ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চটি ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে পৌঁছানোর পর চলন্ত অবস্থায় আগুন লাগে গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে। এ ঘটনায় অন্তত ৪২ জনের প্রাণ গেছে। আহতের সংখ্যা কমপক্ষে দেড় শতাধিক। এখনও কয়েকজন নিখোঁজ থাকার দাবি স্বজনদের। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই নারায়ণগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে আরেকটি নৌদুর্ঘটনা ঘটেছে। ডুবে যাওয়া ট্রলারটির ১০ যাত্রী আট ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত নিখোঁজ ছিল।
এসব ঘটনা কি প্রমাণ করে না দেশের নৌ-নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ? তা না হলে সবচেয়ে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা নৌপথে কেন বার বার দুর্ঘটনা ঘটবে? এর দায় সংশ্লিষ্টদের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক সড়ক পথের স্বার্থকে বড় করে দেখার জন্যই কি নৌপথকে নিরাপদ করা হচ্ছে না? এ পথে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে পারলেই যাত্রী কমবে, সড়কপথে পকেট ভরবে পরিবহন মাফিয়াদের!
দেশে এ পর্যন্ত নৌদুর্ঘটনা কতটি হয়েছে? এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও নৌযানে আগুন লেগে এত হতাহতের ঘটনা এবারেই প্রথম। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তদন্ত দলও বলেছে, লঞ্চটির ইঞ্জিন থেকেই আগুনের সূত্রপাত। অর্থাৎ নৌযানটির ইঞ্জিনে ত্রুটি ছিল। ইতোমধ্যে নৌ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টও জমা হয়েছে। যদিও রিপোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। অতীতে বেশিরভাগ তদন্ত প্রতিবেদনে নানা মহলকে ছাড় দেয়া বা স্পষ্ট না হওয়ায় এটির ক্ষেত্রেও ধূম্রজাল সৃষ্টি হতে পারে- এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
পর পর দুটি বড় নৌ দুর্ঘটনার পর দেশে নৌযানের প্রকৃত সংখ্যা কত, নৌযানের ফিটনেস আছে কি না ও নৌদুর্ঘটনার পর বিচার হওয়া না হওয়ার প্রশ্নটি আবারও সামনে এল। তেমনি নৌ-সেক্টরে প্রয়োজনীয় তদারকি হচ্ছে কি না এ নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। সর্বোপরি নৌপথের নিরাপত্তা নিয়ে আরও বেশি ভাবনার সময় এসেছে।
মোটা দাগে বললে, সারা দেশে কত নৌযান চলাচল করছে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকারের হাতে নেই। তেমনি ফিটনেসবিহীন নৌযানের সংখ্যা কত এ তথ্যও জানে না নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। এসব বিষয় যখন মুখ্য আলোচনায় তখন নৌযানের ফিটনেস, দুর্ঘটনার পর বিচারের প্রত্যাশায় বালি পড়তে পারে।
দেশে কত নৌযান চলাচল করবে, সরকারি দপ্তরে এর কোনো হিসাব থাকবে না, তা কাম্য নয়। এমন বাস্তবতা নৌ পরিবহন সেক্টরে প্রয়োজনীয় তদারকির যথেষ্ট অভাবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নৌপথ হলো যোগাযোগে সবচেয়ে নিরাপদ মাধ্যম। নদীমাতৃক বাংলাদেশে তিনভাগ জল। অথচ বিশাল জলপথকে পুরোপুরি সদব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো বিলীন হয়ে গেছে অন্তত ২০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ!
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদাহরণ আছে, সেখানে কৃত্রিমভাবে নৌপথ সৃষ্টি করা হয়। অথচ প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া সম্পদ চোখের সামনে নষ্ট হচ্ছে। দখল-দূষণ, ভূমিদস্যুদের থাবাসহ ড্রেজিংয়ের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে নৌ-রুটগুলো। তিল তিল করে হত্যা করা হচ্ছে নদ-নদীগুলোকে। রাজনৈতিক প্রভাবে নদীর জমি ভূমিদস্যুদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনা যাচ্ছে না। ফলে সামনের দিনগুলোতে বর্তমানে পাঁচ হাজার কিলোমিটারের কিছু বেশি নৌপথ হয়ত আরও সংকুচিত হয়ে যেতে পারে- এমন ধারণা অমূলক নয়।
নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে যাত্রী ও পণ্যবাহী মিলিয়ে অনুমোদপ্রাপ্ত নৌযানের সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। এর মধ্যে প্রতিবছর প্রায় আট হাজার নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়। সরকারি হিসাবের নিবন্ধন করা নৌযানের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার অবৈধ থেকে যায়।
১৪ হাজার নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা করা সম্ভব হবে না এই যুক্তি কি মেনে নেয়া যায়। তাহলে কি লোকবল কম, নাকি অন্য কোথাও গলদ? আসলে অনুমোদপ্রাপ্ত নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা যদি প্রতিবছর নিশ্চিত করা সম্ভব না হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে নৌপথের বিষয়ে উদাসীনতা আছে। দ্রুতই এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
আরও দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, গত ৫০ বছরেও দেশে কোনো নৌ-শুমারি হয়নি। ফলে সারা দেশে প্রকৃত নৌযানের সংখ্যা কত? তা জানার সুযোগ নেই।
২০১০ সালে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরল বজলুর রহমান নৌ-সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেন। সেই চিঠিতে সারা দেশে ৫০ হাজার নৌযানের কথা উল্লেখ করা হয়। তাহলে অবৈধ নৌযানগুলোকে কেন বন্ধ করা হচ্ছে না? বৈধ যানে ত্রুটির শেষ নেই। তাহলে অবৈধ যান কি সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়ার সুযোগ আছে?
নৌ-সেক্টর নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলোর দাবি, সারা দেশে নৌযানের সংখ্যা এক লাখের বেশি। এতেই বোঝা যায় নৌ-সেক্টর কতটুকু অবহেলিত। এতে যত্ন ও নজরদারির কত অভাব!
অথচ নৌযানের নিবন্ধন ও ফিটনেস দেখতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরে ১৮ জন পরিদর্শক আছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ২৫ জন পরিবহন পরিদর্শকও ফিটনেসসহ নৌ-নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়গুলো দেখেন। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে এসব পরিদর্শকদের কাজ আসলে কী? তাদের দায়িত্ব কি শুধু রেজিস্ট্রেশন করা নৌযান দেখা? নাকি গোটা নৌ-সেক্টরকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা?
এর বাইরেও নৌযানের সার্বিক কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্ব সরকারের দুই সংস্থা- নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌ-পরিবহণ অধিদপ্তর।
অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশের ৮১ ধারা অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএর ৪৭ জন কর্মকর্তাকে অনিবন্ধিত ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আইনগত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা খুব কমই ওই আইনের প্রয়োগ করেন। অনেক ক্ষেত্রে নিবন্ধনহীন জাহাজ থেকে কনজারভেন্সি চার্জ আদায়ের মাধ্যমে তাদের বৈধতা দেন কোনো কর্মকর্তা।
নিয়ম অনুযায়ী, নৌযানগুলোর নিবন্ধন নেয়ার পাশাপাশি প্রতিবছর ফিটনেস সনদ হালনাগাদ করতে হয়। এ সনদ দিতে নৌযানের মাস্টার-ড্রাইভারের সনদ, জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ও অন্য আনুষঙ্গিক বিষয়সহ ৫১টি বিষয় দেখেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়াররা। সেদিক দেখভালের শিথিলতা চরমে। তাই দায়িত্বশীলদের দ্রুত সময়ের মধ্যে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
শীত মৌসুমে নৌ-রুটে যান চলাচলে বিভিন্ন রকম নির্দেশনা থাকে। তাও দেখভালের লোকবল অপ্রতুল। নিজেদের মতো করে গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরকে যারা পরিচালনা করতে চান তাদের চিহ্নিত করা জরুরি। সেইসঙ্গে দায়িত্বে অবহেলা করে, ঘুষ নিয়ে আপস করে নৌপথকে অরক্ষিত করে লাভ কাদের হবে? তাদেরও চিহ্নিত করা জরুরি দরকার।
অনিবন্ধিত বালুবাহী (বাল্কহেড) জাহাজ, ট্রলার ও স্পিডবোট মিলিয়ে অন্তত ২০ হাজার নৌযান চলাচল করে থাকে। আইনগতভাবে নিবন্ধনহীন ১৬ হর্স শক্তির বেশি ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ দাবড়ে বেড়ানো এসব নৌযানকে কোনোভাবেই আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি নৌ পুলিশও কিন্তু মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। তাহলে কীভাবে এসব যান প্রকাশ্যে চলে?
নিয়ম অনুযায়ী, নৌযানের নকশা নৌ পরিবহন অধিদপ্তর থেকে অনুমোদনের পর সেই নকশা অনুযায়ী নৌযান নির্মাণ করতে হয়। নির্মিত নৌযান পরিদর্শন করে রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস-সনদ দেয় সার্ভেয়াররা। ওই সনদ দুটি দেখিয়ে বিআইডব্লিটিএ থেকে রুট পারমিট নিতে হয়। এরপরই নৌযানটি চলাচলের জন্য উপযুক্ত হয়।
বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ শুধু যাত্রীবাহী ৭৮০টি নৌযানের রুট পারমিট দিয়েছে। তবে ফি অনুমোদন না পাওয়ায় পণ্যবাহী নৌযানের রুট পারমিট দেয়া শুরু করেনি। প্রশ্ন তাহলে অন্য নৌযানগুলো কাদের অনুমতি নিয়ে চলাচল করছে? অথচ সারা দেশে ইচ্ছেমতো নৌযান বানিয়ে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন করা হয়। বর্ষা মৌসুমে হাওর-অধ্যুষিত সাত জেলা পুরোপুরি অরক্ষিত থাকে। সেখানে দেখভালের অভাবে দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় যাত্রীদের। নৌ-রুটে সাইন সিগন্যাল সঠিক না থাকারও অভিযোগ বিস্তর। যারা কাজ করে না তাদের তো সিগন্যাল ঠিকঠাক রাখার প্রয়োজন নেই! নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোই হয়ত জরুরি।
এখন বাস্তবতা হলো যেকোনো নৌপথে ইচ্ছা করলেই নৌযান পরিচালনা করা সম্ভব। যেখানে বৈধ রুটগুলোতেই তদারকির ব্যাপক অভাবে সেখানে অবৈধ রুটে কোনো তদারকি থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। তাহলে কি নৌপথ অরক্ষিত হয়েই থাকবে?। সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই নৌপথকে নিরাপদ করার দৃশ্যমান পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাব। নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবার অন্তরালে গজিয়ে থাকা দেয়ালটি চিহ্নিত করতে হবে। সেসঙ্গে সবকিছু স্বচ্ছতা করতে হবে। আনতে হবে জবাবদিহির আওতায়। সঠিক পদক্ষেপে নিরাপদ নৌপথ গড়ে তোলা সম্ভব হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়বে, তেমনি নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা আরও সুদৃঢ় হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক