেলেসন্তান কীভাবে ভালো বর হতে পারে বা দায়িত্ববান স্বামী হতে পারে, সেটা একদমই শেখানো হয় না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ছাত্রনেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদেরকে কেউ সহজে বউ হিসেবে নিতে চায় না। কারণ সারা রাত তারা ঘোরাফেরা করে। বাট আমি চাই না যে আমাদের যারা এত ভালো ভালো স্টুডেন্ট, যারা এত সুন্দর সুন্দর... আমাদের এখানকার যে ডিপার্টমেন্টগুলো এবং আমাদের যে বিখ্যাত শিক্ষকরা...তারা যাদেরকে গ্র্যাজুয়েট করে তোমাদেরকে বের করতে চায়, তাদের এ রকম একটা কালিমা লেপুক।’
ওনার কথা শুনে মনে হলো বিয়ে করে বউ হওয়ার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা পড়াশোনা করছেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য চিন্তা করবেন একাডেমিক পরিবেশ, লাইব্রেরির হাল, হলের পরিবেশ, গবেষণার সুযোগ ছাত্রীদের জন্য কতটা অনুকূল ইত্যাদি। সেসব চিন্তা না করে উনি চিন্তা করছেন ছাত্রীদের বিয়ে হবে কিনা, ছাত্রীদের সতীত্ব থাকবে কিনা। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয় একজন উপাচার্যের এ ধরনের উক্তি শুনে।
একজন শিক্ষক যদি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীদের চাকরি-বাকরি, গবেষণা নিয়ে না ভেবে শুধু বিয়ে নিয়ে ভাবেন, তাহলে বুঝতে কষ্ট হয় না সমাজের অন্যেরা কী ভাবছে।
আমাদের সমাজ-পরিবার মেয়েশিশু জন্মের পর থেকেই তাদেরকে একটা ধারণা দেয় যে তাকে সুন্দর হতে হবে, সহবত শিখতে হবে, চামড়ার রং ফর্সা করতে হবে, ঘরকন্যা শিখতে হবে, তাবাসসুম হাসি প্র্যাকটিস করতে হবে, পড়াশোনা করে বা না করে বিয়ের জন্য যোগ্য পাত্রী হতে হবে। এমন কিছু করা যাবে না, যা বিয়ের পথকে রুদ্ধ করে।
মেয়েরা প্রতিবাদী হবে, আন্দোলন করবে, গলা উঁচু করে কথা বলবে, পাহাড়ে উঠবে, বেড়াতে যাবে, সাঁতার কাটবে, এমনকী পড়াশোনা শেষ করে একটা ভালো চাকরি করবে – এটা অধিকাংশ অভিভাবক এখনও ভাবেন না। যেমনটা ভাবতে পারেননি শাবিপ্রবির অভিভাবক। জাবির ছাত্রীরা যেহেতু রাতে বের হন, আড্ডা মারেন, গল্প করেন, চা খান, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করেন, সংগ্রাম করেন দাবি আদায়ে – তাই তারা অচ্ছুৎ হয়ে গেছেন, সেইসব তথাকথিত অভিভাবকদের চোখে।
আমাদের কন্যা সন্তানদের সামনে আমরা কেন এমন কোনো আদর্শ খাড়া করাতে চাই না, যাদের শিরদাঁড়া সোজা? কেন তাদের সব ক্ষেত্রে নতজানু হয়ে থাকার শিক্ষা দেই? কেন বলি, মেয়ে তুমি মেনে চলো?
নিজের চেহারা-ফিগার সুন্দর রাখা বা অন্যের সামনে নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করাটা কোনো অপরাধ নয়, বরং তাই করা উচিৎ নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে। কিন্তু এর পাশাপাশি নৈতিকতা, বিনয়, কাণ্ডজ্ঞান এবং শিক্ষার আলোটাও থাকা জরুরি।
এই সমাজে ভালো থাকার পুরো দায়িত্বটা কেন শুধু নারীর ওপর বর্তায়? বিয়ের উপযুক্ততা বিচারের জন্য নারীকেই কেন সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয় এখনও? পুরুষের কৌমার্য পরীক্ষার কোনো নিয়ম চালু আছে বলে আমার জানা নেই।
যুক্তরাজ্য ও ভারতের মতো নাচে-গানে ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে ভরপুর দেশেও বিতর্কিত হাইমেন সার্জারি বা কুমারীত্ব পরীক্ষার ব্যবসা জমজমাট বলে অভিযোগ উঠেছে। এই সব দেশে মেয়ে ও মেয়েদের অভিভাবকরা লাখ লাখ টাকা খরচ করছে এই হাইমেন সার্জারির পেছনে। ‘নারী কুমারী হলে চাদরে রক্তের দাগ লাগবে’– এই আদি ও ভ্রান্ত ধারণা এখনও ব্রিটেনের মতো আধুনিক সমাজে চলমান, ভাবলেই অবাক লাগে।
ভারতে অসংখ্য নারীকে সত্বীত্বের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। সতীত্ব আছে কি না, এর জন্য পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে ভারতের অনেক নারীর কপালে জোটে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট। সমালোচনা ও প্রতিবাদের পরও এটি বন্ধ হচ্ছে না।
গাইনির চিকিৎসকরা বার বার করে বলছেন, হাইমেনের কারণে কেউ নারীর কুমারীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না এবং এটা সতীত্ব পরীক্ষার কোনো নিয়ম নয়। যোনিকে ঢেকে রাখার জন্য হাইমেন কোনো পর্দা নয়, তাই এটা ছেঁড়ে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘ বার বার বলছে, এই কুমারীত্ব পরীক্ষা নারীর মানবাধিকার লংঘন। এই পরীক্ষা বন্ধ হওয়া উচিৎ। নারী নির্যাতনের হাতিয়ার এই পরীক্ষা।
সতীচ্ছেদ হলে রক্তক্ষরণ হবে, এটাও ভুল ধারণা। হাইমেন ছেঁড়ার কারণে নয়, বরং যৌনমিলন ভুলভাবে বা জোর করে করলে আঘাত পেয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে, যেমনটা হয়েছিল ২০২০ সালে টাঙ্গাইলের ১৪ বছরের সেই কিশোরীর ক্ষেত্রে, যাকে তার চেয়ে ২০ বছরের বড় স্বামীর পাশে দেখাচ্ছিল ভয়ার্ত হরিণের মতো। সেই ভয়টিই সত্যি হয়েছিল মেয়েটির জীবনে। জোরজবরদস্তিমূলক সহবাস বা অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন সম্পর্কের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাকে শেষ পর্যন্ত মারা যেতে হলো।
মেয়েদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিজের পায়ে দাঁড়ানো। লেজার ট্রিটমেন্ট, জিরো ফিগার, বোটক্স বা ফেয়ার এন্ড লাভলি মেখে নিজের চেহারা পরিবর্তন করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেয়েও বেশি জরুরি হচ্ছে ৫০ টাকা আয় করে আত্মনির্ভরশীল হওয়া। বিয়ে ও মানুষের সামনে প্রেজেন্টেবল হওয়ার চেয়েও বেশি জরুরি নিজের পায়ে দাঁড়ানো।
আমরা এই অভিভাবকরাই মেয়েদের মধ্যে বদ্ধ ধারণা ঢুকিয়ে দেই: ভালো ঘর, ভালো বর না হলে জীবন সুখের হয় না। নিজেকে তৈরির করার চেয়েও তাই বেশি জরুরি নিজেকে সুন্দর করে তোলা। তখন বিদ্যা, শিক্ষা সব গৌণ হয়ে যায়।
যাদের টাকা আছে, তারা লাখ-কোটি টাকা খরচ করে মেয়ের বিয়ে দেন। যাদের নাই তারাও যেভাবে পারেন টাকা যোগাড় করেন এবং সেই টাকা যোগাড় করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হন। তাও মেয়েকে পাত্রস্থ করার জন্য পরিবার চেষ্টা চালাতেই থাকে। এর জন্য মেয়েকে যেভাবে প্রস্তুত করা দরকার, তারা করেন। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত এবং শিক্ষিত পরিবারেও মেয়েদের এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যে মুখ্য উদ্দেশ্য বিয়ের বাজারে টিকে যাওয়া, শিরদাঁড়া সোজা করা নয়।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।