সূত্রপাত
এই রচনাটির কারণ শিবব্রত বর্মন, অভিলক্ষ্যও তিনিই। তবে উপলক্ষ হচ্ছে সাইবার-গল্পপ্রবাহ ‘শাটিকাপ’। সহকর্মী ফাহমিদুল হক যখন ‘শাটিকাপ’ নিয়ে কথা বলতে বললেন, তখন সেই নিমন্ত্রণ শিরোধার্য বানাতে হলো। ছবিটি আমার অতিশয় পছন্দের, তবে সেটা নিয়ে এখন কথা বাড়াতে চাই না। সেই আলোচনায় আমার কয়েকটা বক্তব্যের একটা ছিল সঞ্চালকের এই জিজ্ঞাসাকে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে যে রাজশাহীর ও রাজশাহী শিক্ষাঙ্গনের এরকম কাজকর্মের পর জাহাঙ্গীরনগরের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছ থেকে কী আশা করা যেতে পারে, বা কাছাকাছি কিছু। অন্যান্য আলাপের পাশাপাশি এই জিজ্ঞাসাটিতে আমার বক্তব্য ছিল এরকম: রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দুটোর সাংস্কৃতিক তৎপরতাকে নানান কারণেই তুল্যবিচার করার পদ্ধতিগত অসুবিধা আছে; বিশেষত মহানগরের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত দূরত্ব, যোগাযোগব্যবস্থা, ক্যাম্পাসকে নগরবাসীদের ব্যবহার করার ধরন, নগরের নাগরিক তৎপরতার সাথে ক্যাম্পাসের তৎপরতার মিলজুল করার প্রয়াস এবং সর্বোপরি নগরটির সাংস্কৃতিক লিগেসির/ঐতিহ্যের ধরন ইত্যাদিকে একত্রে বিবেচনা করে দেখা দরকার।
শ্রোতা হিসাবে এইটুকু শুনবার পর শিবব্রত অনুভব করেন এই পর্যবেক্ষণ বা যুক্তিটা আরো খোলাসা করলে ভালো হয়। ফাহমিদের মতো, শিবব্রতও আমার জন্য উপেক্ষা-অযোগ্য নিমন্ত্রক। তাকে একটা হাজারদেড়ি শব্দের রচনা দেবার কথা দিলাম। তাই এই রচনা। কিন্তু বসার পর দুইটা বিপরীতমুখী অনুভূতি হচ্ছে। এত কী লিখব এতে! আবার, যা যা আমার মাথায় কিলবিল করছে, যদি আলস্য পার করতে পারি, সব কি আর এই কয় শব্দে লিখতে পারব! দ্বিতীয় সঙ্কটে মনে হয় না শিবব্রত কিছুমাত্র বিচলিত হতেন, যদি জানতেন। কারণ তিনি শব্দসীমা দেন নাই।
সাধারণ বোধবুদ্ধির ভাবনাটা আগে দিই চলুন
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ইদানিং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলার চল হয়েছে। ‘পাবলিক’ আর ‘সরকার’ ভাষায় এরকম একাকার হয়ে যাওয়াটা বেশ চিন্তাপ্রদ। তবে এখনও সরকারি না বলার কারণে কোনো মামলা হচ্ছে বলে জানা যায়নি, তাই আজকের মতো কাজ চালানো যাবে। এতগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে যে তাতে পেট ভরে খুশি হবার বাইরে কিছু প্রশ্ন দেখা দেয়ার কথা। জরুরি। যেমন হতে পারে: এতগুলো কেন? এতগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কেন? একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যনির্মাণ, ভবনশৈলী আর চাঁতাল/ক্যাম্পাসের পরিমাণ এমনকি যে জেলা স্কুলগুলোর থেকেও ক্ষীণকায় কিংবা উপজেলা কমপ্লেক্সের তুলনায়, এতে কার কীসে উপকার হচ্ছে? এই বি.প্র.বি.গুলোর গবেষণাগার দেখে ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের গবেষণাগার লজ্জা পেয়ে যাবে না তো? আচ্ছা, এইটুক ক্যাম্পাসের ঠিক পেটের মধ্যে উপাচার্যের বাসভবনগুলো কেন বানানো হচ্ছে? যদি হলোই, উপাচার্য ক্যাম্পাসে না গিয়ে ঢাকাতে নেচেকুঁদে বেড়াচ্ছেন কেন? শিক্ষক নিবাস, শিক্ষার্থী নিবাসের হাল কী; বেহাল কেন? আমি প্রশ্ন কেবল শুরু করলাম। এই পদ্ধতিতে আপনারা প্রশ্ন সাজাতে শুরু করুন। যদি বাংলাদেশের তথাকথিত উচ্চশিক্ষার প্রতি কোনো দয়ামায়া থাকে আপনার, আপনি ১০০ প্রশ্ন বানাতে পারবেন।
কিন্তু আজকে বিশেষ দুইটা প্রশ্ন আমাদের মূল আলোচ্যের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। সেগুলোকে স্বতন্ত্র রাখি। প্রথমটা হলো, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে একটা নির্দিষ্ট এলাকাতে ইতোমধ্যেই দীর্ঘ ইতিহাসের সরকারি কলেজটার কী সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে বা কল্পনা করা হয়েছে? দ্বিতীয়টা হলো, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ অতিশয় জরুরি হলেও সরকারের তরফে এই বিস্তার সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের কারিগরি-জারিজুরি করার একটা উপায় হিসাবে দেখা চলে কিনা? আমার ধারণা দুইটা প্রশ্ন উত্থাপনের গুণেই এর সঙ্গত উত্তরের দিকে পাঠকের মনকে চালিত করে। তারপরও, জানের ভয়ে না হলেও, দ্বিতীয় বিষয় নিয়ে বেশি সময় কাটানোর দরকার নেই। বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে জাতিসংঘের নানান তৎপরতা বহু বছর ধরেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যকার টানাপড়েন-বৈষম্যকে গড়াপেটা করে চলেছেন। নয়া-নয়া বেতন কাঠামো আর লোভনীয় মোবিলিটি দিয়ে এই কাজটা করা হয়েছে। যদি আশির দশকের শুরুতে এই কাজ বিশ্বব্যাংকের ‘ফ্লাড এ্যাকশন প্ল্যান’ থেকে দানা বাঁধতে শুরু করে থাকে, তাহলে তার পরের দেড় দুই দশকে বিস্তর সব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিস্ময়ের না যে, ইউরোপে যেসব উন্নয়ন সংস্থা বাম ঘরানার বলে পরিচিত, তাদেরও স্থানীয় কার্যক্রম বিশেষ ভিন্ন কিছু ছিল না। এখনও নেই। এর সাথে যোগ হয়েছে করপোরেট সেক্টরের নানাবিধ পদবিন্যাস ও বেতন। আরও পরে, অতি সম্প্রতি, যোগ হয়েছে গবেষণার নামে রাষ্ট্র-তহবিল থেকে কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা দিয়ে শ্রেণি-কারিগরি বদলানোর চেষ্টা।
যা হোক, প্রথম জিজ্ঞাসাটা আমাদের আলোচ্য বিষয়ের জন্য কেন্দ্রীয় গুরুত্বের একেবারে।
কলোনিয়াল কলেজগুলো কই গেল?
আচ্ছা, জগন্নাথ কলেজ যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেল এটা বুঝতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে কারো কোনো? এই রূপান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি বেহাত হয়ে যাবার অভিযোগ নিয়ে, শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা না হওয়া নিয়ে, প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে, সর্বোপরি অর্থ ব্যবস্থাপনাতে সরকারের কার্যত দায়সারা একাধিক ঘোষণা নিয়ে হাজার তর্কালাপ চলতে পারে। কিন্তু, বিশালায়তন ও বিরাট ইতিহাসের এই শিক্ষায়তনটির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের যাথার্থ্য বিষয়ে কোনো সংশয়-জিজ্ঞাসা থাকার সুযোগ নেই তেমন। কিন্তু বিভিন্ন জেলা শহরে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাম্প্রতিককালে স্থাপন করা হচ্ছে, সেই স্থাপন প্রক্রিয়াতে স্বীয় স্বীয় স্থানের কলেজগুলোকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এদের ভূমিকার কোনো বোধগম্য লিপিচিত্র বানানো হয়নি। প্রায়শই এগুলোকে সরকারি কলেজ ধরে নিয়ে আমরা আলাপ করতে পারি।
লক্ষ্য করুন, প্রায় প্রতিটা জেলাতেই হয় নামজাদা, না হয় জায়গাজমিনসমৃদ্ধ, না হয় শিক্ষার্থী সংখ্যায় পুষ্ট, না হয় সবগুলো বা একাধিক বৈশিষ্ট্যেরই সরকারি কলেজ থেকে গেছে, আছে। এগুলো সবই কমবেশি ঔপনিবেশিক সময়কালে স্থাপিত এবং কমবেশি দাতব্য পদ্ধতিতে বিকশিত। সবগুলোই উত্তরকালে রাষ্ট্রীয় বিধিমালাতে অন্তরীকৃত; যাকে সরকারিকরণ বলা হয়ে থাকে। বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ হোক বা কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া, বরিশালের ব্রজমোহন হোক আর খুলনার ব্রজলাল, যশোরের মাইকেল মধুসূদন হোক আর সিলেটের মুরারিচাঁদ হোক, তালিকা করতে থাকলে এই রচনার বহু পাঠকই নামজাদা তিরিশ কলেজের একটা তালিকা বানাতে পারবেন। কয়েকজন একত্রে বসলে তালিকাটা অনায়াসে বড় হবে। আর যদি খ্যাতিতে কিছু কমতিও থাকে, বেশ বড় মাঠ ও দালানসমেত আরো কিছু কলেজ হেসে খেলে তালিকাতে রাখতে পারবেন। এগুলোর সব কারো না কারো বিশাল সম্পত্তির অংশবিশেষের দান ছিল। কিছু ক্ষেত্রে, যতই নাটকীয় শোনাক না কেন, একেবারে সর্বাত্মক সম্পূর্ণ সম্পত্তি শিক্ষার জন্য দান করার আনন্দসমেত সেই পুরুষ দেহত্যাগ করেছেন। সমাজে পিতৃতন্ত্র যেমনই বিস্তৃত হোক না কেন, ফিউডাল সমাজের সম্পত্তিধারীদের মধ্যে নারী জমিদারগণও কলেজের জন্য প্রচুর অর্পণ করে গেছিলেন। স্কুলের ক্ষেত্রেও বিষয়টা সমানুপাতিক। কিন্তু আজকের আলাপে তা টানছি না।
এই কলেজগুলোকে বিধিসম্মতভাবে, প্রক্রিয়াবদ্ধভাবে, দরকারমতো বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর না করার কী কারণ থাকতে পারে?
আমি পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিই যে, প্রথমত এসব কলেজের অনেকগুলোই তথাকথিত ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ (বা স্নাতক সম্মান ও মাস্টার্সের প্রোগ্রাম চালাতে পারে)। এটাও স্মরণ করিয়ে দিই যে ‘বিশ্ববিদ্যালয় দরকার’ ভাবনাটার দাবি যার মুখ থেকেই আসুক না কেন, এর রূপায়ক সরকার। তাহলে ইতোমধ্যেই বস্তুগত তথা লজিস্টিক প্রস্তুতি, ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তৈরি হয়েই আছে, সেগুলোকে বিবেচনায় না-আনার যথেষ্ট সঙ্গত যুক্তি দেয়া কঠিন। এসব আলাপকেও আমি কমনসেন্সিক্যাল ভাবনা হিসাবেই দেখি। কিন্তু পাছে অন্যরা তা না দেখেন, তাই সেই বর্গে চালান দিই নাই।
বেসরকারি বনাম বেসরকারি আর সরকারি বনাম সরকারি
এটা নিশ্চয়ই আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারি বলতে যেমন আগ্রহ সরকারের, ঠিক তেমনিই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রেই ‘বেসরকারি’ কথাটা ব্যবহার করা হয়। এখন এই পদপ্রয়োগটা নেহায়েত কাকতাল হলেও বেশ রূপকধর্মী। খেয়াল করলে, কোনো এক রাধেগোবিন্দ মহাবিদ্যালয় কিংবা আশিক-ই-ইলাহী কলেজ যতক্ষণ না পর্যন্ত ‘সরকারি’করণ হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্তই তা বেসরকারি। কিছুতেই দাতব্যচেতনায় স্থাপিত ওই কলেজখানা ঢাকার পেট ফুঁড়ে টাকা-হাতানো অমুক বা তমুক প্রাইভেট/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কোনো তুল্য আলোচনায় থাকতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে সেখানেই বিষয়গুলো ঠেলা হয়েছে। গ্রাহকের মনে এই এক শিক্ষালয়ের সঙ্গে ওই এক শিক্ষালয়ের তুলনা পুরে দেয়া হচ্ছে। এই তুলনাটাতে কে জয়ী হচ্ছেন বা হচ্ছেন না তা নির্ধারণেরই কোনো সুযোগ নাই। কারণ এটা শুরুতেই হেরে-থাকা একটা লড়াই। ওদিকে আশি-একশ-দেড়শ বছরের পুরান সরকারি কলেজটা আচমকা এক সকালে উঠে একটা ‘সরকারি’ ঘোষণার মধ্যে নিজের অস্তিত্ব আবিষ্কার করার লড়াইয়ে শামিল হয় – ‘বর্তমান সরকারের সাফল্যের জোয়ার বজায় রাখতে অমুকের নামে আরও একখানা বিশ্ববিদ্যালয় হবে’ (বা হয়তো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)। এই মর্যাদা লড়াইয়ে কলেজগুলোকে নামানো অপ্রয়োজনীয় তো বটেই, নাহক এবং অহেতু।
এর বাইরে অজস্র বিষয় আছে – জমি অধিগ্রহণ, ভবনের অপ্রতুলতা, সেই অপ্রতুল ভবন নির্মাণেই ঠিকাদারির লড়াই (লোকে বলেন), আবাসন সঙ্কট, ক্যাম্পাসের আয়তনের সংকুচিত দশা ইত্যাদি। আগেও খানিকটা লিখেছিলাম। তবে এখানে এগুলো নিয়ে বিশদ করে খেইহারা হতে চাই না। খোদ রাষ্ট্রতরফে লাগাতার জমি অধিগ্রহণের বিষয়েই আমি অত সন্তুষ্ট ধরনের লোক নই। তা সে শিক্ষালয় বানানো হোক বা সঙ্গীতালয়; কিংবা যতই ভয়ে ভয়ে উচ্চারণ করি না কেন সামরিকালয়। একটার সাপেক্ষে আরেকটার গুণমান নিয়ে আলাপ হতে পারে। কিন্তু অধিগ্রহণ অধিগ্রহণই, দখলই এর নাম। যা হোক, আপাতত এই পর্বে আরেকটা মাত্র বিষয় মনে করিয়ে দিই। সরকারি কলেজগুলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছিল একটা সময়ে। তার আগে ঢাকা রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বিন্যাস/নেটওয়ার্ক ছিল। এই উদ্যোগ বা রূপান্তরের বিপক্ষে আমি নই, কিন্তু আন্তরিকতা ও দক্ষতার প্রসঙ্গ ছাড়া এই রূপান্তরের দিকে দৃকপাত সম্ভব নয়। এর মধ্যে দক্ষতার অভাব খানিকটা লক্ষণে প্রকাশিত হয়; আন্তরিকতার অভাব বা বদনিয়ত প্রমাণ করা ততটাই কঠিন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অনেক কিছু মেরামতি না করে, একের পর এক লোভী প্রশাসকের কাছে প্রতিষ্ঠানটিকে ঠিকাদারির মতো জিম্মায় রেখে কলেজগুলোকে ‘সমন্বিত’ করার বদলে ঘটেছে ‘ডাম্পিং’ – বাংলায় বললে ভাগাড়ে নিক্ষেপ। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ও দরিদ্রবান্ধব একটা শিক্ষাদান পাটাতনকে (শমসের আলীকে স্মরণ করি) অঙ্কুরে বিনষ্ট করার সকল উদ্যোগও কাছাকাছি সময়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু, আসলেই বদনিয়ত প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এখন উল্লেখ করলাম এই জন্য যে, উচ্চশিক্ষার পাবলিক কেন্দ্রগুলোকে নিয়ে কোনো কিছু বোঝাবুঝি করতে গেলে, আমার বিবেচনায়, এটুকু একদম মৌলিক।
সাংঘর্ষিক সাংস্কৃতিক জমিন/কালচারাল লোকেশন হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়
আমার সম্পাদক বান্ধব যদি এরপর আমাকে আর কোনোদিন রচনা লেখার দায়িত্ব না দেন, তাকে আমি দোষ দিতে পারব না। যে লোক আলস্যজনিত কারণে দেড় হাজার শব্দে রফা করে লিখতে বসে দেড় হাজার শব্দ লাগিয়ে দেয় মূল প্রস্তাবনায় আসতেই, তাকে বে-আক্কেল এবং বে-আন্দাজ দুই-ই সাব্যস্ত করা চলে। কিন্তু কিছুতেই ওই পাটাতনমূলক লেখাটুকু ছাড়া এইখানে আমি আসতে পারছিলাম না।
নোয়াখালী (বি.প্র.) বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ত্রিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাককানইবি; এই সংক্ষেপনগুলোতে না ঘাবড়ানোই ভালো, এভাবেই সরকার প্রণয়ন করেছেন) আমি সশরীর গেছি, টাঙ্গাইল (মাভাবিপ্রবি) কিংবা শাহজাদপুর (রবি) হয়তো যাইনি, দিনাজপুরের হাজী দানেশে বা পাবনাতে (পাবিপ্রবি) হয়তো গেছি, রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো যাইনি, কিন্তু সঙ্কটের একটা প্রণালী চিনতে সবগুলোতেই যাবার দরকার নেই। কেন সিলেট কিংবা খুলনার তুলনায় টাঙ্গাইল বা নোয়াখালীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশি উৎকণ্ঠার জন্ম দিতে পারে তা ঠিকমতো বুঝবার জন্য আমাদের নগরের গঠনপ্রণালীর দিকে নজর দিতে হবে। যেসব শহরে ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার কারণে কিংবা শিল্প-কলকারখানার কারণে অধিকতর ‘মেট্রোপলিস’ চেহারা তৈরি হয়েছে, সেখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিষ্ঠান কিছুতেই অপেক্ষাকৃত সনাতনী মফস্বলে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিষ্ঠানের অনুরূপ নয়। তুলনামূলক সনাতনী মফস্বলে যখন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় আচমকা, এবং পুরান কলেজটার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো সমন্বয় ছাড়াই, তখন উদোর পিণ্ডি চাপানোর অনুভূতি স্থানীয়দের মনে দেখা দিতে পারে। বিশেষত গাদা গাদা অহংকারী চাকুরিজীবী যখন উৎকৃষ্ট (তুলনামূলক) বেতনকাঠামোতে সম্পৃক্ত হয়ে আসেন, স্থানীয় তৎপরতার সাথে গুরুতর বিযুক্ত থাকেন। সেটা মূল শহর থেকে যতই দূরে করা হোক না কেন, নানান ধরনের চালিয়াতিমূলক একটা ব্যবস্থার মধ্যে উৎকণ্ঠার বীজ বপন করেই শুরু হয়।
আমাদের শুরুতে একটা আলোচ্য তুলনা ছিল রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগরের সাংস্কৃতিক চৈতন্য নিয়ে। উৎপত্তির দিক থেকে এদের গুরুতর বয়সের পার্থক্য নেই তা সত্য। ১৬-১৭ বছরই মাত্র। কিন্তু এর গঠনগত চেতনা ছিল আকাশ-পাতাল তফাতের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বেশ আগে ভারত ভাগ হলেও এই নগরীর ‘প্রগতিবাদী’ মানুষজন অনায়াসেই কলকাতাকে তখনও মানদণ্ড হিসাবে ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন। দুই বাংলার পাল্লাপাল্লির স্মারক যেমনটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হতে হয়েছে, সেই চাপ রাজশাহীর ছিল না। অন্যদিকে, ঢাকা মহানগরের অদূরে পাকিস্তানি শাসক একটা মডেল আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে চেয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগরের মাধ্যমে, শিক্ষার্থীদের ‘আধুনিক’ আবাসন সুবিধাদি দিয়ে। পরিকল্পনার অব্যবহিত পরেই স্বাধীনতা যুদ্ধ না-বেঁধে গেলে সেই উদ্দেশ্য সাধনও হতো হয়তো। অনেকেই মনে করেন যে অপেক্ষাকৃত ‘উচ্চবর্গীয়’ সরকারি কর্মকর্তা ও শিল্পপতিদের বাচ্চাকাচ্চার পড়ার জায়গা হিসাবে জাহাঙ্গীরনগরকে কল্পনা করা হয়েছিল। তাহলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনসেপশন’ যদি হয় মহানগরের গৌরববাচক একটা উচ্চ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিষ্ঠান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনসেপশন’ ছিল মহানগরের কোলাহল থেকে ভদ্রাত্মাকে দূরে রাখন। উত্তরকালে যা যা বদলই হোক না কেন, রাজশাহী শহরের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত দূরত্ব আর জাহাঙ্গীরনগরের সাথে রাজধানী ঢাকার ভৌত দূরত্ব ঠিক সংখ্যাবিচারে বোধগম্য নয়। অন্তত যানজট আর সফরের ব্যবস্থা হিসাবেও।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকেই এই মহানগরের ‘অগ্রসর’গণ এটাকে ধারণ করেছেন। এখন অবধি ক্যাম্পাস ও শহরের মধ্যকার আদান-প্রদান নিবিড় ও দৃষ্টিগ্রাহ্য। এই বাস্তবতা এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও খাটে না। কেউ চাইলে ভৌত দূরত্বকেও কারণ বলতে পারবেন। সারাংশে, ভিন্ন ভিন্ন ক্যাম্পাসে ভিন্ন ধরনের তৎপরতা ও সংহতি তৈরি হবার পটভূমিক কারণগুলোকে আমি মনোযোগ দিয়ে দেখার পক্ষে। অমুক জায়গায় যেটা সম্ভব, তমুক জায়গায় তার অবিকল অসম্ভব হতে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার সদস্যদের সম্ভাব্যতার খতিয়ান করার সময়ে গাঠনিক পটভূমি বিষয়ে গভীরভাবে ভাবা দরকার। কেবল প্রশাসনিক কর্তাদের প্রজ্ঞা (বা তার অভাব), [অ]দূরদর্শিতা আর শিক্ষার্থী সংগঠকদের মরিয়া কর্মকাণ্ডই নিয়ামক নয়।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক