‘জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের কেউ বিয়ে করতে চায় না’ এমন একটি বক্তব্য দিয়ে সম্প্রতি আলোচনায় এসেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) ভিসি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) নারী শিক্ষার্থীদের তথা নারীর প্রতি অত্যন্ত অবমাননাকর এই বক্তব্যটির কারণে অনেকেই ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন, ট্রল করছেন, ভিসির পদত্যাগ চাইছেন; কিন্তু মোদ্দা কথা হলো- জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের নিয়ে শাবি ভিসিই প্রথম এই মন্তব্য করলেন বিষয়টি তা নয়।
জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রী অথচ এই মন্তব্যটি শোনেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে। আমিও শুনেছি এবং ব্যক্তিজীবনে এর প্রভাব ও বিড়ম্বনা দুই-ই নানাভাবে মোকাবিলা করেছি। এই তো সেদিনও পিএইচডিধারী একজন বললেন, ‘মেয়েকে জাবিতে দিলাম না। লোকজন যা সব বলে তোমাদের জাবিকে নিয়ে! শেষমেশ প্রাইভেটে দিলাম।’
কেউ কারো ছেলে বা মেয়েকে জাবিতে পড়াবেন, নাকি মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে পড়াবেন- সেটা একান্তই তার পারিবারিক সিদ্ধান্ত, কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নানান কথা প্রচলিত আছে এবং সে কারণে সেখানে মেয়েকে পড়তে পাঠালেন না- এমন মন্তব্য নিঃসন্দেহে অবমাননাকর এবং তা চুপচাপ শুনে যাওয়া অসম্ভব।
কথায় কথা বাড়ে, শেষতক তিনি প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘কই অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তো কথা হয় না। তোমাদের জাহাঙ্গীরনগরকে নিয়েই কেন এত কথা হয়?’
একভাবে আমি একটি প্রশ্ন আবার একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত একটি ডিসকোর্সের মুখোমুখি হলাম। শাবি ভিসিও আমাদেরকে সেই ডিসকোর্সের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন আরেকবার।
জাহাঙ্গীরনগরের নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রচলিত এই ডিসকোর্সটি বিশ্লেষণ করলে প্রথমেই আসে একটি সময়ের কথা।
অনেকেরই হয়তো জানা আছে যে, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে জাবিতে তৎকালীন সরকারি দলের আশীর্বাদপুষ্ট কিছু ছাত্রনেতার ‘ধর্ষণের সেঞ্চুরি’ উদযাপনের কথা। এই খবর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন এমন মানুষজনের মধ্যে বিস্তৃত হওয়ার পর উৎকণ্ঠিতরা মনে করতে থাকলেন জাহাঙ্গীরনগরে মেয়েরা নিরাপদ নন। সেখানে মেয়েরা গেলেই ধর্ষণের শিকার হন অথবা যারা আছেন তারা সবাই ইতোমধ্যে ধর্ষণের মুখোমুখি হয়েছেন।
উৎকণ্ঠিতদের কেউ কেউ ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। তারা জাহাঙ্গীরনগরকে মন ও মগজ থেকে আলাদা করে ফেলতে চাইলেন। মেয়েদেরকে সেখানে পড়তে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, কিছু পরিবার পুত্রবধূ হিসেবেও জাবির মেয়েদেরকে নামঞ্জুর করলেন। কথিত আছে যে, সেসময় পত্রপত্রিকায় পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করে দেয়া হতো, ‘জাহাঙ্গীরনগরের মেয়ে ব্যতিত।’
‘জাহাঙ্গীরনগরের মেয়ে ব্যতিত’ পাত্রী খোঁজা বা জাহাঙ্গীরনগরে মেয়েদেরকে পড়তে না পাঠানোর মানে জাহাঙ্গীরনগর বাদ, কালো তালিকাভুক্ত বা অচ্ছুৎ।
খেয়াল করলে দেখা যাবে এই এক্সক্লুশন ধারণার মূলে রয়েছে ‘সতীত্ব’র ধারণা। জাহাঙ্গীরনগরের মেয়ে এবং তাদের ‘সতীত্ব’ প্রশ্নবোধক। দুই কারণে: এক. তারা ধর্ষিত হয়ে থাকতে পারেন, দুই. তারা রাতবিরাতে চলাচল করেন। স্বাধীনভবে ঘোরাঘুরি করার কারণে তাদের স্বভাব চরিত্র ‘ঠিক নয়’। কেননা রাতবিরাতে ‘ভালো মেয়েরা’ ঘোরাঘুরি করেন না জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েরা করেন, সুতরাং তারা খারাপ।
এর ফলে জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের সামাজিকভাবে বয়কটের ডিসকোর্স তৈরি হয়। এখানে লক্ষণীয়, জাহাঙ্গীরনগরে ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক বয়কটের ডিসকোর্স শাস্তির আওতায় নিয়ে এসেছে নারীকেই। কারণ লোকের চাই অক্ষত যোনি। ধর্ষণ যদিও বলপ্রয়োগের ঘটনা, তবু মেয়েরাই এর শাস্তি পাবেন এবং তারা বিয়ের বাজারে ‘অযোগ্য’ ঘোষিত হবেন?
বাংলাদেশি অভিভাবকদের কন্যাসন্তান লালনপালনের একটা বড় উদ্দেশ্য হলো তাদেরকে ‘সুকন্যা’ হিসেবে গড়ে তোলা এবং ‘সুপাত্রস্থ’ করা। শাবি ভিসিসহ উৎকণ্ঠিত অভিভাবককুল এই ধারারই অংশ। প্রায় সবাই চান তাদের কন্যাকে ‘সু’ করে গড়ে তুলতে এবং সেজন্য চান সব ধরনের ‘কলঙ্ক’ থেকে মুক্ত রাখতে।
এ জন্য তারা চেষ্টার কমতি রাখেন না। বাংলাদেশে ‘সুকন্যা’ গড়ে তোলার জন্য একজন মেয়েকে ‘সুশীল’ বা ‘উত্তম’ কিছু গুণাবলি আয়ত্ত করার দিকে শৈশব থেকেই শিক্ষা দেয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘সতীত্ব’ ধারণাকে মনেপ্রাণে ধারণ করা এবং ‘সতীত্ব’ রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া; স্বামী, সংসার এবং সন্তান এই তিনের আবর্তে নিজের চাহিদা ও ইচ্ছাকে তৈরি করা; এবং প্রয়োজনে পরিবার ও সমাজের চাহিদা পূরণে নিজের ইচ্ছা ও চাহিদাকে বিসর্জন দেয়া।
পারিবারিক ও সামাজিক এই গাইডলাইনের সঙ্গে জড়িত থাকে পারিবারিক ও সামাজিক মানসম্মান। কেননা ধরে নেয়া হয়, ‘ভালো পরিবারের’ মেয়েরা কখনও নির্ধারিত গাইড লাইনের বাইরে যান না।
অথচ জাবির মানিক ও তার গং-কে জাবির ছাত্রীছাত্ররা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করেছেন। আমাদের সময়ে আমরা অসংখ্য সাধারণ ছাত্রী ধর্ষক আনিসবিরোধী আন্দোলন করেছি। ক্লাস, পরীক্ষা উপেক্ষা করে মাঠে-ময়দানে মিছিল করেছি।
শুধু মানিক বা আনিসবিরোধী আন্দোলনই নয়, শিক্ষার্থীদের অধিকার ও দাবি আদায়ের যেকোনো যৌক্তিক ইস্যুতে জাবির শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারতেন। মুক্ত ক্যাম্পাসে সবার পদচারণা নিশ্চিত করার কথা ভাবতে পারতেন। ফলে দ্বিতীয় সান্ধ্য আইনবিরোধী আন্দোলন করেছি আমরা।
হুমায়ুন আজাদ যেদিন ঘাতকের আক্রমণের শিকার হন সেদিন প্রীতিলতা হল থেকে আমরা ছাত্রীরা প্রথম মিছিল নিয়ে সব ছাত্রী হল প্রদক্ষিণ করে ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরাই প্রথম সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়নের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন। এমনকি তৎকালীন ভিসির বিরুদ্ধেও তারা অবস্থান নিয়েছিলেন।
জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে ছাত্রীদের এই যে অন্য একটি পরিচয়, প্রতিবাদী চেতনা বা মানসিকতাকে ঘিরে অলটারনেটিভ বা বিকল্প ডিসকোর্সের খোঁজ উৎকণ্ঠিত জনতা রাখেনি। জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের অন্যায় মোকাবিলা করার সাহসের প্রশংসা তারা করেনি। শুধু জাহাঙ্গীরনগরকেন্দ্রিক নয়, আরও সব সামাজিক-রাষ্ট্রীয় অন্যায়ে জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রীছাত্রদের বলিষ্ঠ অবস্থান এই জনতা দেখতে পায়নি, হৃদয়ঙ্গমও করেনি।
কারণ, তারা জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের এই চেহারাকে আদতে বুঝতেই পারেনি। তাদের দেখার যে চোখ তা কেবল মেয়েদের নির্যাতিত, নিপীড়িত হিসেবে দেখেই অভ্যস্ত। মেয়েদের চোখে চোখ রেখে কথা বলা বা মেরুদণ্ড সোজা করে চলার এই ইতিহাস বুঝতে গেলে যে বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা দরকার তা তাদের অনুপস্থিত। তারা কেবল জানে, মেয়েরা ‘নষ্ট’ হয়, ‘সতীত্ব’ হারায়। যেন মেয়েরা কেবল একটি যোনি!
রাজা যায় রাজা আসে, রানিরাও আসে যায়। জাহাঙ্গীরনগরের মাটি থেকে মানিক বিতাড়িত হয়, আনিস বিতাড়িত হয়, তবু জাবির মেয়েদের ‘চরিত্র’ মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
নারীর পরিচয়কে কোনো একটি নেতিবাচক লেবেলিং করা মূলত হীনতর পুরুষতান্ত্রিক প্রচেষ্টা। পতিতা, অসতী, নষ্টা- পরিচয়ও সেই নেতিবাচকতার অংশ। আজকের সমাজ, রাষ্ট্র, তার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ভিসি সেই হিসেবে আর কতদূর ভাববেন?
সময় বদলেছে, অথচ জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের গায়ে এখনও চাপিয়ে দেয়া হয় সেই নেতিবাচক লেবেল বা পরিচয়; এই পরিচয় উপেক্ষা করে জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। যে পরিচয় আমলে নেয় না, অনুধাবন করে না- জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের অধিকার আদায়ের ইতিহাস, বুক চিতিয়ে যৌক্তিক ইস্যুতে যূথবদ্ধ হওয়ার ইতিহাস।
এক ও একমাত্র ‘সতীত্ব’র ধারণাকে কেন্দ্র করে জাহাঙ্গীরনগরের নারী শিক্ষার্থীদের আলাদা করে দেখতে চাওয়ার যে এক্সক্লুশনারি ডিসকোর্স, সামাজিক বয়কটের দৃষ্টিভঙ্গি জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েরা সেই অবস্থানকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন, কেননা জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েরা জানেন কীভাবে আবর্জনা পায়ে দলে যৌথতার পথকে মসৃণ করে তুলতে হয়। আমি সেই যূথবদ্ধ মেয়েদের একজন, এ জন্য আমি গর্বিত।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক