নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। নারী এগিয়ে যাচ্ছে এটি যেমন সত্য, আবার নারী নির্যাতন বেড়েছে সেটিও অস্বীকার করার উপায় নেই। করোনাকালে গত দুই বছরে নারী নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে। গণমাধ্যম ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন থেকে এ তথ্যই উঠে এসেছে।
২০২০ সালে ধর্ষণের ঘটনা ও এর ভয়াবহতা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে বিদ্যমান আইন সংশোধন করার দাবি ওঠে। নারী নির্যাতন তথা নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইনও পাস হয়। আর মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ২০২১ সালকে বলেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বছর।
আমাদের দেশে কোনো অপরাধের ঘটনা বেশি ঘটলে বা এ নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা হলে আইন প্রণয়ন নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। বিষয়টি যেন এ রকম যে আইনের অভাবেই এত দিন অপরাধটি হয়ে আসছিল বা আইন না থাকার ফলেই অপরাধীদের শাস্তি দেয়া যাচ্ছিল না। তবে বাস্তবে দেখা যায়, প্রায় সব বিষয়েই আমাদের আইন রয়েছে। যুগের প্রয়োজনে কিছু কিছু নতুন আইন করা প্রয়োজন হলেও নির্যাতন বা ধর্ষণের মতো অপরাধ দমনের জন্য নতুন করে আইনের প্রয়োজন নেই।
ধর্ষণের মতো অপরাধ দমনের জন্য ব্রিটিশরা ১৮৬০ সালেই দেশে আইন করে গেছে। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইন অপরাধ বিজ্ঞানের একটি অভিধান। অনেক অপরাধের মৌলিক নীতিই এখানে উল্লেখ আছে। প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষেত্রে নতুন নতুন আইন করতে হয়েছে। যেমন- দ্রুত বিচার আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন ও দমন আইন ইত্যাদি। এ আইনগুলো মূলত মূল অপরাধের ক্ষেত্রটিকে আরও প্রসারিত করেছে, যাতে অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করা যায় অথবা বিচারপ্রক্রিয়া আরও দ্রুত করা যায়।
আসল কথা হচ্ছে, শুধু আইন করে অপরাধ দমন করা যায় না। যদি তা-ই হতো তবে দ্রুত বিচার আইন বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মতো কঠিন আইন হওয়ার পরে এ দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন হতো না। আইন করে বা কঠিন দণ্ড আরোপ করা হলেই অপরাধ দমন হয় না। আইন সহজ হতে পারে, দণ্ডও লঘু হতে পারে-মূল কথা হলো আইনের প্রয়োগ ও সব অপরাধীর সাজা নিশ্চিত করা।
একই অপরাধে এক আসামির ফাঁসি আরেক আসামির খালাস ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। আইনে যদিও বলা হয় হাজার অপরাধী মুক্তি পাক, কিন্তু একজন নিরপরাধ যেন সাজা না পায়। সেটি ন্যায়বিচারের একটি মৌলিক নীতিও বটে। এর মানে এই নয় যে হাজার অপরাধীকে মুক্তি দিয়ে দু-একজনকে ফাঁসি দিতে হবে। এই নীতির মানে হলো, স্বচ্ছ বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, যেখানে সব অপরাধীকেই আইনের আওতায় আনা হবে এবং কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হবে না। কিন্তু আমাদের দেশে একদিকে যেমন নিরপরাধ ব্যক্তিদের বিচার হয় আবার অনেক অপরাধীও ছাড়া পায়।
নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ও সামাজিক চাপের মুখে অনেক নারীই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। আর আইনের ফাঁক-ফোকর তো আছেই। কিন্তু আবার উল্টো চিত্রও দেখা যায়। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে, পারিবারিক চাপে বা প্রতিশোধ নিতে অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা মামলাও করা হয়। আইনের অপব্যবহার করে অনেকেই মিথ্যা মামলা করেন। ফলে আসামিপক্ষ সাজা এড়াতে মীমাংসা করতে বাধ্য হয়। অনেক সময় মামলার বাদীরা টাকার বিনিময়ে মামলা তুলে নেন। আইনে মিথ্যা মামলার জন্য সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও ভুক্তভোগীরা মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েই সন্তুষ্ট থাকেন [নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ (১) ধারা]। এটি হচ্ছে আইনের অপব্যবহার।
আইনের এই অপব্যবহার রোধে মিথ্যা মামলাবাজ নারী বা বাদী বা পরিবারকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এক দিকে অনেক অপরাধী আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হয়ে আসে, যার ফলে নির্যাতিতা নারী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন আবার অন্যদিকে মিথ্যা মামলা দিয়ে নিরপরাধকেও ফাঁসানো হয়।
এ রকম নানা অবিচার ও অনিয়মের বেড়াজালে হারিয়ে যায় এ দেশের অনেক নির্যাতনের কাহিনি। সব ঘটনা গণমাধ্যমে আসে না, মামলাও হয় না। বিভিন্ন কারণে অনেক ভুক্তভোগী মামলাও করতে পারেন না। মামলা করার সাহসও থাকে না। মামলার খরচ মেটানোও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। উকিলের খরচ, যাতায়াতের খরচ আরও কত কী। এ ছাড়া আইনের জটিল প্রক্রিয়া তো আছেই।
অপরাধীদের শাস্তি না হলে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়। বাস্তব অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এ দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। পাঁচ বা তার চেয়ে কম বয়সী শিশুরাও এখানে নিরাপদ নয়। ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়েও নারীর শ্লীলতাহানি করা হয়। কন্যাশিশুরা ঘরের বাইরে গেলে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এ এক ভয়াবহ অবস্থা।
আসকের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে দেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১ হাজার ৬২৭ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৫৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ নারী ও ১১ পুরুষসহ খুনও হয়েছেন মোট ১৪ জন।
এ ছাড়া, পারিবারিক নির্যাতনে মারা যান ৩৬৭ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯০ জন। যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হয়ে হত্যার শিকার হন ৮৯ নারী এবং আত্মহত্যা করেন ১৮ নারী।
আসক-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ১ হাজার ৩২১ নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনজন নারীসহ আটজন খুন হয়েছেন। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ৩৭২ জন। শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যাসহ মোট ৫৯৬ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে।
উপরোক্ত দুটি সংক্ষিপ্ত খতিয়ানে নারী ও শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র স্পষ্ট। নারী ও শিশুদের জন্য পরিবার, দেশ ও সমাজ কতটা অনিরাপদ হয়ে উঠছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। নারী নির্যাতনের তালিকা আরও দীর্ঘ। এখানে শুধু কয়েকটি বড় অপরাধের হিসাব তুলে ধরা হলো।
অনেক সময় স্থানীয়ভাবে নারী নির্যাতনের বিশেষ করে নারী ধর্ষণ হলে সালিশ মীমাংসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে আসলে নারীকেই অপরাধী বা দুশ্চরিত্রা হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। এসব সালিশের মাধ্যমে প্রতিকারের নামে নারীকে মূলত দ্বিতীয়বারের মতো নির্যাতন করা হয়। তাই ধর্ষণের অপরাধে সালিশি করা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করার নির্দেশনা চেয়ে ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর আসক-এর পক্ষ থেকে একটি রিট করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য রুলও জারি করেছেন। এই রুলের বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
তবে ভুক্তভোগীদের প্রতিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনজীবীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। আইনজীবীরা অনেক সময় প্রতিকার বা সমাধান দেয়ার চেয়ে মামলা করাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অনেক সময় নারী অভিযোগকারী পুরুষ আইনজীবীর কাছে সব কথা খুলে বলতে পারেন না। প্রতিকার না পাওয়ার এটিও একটি কারণ। এ ক্ষেত্রে নারী আইনজীবীরা এগিয়ে এলে নারীর প্রতিকার যুদ্ধ আরও সহজ হতো।
দেশে নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ১২ দফা সুপারিশ করেছে। এই ১২ দফার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সব থানায় একজন করে নারী কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান, স্কুল-কলেজ এলাকায় এবং ছাত্রীদের চলাচলের পথে বখাটের উৎপাত বন্ধে সিসিটিভি স্থাপন ও পুলিশের কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করা এবং ৯৯৯ নম্বরকে আরো বিস্তৃত ও গতিশীল করা। স্থায়ী কমিটির এ নির্দেশনাগুলো সময়োপযোগী। এগুলো বাস্তবায়ন করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন বন্ধে আদালত বিভিন্ন সময় নির্দেশনা দিয়েছে। হাইকোর্ট নারী নির্যাতন বন্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ১০ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। এ ছাড়া ২০২০ সালের ২১ জুলাই বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে ধর্ষণ মামলার বিচার বিষয়ে ৬টি নির্দেশনা দেন। বিচারকাজ দ্রুদ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এই নির্দেশনাগুলো দেয়া হয়েছিল। এই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে সরকার ও নিম্ন আদালতকে এগিয়ে আসতে হবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে। আদালতের স্বল্পতা থাকলে তাও দূর করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।
লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক