বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সেবার সঙ্গে মিতালি ও কাজীদার সান্নিধ্য

  • শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া   
  • ২২ জানুয়ারি, ২০২২ ১৮:২৪

মানুষের জীবন আলো-আঁধারিতে ভরা। কাজীদা’র মধ্যে আঁধার বলে কিছু ছিল কি না, জানি না। সেটা তো দেখিনি কখনও। তবে যে আলোটুকু দেখেছি, তা ছিল পুরোটাই মাধুর্যে ভরা। প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। তার কথাবার্তা-চালচলনে ছিল অনুকরণীয় পরিমিতি বোধ।

তখন টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে পড়ি। অষ্টম শ্রেণিতে জাহাঙ্গীর নামের এক জ্যেঠা সহপাঠী পেলাম। জ্যেঠা বলছি এ কারণে যে, জাহাঙ্গীর আমার এক ক্লাস ওপরে ছিল। পরীক্ষা দেয়নি বা পাস করেনি- এমন কোনো কারণে অষ্টম শ্রেণিতেই থেকে যায়। ওরে-ব্বাস, বিরাট এক কবি! কী সব লেখে, এক বর্ণও বুঝতে পারি না। স্থানীয় পত্রিকায় আবার ছাপাও হয়। মোটামুটি একটা ধারণা হয়ে গেল, ভবিষ্যতে একজন রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের মতো কবি পেতে যাচ্ছি। আর কিছু না হলেও জীবনানন্দ তো বটেই। প্রচুর বই পড়ত সে। আর আমাকে বিস্তর জ্ঞান দিত। ওস্তাদ কিসিমের পোংটা।

ওই সময় ‘দস্যু বনহুর’ গোগ্রাসে গিলতাম। সিরিজের পরবর্তী বইয়ের জন্য একটা বইয়ের দোকানে দুই-চার টাকা আগাম পর্যন্ত দিয়ে আসতাম। ভাবলাম, জাহাঙ্গীর ওস্তাদ যত বই-ই পড়ুক, নিশ্চয়ই দস্যু বনহুরের খবর জানে না। একদিন টিফিন পিরিয়ডে বেশ গর্বভরে দস্যু বনহুরের গপ্পো ঝাড়তে গেলাম, জাহাঙ্গীর ঠোঁট বাঁকিয়ে অবলীলায় বলল, ‘ও, দস্যু বনহুর! এইটা তো ফোর-ফাইভের পোলাপান পড়ে! আমি পড়ি মাসুদ রানা! একবার পড়লে বুঝবি।’দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ মাসুদ রানার সঙ্গে আমার পরিচয় এভাবেই। সিরিজের খ্যাতিমান লেখক কাজী আনোয়ার সম্পর্কে জানাও শুরু এখান থেকে। তবে জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে মাসুদ রানা নিতে পারিনি। পাছে গায়েব করে দিই, এই ভয়ে দেয়নি। তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল ওর।

‘বাংলাঘর’ নামে একটা ঘর ছিল আমাদের। সেখানে বড় মামার বড় ছেলে থাকতেন। ছাত্ররাজনীতি করতেন। অনেক রাতে ফিরতেন তিনি। সকাল ১০টা-১১টা পর্যন্ত ঘুমাতেন। সকালে একদিন গিয়ে দেখি যে টেবিলের ওপর একটা অন্যরকম বই। মলাটে লেখা- মাসুদ রানা। লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন। বুকের রক্ত ছলকে উঠল- আরে, এ তো সেই গুপ্তধন! কিন্তু বইটা হাতে নিতে গিয়ে জমে যাই।

লেখা আছে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। তখনও ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ কথার মানেটা পুরোপুরি বুঝি না। কেবল বুঝি যে এটা এক ভয়ংকর বয়স, যার ধারেকাছে ছোটদের থাকতে নেই। কিন্তু মাসুদ রানার দুর্নিবার টান এড়াতে পারি না। কখন যে বইটা তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করেছি, টেরই পাইনি। তারপর মামাতো ভাই খুক্ করে একটু কাশি দিতেই বই ফেলে ভোঁ দৌড়! কিন্তু ততক্ষণে যতটুকু মজার মজে গিয়েছি। মনের ভেতর প্রবল আলোড়ন- এই বই পড়তেই হবে। না পড়ে শান্তি নেই।

জাহাঙ্গীরের মাধ্যমেই মাসুদ রানা পাওয়ার উপায় জুটল। এক বইয়ের দোকানে আগাম টাকা দিলে ঢাকা থেকে এনে দেয়। টাকা দিয়ে প্রবল উত্তেজনা নিয়ে দিন গোনা- কখন আসে মাসুদ রানা! দোকানি আজ যাব কাল যাব করে অপেক্ষায় রাখেন। তিনি তো আর শুধু একটা-দুটো বইয়ের জন্য যাবেন না। একসঙ্গে নানা ধরনের বই আনবেন। তারপর একদিন বাসে করে আসত মাসুদ রানা। দোকানি বইটাকে পুরোনো খবরের কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে এমনভাবে হাতে তুলে দিতেন, যেন নিষিদ্ধ কোনো মাদক তুলে দেয়া হচ্ছে! তখন মাসুদ রানার কাভারে এমন কিছু থাকত, যা বালক বা কিশোরের হাতে মানাত না।তো, এভাবে শুরু হলো মাসুদ রাানার প্রতি আকর্ষণ ও নেশা। পরে একটা লাইব্রেরি যখন নিয়মিত সেবার বই আনতে শুরু করল, এই প্রকাশনীর অন্যান্য বইয়ের প্রতিও আকৃষ্ট হলাম। বিশেষ করে জুলভার্নের বইয়ের অনুবাদগুলো। এক কথায় অসাধারণ! একপর্যায়ে দেখা গেল, শুধু সেবার বই-ই পড়ছি, আর কিছু পড়ি না। দুনিয়া সম্পর্কে জানা, দেখা ও বোঝার মতো অনেক কিছু রয়েছে সেবার বইগুলোতে। এটাই হচ্ছে এসব বইয়ের মূল কারিশমা। আরও রয়েছে ভাষার ব্যবহার, শব্দ চয়ন ও প্রয়োগ এবং নির্ভুল বানান শেখার বিষয়।

সেবার বই পড়তে পড়তেই একটা সময় রহস্য-রোমাঞ্চ নিয়ে লেখার অদম্য ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আরও বড় হয়ে কাটা-ছেঁড়া করতে করতে একটা রোমাঞ্চ-উপন্যাস লিখেও ফেলি। নাম দিই ‘অদৃশ্য ফাঁদ’। পাণ্ডুলিপি কাজীদা বরাবর পাঠিয়ে দিন গুনতে থাকি- কী আসে জবাব। কিন্তু দিনের পর দিন পেরিয়ে যায়, কোনো উত্তর আসে না। নানা ভাবনা দোল খায় মাথায়।

তিনি যে ব্যস্ত মানুষ, এসব ছাতামাথা স্ক্রিপ্ট দেখার সময় আছে কি তাঁর? এরপরও সফট রিমাইন্ডার দিয়ে চিঠি লিখি। মাস তিনেক পর এক দুপুরে সেবা প্রকাশনীর সিল মারা একটি হলুদ খাম এল। সেটা খুলে চোখের পলক পড়ে না। কাজীদার নিজস্ব প্যাডে স্বহস্তে লেখা চিঠি। ওতে ‘জনাব শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া’ বলে সম্বোধন করা। লেখা হয়েছে, আমার কাহিনিটি কাঁচা, ভাষায় ভুল, বানানে ভুল; তবে আমাকে দিয়ে হবে, কারণ লেখার ভঙ্গি ভালো।এই চিঠি আমাকে জাদু করল। লেখায় লেগে রইলাম। হাল ছাড়লাম না। ধৈর্য ধরে সারাতে লাগলাম লেখার ত্রুটিগুলো। তারপর একদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে রহস্য পত্রিকায় আমার একটি ভৌতিক গল্প ছাপা হলো। শিগগিরই সেবার ছোটদের মাসিক সাময়িকী কিশোর পত্রিকায় একটি বড় গল্প উপন্যাস আকারে গেল। তারপর আমাকে আর পায় কে? দুহাতে লিখে চললাম সেবার দুই পত্রিকায়। দুটোতে আমার গল্প, উপন্যাস, ফিচার ছাপা হতেই থাকল। রহস্য পত্রিকার দুই সহকারী সম্পাদক সেবার শীর্ষস্থানীয় লেখক শেখ আবদুল হাকিম ও রকিব হাসানের সঙ্গে পরিচয় হলো। ঘনিষ্ঠতা হলো।

হৃদ্য গড়ে উঠল কাজীদার বড় ছেলে কাজী শাহনূর হোসেন টিংকুর সঙ্গে। ছুটির দিন বাদে রোজ সন্ধ্যায় রহস্য পত্রিকার অফিস হতো। সেখানে চুটিয়ে আড্ডা জমাতেন সেবার লেখকেরা। সে আড্ডায় প্রায়ই যোগ দিতাম। বেশির ভাগ দিন হাকিম ভাই চা আনাতেন। চা খেতে খেতে খেতে নানা বিষয়ে গল্প হতো। সেসব মধুর স্মৃতি কখনও ভোলার নয়। ওই সময় রহস্য পত্রিকা ও কিশোর পত্রিকায় স্বনামে-বেনামে আমার অনেক লেখা ছাপা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে কিশোর পত্রিকায় আমার সাক্ষাৎকারও ছাপা হয়। আসজাদুল কিবরিয়া নিয়েছিলেন সেই সাক্ষাৎকার।সেবার অঙ্গ প্রতিষ্ঠান প্রজাপতি প্রকাশন থেকে আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। রহস্য পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি গল্পের সংকলন ছিল সেটি। নাম ‘তান্ত্রিকের মূর্তি’। এর কিছুদিন পরই প্রজাপতি থেকে ‘অশুভ শক্তি’ নামে আমার একটি সায়েন্স ফিকশন প্রকাশিত হয়। তখনও কাজীদার সঙ্গে আমার পরিচয় বা সাক্ষাৎ হয়নি।একদিন রহস্য পত্রিকার সান্ধ্য আড্ডায় লোকজন কম। একপর্যায়ে দেখা গেল হাকিম ভাই, মহিউদ্দিন ভাই আর আমি আছি। এ সময় ক্যাজুয়াল পোশাকে সৌম্যকান্তি এক ব্যক্তি এলেন। দেখেই বুঝলাম তিনি কে। হাকিম ভাইয়ের সঙ্গে রহস্য পত্রিকা কিছু বিষয় নিয়ে দু-চার মিনিট কথা বলে বেরিয়ে গেলেন। তার পিছু পিছু হাকিম ভাইও গেলেন। শিগগিরই ফিরে এলেন দুজন। কাজীদা তার হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘দেখেন কী কাণ্ড! সেবা থেকে আপনার দুটো বই বেরিয়েছে, অথচ আপনাকে আমি চিনি না!’বুঝলাম হাকিম ভাই আমার কথা বলেছেন তাঁকে। কাজীদার সঙ্গে সেটাই প্রথম সাক্ষাৎ। তিনি বসলেন না। হাসিমুখে খানিকক্ষণ কথা বলে চলে গেলেন। এর পর আরও বেশ কয়েকবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে তার সঙ্গে। কিশোর তারকালোকে কাজ করার সময় তার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। সেবা থেকে আমার একটা রোমান্টিক উপন্যাস বের হয়। নাম ‘তোমার আকাশ নীলে’। ওই সময় বড় ধরনের লেখার বিষয়ে সূক্ষ্ম কিছু কলাকৌশল শিখতে পারি তার কাছে। এভাবে আরও বহু দিন সেবার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলাম।তারপর সময়ের বিবর্তনে বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে সেবায় যাতায়াত কমে গেছে। তাই বলে সেবার সঙ্গে কখনও মনোবিচ্ছেদ ঘটেনি। সেবার সেই মধুর সান্ধ্য আড্ডা এখনও আছে কি না, জানি না। হয়তো আছে। মান্না দের সেই ‘কফি হাউসের আড্ডা’র মতো হয়তো নতুন নতুন মুখ এসে জুটেছে। অনেক দিন যাওয়া হয় না। তাই জানি না কিছু।

আমাদের প্রবাদপুরুষ কাজীদা চলে যাওয়ায় বেদনার্ত হয়েছি, তবে অবাক হইনি। তিনি যেকোনো দিন চলে যাবেন, এমন একটা মানসিক প্রস্তুতি ছিল। বয়স তো আর কম হয়নি। তবে তিনি এই অধমের স্মৃতিপটে থাকবেন আজীবন। মানুষের জীবন আলো-আঁধারিতে ভরা। কাজীদা’র মধ্যে আঁধার বলে কিছু ছিল কি না, জানি না। সেটা তো দেখিনি কখনও। তবে যে আলোটুকু দেখেছি, তা ছিল পুরোটাই মাধুর্যে ভরা। প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। তার কথাবার্তা-চালচলনে ছিল অনুকরণীয় পরিমিতি বোধ। কথা বলতে বলতে কখনও ভরাট কণ্ঠে গেয়ে উঠতেন। আবার স্বচ্ছন্দে ফিরে আসতেন মূল প্রসঙ্গে। কথা মেপে বললেও তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী। এমন মানুষ সত্যিই বিরল।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর