বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

টিএসসির অনুষ্ঠানে হামলা ও সাংস্কৃতিক দায়

  • দীপংকর গৌতম   
  • ১৪ জানুয়ারি, ২০২২ ১৯:২৩

একসময় মিছিল-সমাবেশে হামলা হতো, এখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলা; এটা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। স্বাধীনতার পক্ষের সরকারের আমলে সংস্কৃতিচর্চায় বাধা আাসা কাঙ্ক্ষিত নয়।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কাওয়ালি সংগীত অনুষ্ঠানে হামলা হয়েছে। কেন হামলা হয়েছে তার কারণও স্পষ্ট নয়। তবে হামলার অভিযোগ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ আসার পরে এই সংগঠনটি সাংগঠনিক কাজের চেয়ে অসাংগঠনিক কাজে বেশি মনোযোগ দেয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু সবার প্রশ্ন একটাই কেন এই হামলা? কাওয়ালরা সাধারণত সুফিবাদী ধারার সঙ্গে যুক্ত। এই সুফিবাদীদের বিরোধীরা বিভিন্ন সময়ে কাওয়ালদের ওপর হামলা করেছে। ভারত উপমহাদেশের একটি জনপ্রিয় সংগীতধারা।

বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান― তিন দেশেই এ সংগীত প্রচলিত। কাওয়ালদের সঙ্গে উগ্রবাদীদের কোনো সংশ্লিষ্টতার থবর পাওয়া যায়নি। কাওয়ালরা সাম্প্রদায়িকও নন। তারা উদার ও সহজিয়া ধারার গায়ক। তাছাড়া এখানে মুর্শিদি-ভাণ্ডারি গানও হওয়ার কথা ছিল। মুর্শিদি-ভাণ্ডারি সংগীত উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে যায় না। দুটির অবস্থান পরস্পর বিপরীত ধারায়। ইসলামের সুফিধারার সঙ্গে যাদের বিরোধ এই হামলা তারা করতে পারে। ২০১৬ সালে পাকিস্তানের করাচিতে বিশ্বখ্যাত কাওয়াল আমজাদ সাবরিকে যারা হত্যা করে সেই হত্যার দায় স্বীকার করেছিল পাকিস্তানি তালেবান। তদন্তে এর সঙ্গে লস্কর-ই-ঝাংভির সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এই সংগঠনের দুজন সদস্যকে বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০১৮ সালে। তারা স্বীকার করে যে, তারা সাবরিকে হত্যা করেছে।

বাংলাদেশে এই ধারার সমর্থক আছে। তারা এই হামলা চালিয়েছে বলে এখন পর্যন্ত কেউ বলেনি। তাহলে এই হামলার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের সঙ্গে কাওয়ালদের মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। তাহলে কাওয়ালি গানের ওপর বিদ্বেষ নাকি কারো ঘরে কেউ আগুন দিয়ে খই ভেজেছে? ঘটনার অন্তরালে চাঁদাবাজির দ্বন্দ বলে শোনা গেছে। আসলে কি তাই? তার মানে আন্তদলীয় কোন্দলে এই সংস্কৃতির ওপর হামলা হবে কোন যুক্তিতে?

১৯৭১ সালে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। সেসময় পাকিস্তানিদের কর্মকাণ্ডে নারকীয়তার কথা ভাবলে আজও আমরা শিউরে উঠি। পাকিস্তানিদের উপরে তাই বাঙালিদের বিরূপ মনোভাব কোনোকালে মোছার নয়। এ ক্ষত আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি যুগ যুগ ধরে। আরও কত বছর বয়ে বেড়াতে হবে তা জানে না কেউ। তার মানে এই নয় যে, উর্দু ভাষার সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ আছে।

কাওয়ালি উর্দুতে গীত হয় সেটা কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। পৃথিবীর সব ভাষারই যা কিছু লালিত্য, যা কিছু চিত্ররূপময়― সবই সংস্কৃতির স্বরূপের এক একটি বিন্যাস। আমরা এখনও মেহেদী হাসান, নূরজাহানের গানে বিমোহিত হই। সুরাইয়া মুলতানীকর, সালমার উর্দু গানে আমরা প্রাণের উচ্ছ্বাস খুঁজে নিই। বাংলাদেশের শিল্পী রুনা লায়লা অথবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আলমগীরের উর্দু গান শুনতে সবাই আগ্রহী।

সাদত হাসান মান্টো, ইসমত চুগতাই, কৃষণ চন্দর, আল্লামা ইকবালসহ খ্যাতিমান লেখকদের লেখা পাঠ করে ঋদ্ধ হই। পাকিস্তানের অজস্র লেখক রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পক্ষ নিয়েছিল। আমরা তাদের কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। তাতে কি আমার দেশপ্রেমের কোনো ঘাটতি দেখা যাচ্ছে? আমাদের বাংলা ভাষার ভেতরে যে পরিমাণ উর্দু শব্দ আছে আমরা সেসব কি বাদ দেব?

ভাষা ও সংস্কৃতি- প্রবহমান নদীর মতো। যেখানে বাধা পাবে সেখানে আটকে যাবে। আমাদের শাস্ত্রীয় সংগীতের বড় অংশটি উর্দু শব্দে বিন্যস্ত। আমাদের পুরান ঢাকায় উর্দুতে কথা বলে এমন অজস্র পরিবার আছে। উর্দু কবিদের একটা গোষ্ঠীও আছে। কাওয়ালিরও ভালো শিল্পী আছে।

আমরা কি সেই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হবো? সেটা কোনো ভালো কাজ? একটা দেশে কত ভাষা কত সংস্কৃতি থাকে। ভাষা- সংস্কৃতির এই বৈচিত্র্য দেশের সার্বিক সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করে। আমি যে কথা বলছি সে কারণে যদি কাওয়ালির ওপর হামলা হয়ে থাকে তাহলে যারা করেছে, তারা সম্ভবত কাওয়ালি সংগীতের ইতিহাস জানে না। তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা ভাষা আন্দোলনের মর্ম কিছুই বোঝে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাওয়ালি সংগীত অনুষ্ঠান পণ্ড করার কাজটা ভীষণ অন্যায়। এটা কেবল কাওয়ালি অনুষ্ঠানের ওপর হামলা নয়, এ হামলা বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ওপরও। যেটা কোনো মতেই কাম্য হতে পারে না। এর মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বৃহত্তম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ-আবহের জন্য ক্ষতি হলো। যার দায় পুরোটাই হামলাকারীদের।

১৯৫২ সালে আমাদের যে মহান ভাষা আন্দোলন, তা ছিল পাকিস্তানের ভাষাগত রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিপক্ষে, সেটা উর্দুর বিপক্ষে নয়। তার নিষ্পত্তি সেইসময় হয়ে গেছে। ভাষা কোনো অপশক্তি নয়। ভাষার কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কিংবা ভৌগোলিক সীমানা থাকে না। ভাষা কারা কীভাবে ব্যবহার করছে সংকট সেখানে। সংস্কৃতি, সংগীত চিত্রকলা এক কথায় সৃষ্টিশীল কর্মের কোনো বন্ধন বা দেশ নেই, সীমানা নেই, কাঁটাতার নেই।

সুরের যেমন কোনো দেশ থাকে না, পাখির ডাক, নদীর বহতার সঙ্গে যেমন কোনো সীমানাপ্রাচীর থাকে না ঠিক তেমনি ভাষা সংস্কৃতির বিস্তারেও কোনো বাধা নেই -থাকতে পারে না। তবে হামলাকারীদের যেসব তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে তাতে মনে হচ্ছে না ভাষাগত সমস্যার কারণে এই হামলা হয়েছে। এই হামলার নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ আছে। সূক্ষ্ম কোনো কারণ। সেই কারণটি এখনও জানা নেই। অচিরেই হয়তো জানা যাবে। এটা বোঝা গেছে যে, পুরোনো একটা অশুভ চক্র নানাভাবে- নানা মাত্রায় জেঁকে উঠছে। এদের নিবৃত্ত করতে সরকারের উচিত ছিল হামলাকারীদের খঁজে বের করে সংস্কৃতির আওতায় আনা। কারণ ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি টিএসসি, শিল্পকলা- সংস্কৃতিচর্চার জায়গা সংকুচিত হয়ে আছে। শীতের শুরুতে যেসব স্থানে সাংস্কৃতিক পার্বণ লেগে থাকত সেগুলো আর আগের মতো হচ্ছে না।

আমাদের সাংস্কৃতিক দলের সব নেতারা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা নিতে ব্যস্ত। এরা এখন মস্ত ঠিকাদার একেকজন। সংস্কৃতিচর্চার জায়গাটা সংকুচিত হওয়ার কারণে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলার সাহস পাচ্ছে এরা। এই হামলার প্রতিবাদ করার কণ্ঠটাও ক্ষীণ। কারা প্রতিবাদ করবে? ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’ রবীন্দ্রসংগীতের লাইনের মতো এ ঘটনা হলে সেটা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।একসময় মিছিল-সমাবেশে হামলা হতো, এখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলা; এটা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। স্বাধীনতার পক্ষের সরকারের আমলে সংস্কৃতিচর্চায় বাধা আাসা কাঙ্ক্ষিত নয়।

কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির ফলাফলে এসব ঘটনা ঘটছে। কারণ কর্তৃত্ববাদ প্রচলিত রাজনীতির মধ্যে সীমিত থাকে না। তা ক্রমাগতভাবে বিস্তার লাভ করে। রাজপথের রাজনীতি, গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যমের ওপরে নিয়ন্ত্রণের ধারাবাহিকতায় এখন সাংস্কৃতিকচর্চায় তা প্রসারিত হচ্ছে। মতপ্রকাশের, কথা বলার, সমাবেশ করার স্বাধীনতা সীমিত হয়ে গেলে সাংস্কৃতিকচর্চার জায়গা অবারিত থাকবে এমন মনে করার কারণ নেই; আমরা কি এটাই ভেবে নেব?

এই হামলার ব্যাখ্যা এবং প্রতিবাদের জায়গাটা যেভাবে নেতিয়ে গেছে সেটা কোনো ভালো ঘটনা নয়। সরকারের সবাই গুণগান করবে সেটা সরকারের জন্য যতটা ক্ষতির তার চেয়ে বেশি দেশবাসীর জন্য। যারা বহুদিন পর স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধে একটি শক্তিকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় পেয়ে আনন্দিত। আমরা চাই এই হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কেবল টিএসসিতে নয়― সারা দেশে সব জায়গায় কাওয়ালি হবে, কীর্তন হবে, গণসংগীত হবে, ব্যান্ড সংগীত, রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত সব কিছু চলবে। এ সময় না চললে আর সময় কোথায়?

লেখক: গবেষক-প্রবন্ধকার, সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর