বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১০ জানুয়ারি একটি ঐতিহাসিক দিন, আনন্দঘন দিন, খুশির দিন। ৫০ বছর আগে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় ফিরে এসেছিলেন। এর আগে বিজয়ের ২২ দিন পর অবশেষে ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি মুক্ত মুজিব বিজয়ী বীরের বেশে লন্ডন পৌঁছেন।
বিশ্বের আরও দু-চারজন নেতা বিদেশে বন্দিজীবন শেষে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেও বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে আর কোনোটির তুলনা হয় না। ইতিহাস সৃষ্টিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ওই স্মরণীয়-বরণীয় প্রত্যাবর্তন সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ওইসময় লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি ভেদ মারওয়া ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বিমানে সহযাত্রী ছিলেন। পরবর্তীকালে ভেদ মারওয়া লিখেছেন-
“আমাদের অনেকের কাছে ওই সময় শেখ মুজিব ছিলেন ‘হিরো’। ব্রিটিশ গণমাধ্যমে তখন শেখ মুজিব ছাড়া কোনো কথা নেই। বিশ্বে তখন মুজিব ছিলেন সকলের ওপরে।” সত্যরঞ্জন সরকার লিখেছেন, “মুজিবকে সেদিন সারা বিশ্ব একবাক্যে চিনত। বাংলাদেশের বাউল গায়ক থেকে লন্ডন, নিউইয়র্কের বিটল গায়কের কণ্ঠে সেদিন যে গান বেজেছিল তা ছিল মুজিবের বাংলার গান। মুজিব সেদিন শুধু বাংলার ইতিহাসই ছিলেন না, ছিলেন বাংলার মানচিত্র।” (লেখক একসময় কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইসিটি বিশেষজ্ঞ ছিলেন)।
এক কথায় বলা চলে, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর বন্দি শেখ মুজিব ছিলেন তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত নেতা।
২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানের পরাজিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ২টি পদই দখল করে নেন, সত্তরের নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে বিজয়ী নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতা গ্রহণের পর ভুট্টোর প্রথম কাজ হলো সসম্মানে মুজিবকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানের প্রায় ১ লাখ সেনাসদস্যকে স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়া। লন্ডন-আমেরিকার নামিদামি পত্রিকাগুলোতে অবিলম্বে বিজয়ী নেতা মুজিবকে মুক্তি দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে।
পাকিস্তানের নব্যশাসক প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ১৯৭২-এর ৩ জানুয়ারি বিকেলবেলা করাচি শহরের নিস্তার পার্কে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় মি. ভুট্টো ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তিদান করা হবে। বক্তৃতা প্রসঙ্গে মি. ভুট্টো বলেন :
“২৭শে ডিসেম্বর শেখ মুজিবের সাথে আমার প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘আমি কি মুক্ত?’ আমি তাঁকে বলেছি, ‘আপনি স্বাধীন। আপনি যদি আমাকে কিছু সময় দেন, তা হলে এ ব্যাপারে আমার জনগণের মতামত যাচাই করতে পারবো। তাদের সম্মতি ছাড়া আমি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাই না।... কেউ কেউ বলেন, শেখ মুজিব আমার ‘তুরুপের তাস’ এবং সুবিধা আদায়ের জন্য আমি তা ব্যবহার করতে পারি। অন্যরা বলেন, ‘আমরা কেন সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করবো?’ আমি তাদের সঙ্গে একমত। শেখ মুজিবকে ব্যবহার করে আমি লাভজনক কিছু করতে চাই না। এ ব্যাপারে আপনারা একমত কিনা?”
বলাবাহুল্য, বিপুল জনতা শেখ মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তিদানের প্রশ্নে সম্মতিসূচক সাড়া দেয়।
উক্ত রিপোর্টের শেষদিকে ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সংবাদদাতা বলেন, আগামী তিনদিনের মধ্যে শেখ মুজিবকে একটি বিশেষ বিমানযোগে পাকিস্তানের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। (দি গার্ডিয়ান, ৪ জানুয়ারি, ১৯৭২)।
শেখ মুজিবের বিনাশর্তে মুক্তিদানের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়ে দি গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়:
“শেখ মুজিবই বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর বিস্ময়কর বাগ্মিতার মাধ্যমে তিনি বাঙালীদের অসন্তোষকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে পরিণত করেন। তাঁর বক্তৃতায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ভবিষ্যতে সুদিনের মুখ দেখার ভরসা পায়। তাঁকে যদি হত্যা করা হতো, কিংবা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দি হিসেবে রাখা হতো, তাহলে বাংলাদেশ সরকার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মারাত্মক নেতৃত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি হতো। তাঁর মুক্তি বাংলাদেশকে বাঁচার একটি সুযোগ দিয়েছে। (দি গার্ডিয়ান, ৪ জানুয়ারি ১৯৭২)।
১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসি’র ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডন আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। এই অপ্রত্যাশিত খবরের ‘হেডলাইন’ শুনে খবরটি সত্য বলে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না।
সকাল সাড়ে ছটার সময় বঙ্গবন্ধু হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান। ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড’ (মেট্রোপলিটান পুলিশের তৎকালীন হেডকোয়ার্টার্স) থেকে পুলিশ অফিসার পিটার ল্যাংলি টেলিফোনযোগে প্রবাসী বাঙালিদের নেতৃত্বদানকারী ‘স্টিয়ারিং কমিটি’র ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক শেখ আব্দুল মান্নানকে বঙ্গবন্ধুর আগমন সংবাদ জানান। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম থেকেই মি. ল্যাংলি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সম্পর্কে সাহায্য ও পরামর্শ দিয়েছেন। লন্ডন দূতাবাসে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিবিদ রেজাউল করিম বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান।
বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে সকাল ৮টার মধ্যে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসা হয়। বিভিন্ন ‘অ্যাকশন কমিটি’র নেতৃবৃন্দ, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট গাউস খান, লন্ডন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট মিনহাজউদ্দিন এবং বিচারপতি চৌধুরীর বিশ্বস্ত সহযোগী শেখ আব্দুল মান্নান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
লন্ডনস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার আপা পন্থও বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এসে হাজির হলেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে একটি অভিনন্দন বাণী পাঠান। এই বাণীতে তিনি বলেন:
“আপনি বন্দী ছিলেন, কিন্তু আপনার চিন্তাশক্তি ও চেতনাকে কারারুদ্ধ করা সম্ভব নয়। আপনি নিপীড়িত জনগণের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।”
ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা (পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন সকালেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি ‘গুড মর্নিং মি. প্রেসিডেন্ট’ বলে বঙ্গবন্ধুকে সম্ভাষণ করেন।
স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত থাকার ফলে পরিশ্রান্ত বাঙালিরা দলে দলে এসে হোটেল ঘিরে ফেলেছে। মুহুর্মুহু ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে তারা আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে। হোটেলের বাইরে যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই অগণিত লোক।
দেখেই বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধুর শরীর অত্যন্ত দুর্বল। তা সত্ত্বেও তিনি জানালার পর্দা সরিয়ে জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। তার গায়ে শক্তি নেই; তিনি থর থর করে কাঁপছেন। তার সঙ্গীদের কেউ কেউ বললেন, আপনি তো পড়ে যাবেন। তিনি কারো কথা শুনলেন না। জানালা থেকে ফিরে এসে কয়েক মিনিট বসে আবার জানালায় ফিরে গিয়ে তিনি হাত তুলে সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন।” (মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের বাঙালীর অবদান’, শেখ আব্দুল মান্নান, পৃ. ১২০)
ওইদিন সন্ধ্যাবেলা বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে যান। ঘরোয়া আলোচনাকালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের প্রশ্ন উত্থাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রী হিথ বঙ্গবন্ধুকে বলেন, স্বীকৃতিদানের আগে পররাষ্ট্র দপ্তরের কার্য পরিচালনা সম্পর্কিত আচরণবিধি (প্রটোকল) অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকারকে দেখতে হবে, নতুন সরকার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের সমর্থনপুষ্ট এবং পূর্ণ কর্তৃত্বের অধিকারী কি না। লন্ডনের ‘দি সানডে টাইমস’-এর কূটনৈতিক সংবাদদাতা উল্লিখিত তথ্য প্রকাশ করে বলেন, মি. হিথের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর শেখ মুজিবুর রহমান পরিষ্কার বুঝতে পারেন, ব্রিটেন বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন।
সংবাদদাতা আরও বলেন, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে বলে ব্রিটিশ সরকারি মহল মনে করে। (দি সানডে টাইমস, ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২)। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনাকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চান, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী কখন প্রত্যাহার করা হবে।
বঙ্গবন্ধু দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) যখনই চাইবেন, তখনই ভারতীয় সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করা হবে। এসব তথ্য পরে জানা গেছে। এই যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করা- তিনি যখন চাইবেন- তখনই ভারতীয় মিত্রবাহিনী সে দেশে চলে যাবে। এটাই শেখ মুজিবের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য। এ জন্যই ছোট্ট দেশের শেখ মুজিব অনন্য, অসাধারণ ও অতুলনীয়।
শেখ মুজিবের মুক্তির খবর পেয়ে বিশ্বের নামিদামি সাংবাদিকরা হোটেলে ভিড় জমান। মুক্তির পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে দেশে-বিদেশে অবস্থানকারী বাংলার বীর জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে বিজয়ী মহানায়ক মুজিব বলেন-
‘আমার দেশের মানুষের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য আর একটি মুহূর্তের বিলম্বও আমি সইতে পারছি না।’
ইংরেজিতে দেয়া ওই বক্তব্যে সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আজ মুক্তির সীমাহীন আনন্দ আমার দেশের মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে আর কোনো বাধা নেই। এক মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা এ মুক্তি অর্জন করেছি। বাংলাদেশের জনগণের এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় এ লড়াইয়ের চূড়ান্ত অর্জন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্তিত্ব এক প্রশ্নাতীত বাস্তবতা।’
তার দেশ যে স্বাধীন হয়েছে, তা কীভাবে জানলেন? এ প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন-
“আমার মনে হয় মি. ভুট্টো যখন আমার সাথে দেখা করতে এলেন, তার আলোচনা থেকে আমি বুঝতে পারলাম যে, বাংলাদেশ তার নিজের সরকার গঠন করেছে। এর আগ পর্যন্ত আমি কিছুই জানতাম না। ইয়াহিয়া খান এই দুনিয়ার সবকিছু থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল।”
৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডন পৌঁছেন, তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ লন্ডনের বাইরে ছিলেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন হিথ। শেখ মুজিব ওই সময় ঘোষিত রাষ্ট্রপতি হলেও সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি নন। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়ির দরজা নিজে খুলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী হিথ।
১৯৮০ সালের ১৬ মার্চ জাতির পিতার এক স্মরণসভায় বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন সেই অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক দৃশ্যের কথা বর্ণনা করে বলেন, ‘গাড়ি যখন থামল, একটি লোক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে সেই গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকলেন। যতক্ষণ শেখ মুজিব গাড়ি থেকে বেরিয়ে না এলেন। এ ব্যক্তি আর কেউ নন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ। যে সাম্রাজ্যে কোনোদিন সূর্য অস্ত যেত না, সেই সাম্রাজ্যের মধ্যমণি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আমাদের পর্ণকুটির থেকে আগত একজন সাধারণ কর্মী, যিনি দলপতি হতে রাষ্ট্রপতি এবং রাষ্ট্রপতি হতে রাষ্ট্রপিতা হয়েছিলেন, তাঁকে অভ্যর্থনার জন্য দুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এই দৃশ্য জীবনে কোনোদিন ভুলব না।”
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রুপালি কমেট বিমানে ১০ জানুয়ারি সকাল ৮টায় দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে অভ্যর্থনা জানান। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনাকালে সিদ্ধান্ত হয়, ‘বঙ্গবন্ধু যখন চাইবেন, তখনই ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ থেকে চলে আসবে।’ ওইদিন দিল্লিতে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কমেট-এর পরিবর্তে ভারতের রাষ্ট্রপতির সরকারি বিমান রাজহংসে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় আসার অনুরোধ জানানো হয়। ওই সময় দ্রুততার সঙ্গে সকলের মালামাল কমেট থেকে রাজহংসে স্থানান্তরিত পর্যন্ত করা হয়। এতে বঙ্গবন্ধু রাজি হননি। সে সময় দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী, কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী তার ‘স্মরণে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থে লিখেছেন। ‘‘বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ব্রিটিশ সরকার বিশেষ সৌজন্যমূলক ব্যবস্থায় যে বিমানটি দিয়েছে, মাঝপথে অকারণে তা বদল করা সমীচীন হবে না।’’
বিমান পরিবর্তন না করাটা ছিল বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা এবং স্বাধীনচেতা মনোভাবের পরিচয়। বিমান পরিবর্তন করার সিদ্ধান্তটি বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবও পছন্দ করেননি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৮ নম্বর বাড়িতে বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে এলে তিনি বলেন, মাঝপথে বিমান বদল করলে ব্রিটেনের সরকার ও জনগণ মনঃক্ষুণ্ন হতে পারে, এ জন্য ব্রিটিশ বিমানেই ঢাকা আসার পরামর্শ দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ডিপি ধরকে বেগম মুজিবের মতামত জানিয়ে দেন। শেষপর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কমেট বিমানেই ঢাকা আসেন। ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়ার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে এসব তথ্য রয়েছে।
ঢাকার সেই ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক মানুষ বঙ্গবন্ধুকে বীরোচিত সংবর্ধনা জানায়। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন আর নবজাত বাংলাদেশের অস্তিত্ব ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ১০ জানুয়ারি লন্ডনের দি গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়-
“শেখ মুজিবের মুক্তিলাভ প্রধান এবং সর্বোত্তম ব্যাপার। এর ফলে বাংলাদেশের টিকে থাকার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তিনি ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর মাটিতে তাঁর পা রাখামাত্রই এই নতুন রাষ্ট্র একটি বাস্তব সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”
১১ জানুয়ারি (১৯৭২) লন্ডনের দি টাইমস পত্রিকার সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয় যে, বাস্তব সত্য হচ্ছে, “ শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর পূর্ব পাকিস্তানের বিলুপ্তি ঘটেছে এবং পূর্ব বাংলা বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে।”
এটা স্বীকার করতেই হবে, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ ফিরে আসার কারণেই ৩ মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য সেদেশে চলে যায়। বিজয়ের পরেও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলার মানুষের কাছে স্বাধীনতাকে অপূর্ণ মনে হয়েছে। বিজয়ের মহানায়কের আগমনে পূর্ণতা পায় অপূর্ণ স্বাধীনতা।
তথ্যসূত্র:
১. আবদুল মতিন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব- মুক্তিযুদ্ধের পর’
২. শেখ আবদুল মান্নান, ‘মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের বাঙালীর অবদান’
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক; সিনিয়র সাংবাদিক