ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পঞ্চম ধাপের ভোটও রক্তপাতহীন, শান্তিপূর্ণ হলো না। অন্যান্য ধাপের মতোই এবারও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত ৫ জানুয়ারি দেশের ৭০৮টি ইউপিতে অনুষ্ঠিত পঞ্চম ধাপের ভোটে প্রাণ গেছে ১০ জনের। সর্বশেষ, গত জুন থেকে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল ১০৮ জন। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি হামলা, গোলাগুলি, গাড়ি ভাঙচুরের মতো সহিংসতার ঘটনায় এসব প্রাণহানি ছাড়াও আহত হয়েছেন অনেকে। ভোটের দিন বগুড়ায় পাঁচজন, চাঁদপুরে দুজন, গাইবান্ধা, চট্টগ্রাম ও মানিকগঞ্জে একজন করে মারা গেছেন। এ ছাড়া, এ দিনই ঝিনাইদহে মারা গেছেন একজন; যিনি কয়েক দিন আগে নির্বাচনি সহিংসতায় আহত হয়েছিলেন। পঞ্চম ধাপের ভোটে সহিংসতা ছাড়াও জাল ভোট, একটি বিশেষ প্রতীকে ভোটদানে বাধ্য করা, কেন্দ্র দখলসহ নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এর আগে চার ধাপে ২ হাজার ৮৪২টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে ভোটের আগে-পরে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে সহিংসতায় সারা দেশে এ পর্যন্ত প্রাণহানি হয়েছে ৮৬ জনের। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় ধাপে। ওই ধাপের নির্বাচন ঘিরে ৩০ জন নিহত হন। তবে শুধু ভোটের দিন দ্বিতীয় ধাপে সংঘাতে জড়িয়ে ছয়জন, তৃতীয় ধাপে সাতজন, চতুর্থ ধাপে তিনজন নিহত হন। বেশিরভাগ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও দলের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে।
নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে মাঠে নেই বিএনপি। দল মনোনীত একক প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। মনোনয়ন না পেয়ে অধিকাংশ স্থানেই আওয়ামী লীগের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনি মাঠ দখলে জড়াচ্ছেন সংঘাত-সহিংসতায়। এই নির্বাচনে অন্য দলের কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও ভোটের মাঠে কার্যত সক্রিয় রয়েছেন ক্ষমতাসীনরাই।
ভোটে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগই। ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যকার সংঘাত-সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে বেকায়দায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। স্থানীয়ভাবে দুই পক্ষই শক্তিশালী হওয়ায় কিছু জায়গায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উভয়পক্ষের সঙ্গে সখ্য থাকায় সহিংসতা রোধের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চলমান সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এমনিতেই আমাদের দেশে নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এমন সহিংস পরিস্থিতি চলতে থাকলে নির্বাচন সম্পর্কে দেশের মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা আরও বাড়বে। যা শেষপর্যন্ত নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পরিস্থিতি সামাল দেয়ার দায়িত্ব যে নির্বাচন কমিশনের, তারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ এবং প্রার্থীদের দায়ী করা ছাড়া তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অনেক সমালোচনা ও আশঙ্কার পরও সহিংসতা দূর করতে কমিশন কঠোর ভূমিকা নিচ্ছে না কেন? তাদের সমস্যা কোথায়? বিভিন্ন স্থানে প্রার্থীদের নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ উঠছে। শুধু অভিযোগ নয়, আচরণবিধি লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা দৃশ্যমানও। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ভূমিকা লক্ষ করা যায়নি।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কিছুটা উত্তেজনা বরাবরই থাকে। তবে এবার সহিংসতা যে পর্যায়ে চলে গেছে, তা চিন্তার বিষয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে সংঘাত, বিশৃঙ্খলা ও হতাহতের ঘটনাগুলো ঘটছে, এর দায় ইসি কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনি মাঠে দলীয়ভাবে বিএনপি না থাকায় অধিকাংশ স্থানেই রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী; নিজেরাই জড়িয়ে পড়ছেন সংঘাতে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ধরে রাখতে পারছে না। এটা কেন হবে? দলীয় শৃঙ্খলা না মানলে সেই দল টিকে থাকে কীভাবে?
এবারের ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের নির্বাচনি প্রচারণায় এবং নির্বাচনি অফিসে হামলা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষ পরিণত হয়েছে নিত্য ঘটনায়। এসব ঘটনায় প্রার্থীদের শুধু নির্বাচনি আচরণবিধিই লঙ্ঘিত হচ্ছে না, নির্বাচনে ভোট প্রদানের ব্যাপারে জনমনে ভীতির সঞ্চারও হচ্ছে। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হোক, এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
এমন পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রথম দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও ভোটারদেরও ভূমিকা আছে। কিন্তু নির্বাচনের মাঠে কাউকেই স্ব-স্ব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে দেখা যায়নি। পুরো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের ধারা সূচিত হয়েছে। এর প্রভাবে বাড়ছে নির্বাচনি সহিংসতা। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে দেশে কোনো নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে কি না, এ বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
এমনিতেই নানা ঘটনা পরম্পরায় বর্তমানে নির্বাচন অনেকটাই প্রহসনে পরিণত হয়েছে। বিরোধীশূন্য ভোট যেন সব শাসক দলের আকাঙ্ক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রে বিরোধীদের বাদ রেখে, বোমা-গুলি-হুমকি দিয়ে যেনতেন উপায়ে জিতে পদ দখল বা ক্ষমতায় যাওয়াটাই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে করে সংসদে, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদে বিরোধী দলের সদস্যদের অংশগ্রহণ লোপ পাচ্ছে। বিরোধীদের কথা বলতে না দেয়া, তাদের মতামতকে গুরুত্ব না দেয়া, অধিকার প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
ফলে ভোট মানেই একটা আতঙ্ক, উদ্বেগ আর মৃত্যুর উৎসবে পরিণত হয়েছে। চোখে ঠুলি নির্বাচন কমিশনেরও, তাদের তরফেও ক্ষমতাসীন দলের সুর শোনা যায়। জনগণ তাই নির্বাচন-বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। ভোট আসে-যায়, রাজা বদলায়, জনগণের জীবনের মৌলিক সমস্যার সমাধান হয় না। বলা ভালো যে, এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে শাসক দল যদি যথাযথ ভূমিকা পালন করত, তাহলে তা দলকেই গৌরবান্বিত করতে পারত। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন শাসক দলকে আরেক দফা কলঙ্কিত করেছে।
খুব জানতে ইচ্ছে করে, অবাধ নির্বাচনের বর্তমান সংজ্ঞা কী? ‘শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচনে মারামারি হানাহানি হবে কেন? বুথের ভেতর যিনি ভোট দিচ্ছেন, তার পাশে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকবেন কী কারণে? কেনইবা পুলিশের নাকের ডগায় লাঠিসোঁটা কিংবা গুলি-বোমার আঘাতে নিরীহ ব্যক্তিরা হতাহত হবেন? এসব ঘটনার দায় কে নেবে? আহত কিংবা নিহতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের সামান্যতম আশ্বাসও কোনো পক্ষ থেকে মিলবে না কেন? তা হলে এটাই কি আমাদের সংস্কৃতি? এই সংস্কৃতি নিয়েই আমরা গর্ব করব? একটার পর একটা নির্বাচন আসবে আর আমরা বলতে থাকব— এ বারের নির্বাচন ‘ মোটের উপর’ অবাধ ও শান্তিপূর্ণ!
এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে হলে যেকোনো মূল্যে ভোটব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। প্রতিটি নির্বাচনে সর্বত্র এখন থেকে সর্বদলীয় কমিটি গড়ে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসনের পাশাপাশি রাস্তায় নেমে সহযোগিতা করতে হবে। কাজটি শুধু প্রশাসন, রাজনৈতিক দলের নয়, সুস্থ শিক্ষিত, মানবিক, বুদ্ধিজীবীদেরও। কালিটা দীর্ঘদিনের, চট করে উঠে যাবে না।
মনে রাখতে হবে এক দল এক নেতার প্রতাপ যদি অপ্রতিহত হয়, তাহলে সেটা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। গণতন্ত্রের মোড়কে বিকশিত হয় একনায়কতন্ত্রের দৈত্য। যখন বেশির ভাগ মানুষের সমর্থন একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের পতাকার তলায় উথলে পড়ে, তখনই জন্ম নেয় স্বেচ্ছাচারিতা। এটা স্বতঃসিদ্ধ। এটা স্থানীয় পরিষদ কিংবা জাতীয় সংসদ− সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। জনগণের কল্যাণের বদলে আস্ফালনের চাপে গণতন্ত্র শব্দটাই তখন হাঁসফাঁস করে!
নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এই প্রতিষ্ঠানকে অগাধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এই ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টি নির্ভর করে নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তার ওপর। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকার পর্যায়ের অসংখ্য নির্বাচনসহ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এই নির্বাচনগুলোয় বড় ধরনের কোনো সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবেই ওই নির্বাচনগুলো স্বীকৃতি পেয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ ও দৃঢ় পদক্ষেপের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। প্রশ্ন হলো অতীতে এ কাজ করা গেলে এখন তা সম্ভব হচ্ছে না কেন? এটা কি কমিশনের অদক্ষতা, নাকি অনীহা বা অন্য কিছু?
নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ রাখতে নির্বাচন কমিশনের যে সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশিত, তা দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমানে লক্ষণীয় নয়। প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী—সবাই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশনকে সহায়তা করতে বাধ্য। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেই কাজ করছে না বা করতে পারছে না। সহিংসতা ঠেকাতে এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন পুলিশ, র্যাব, বিডিআর এমনকি প্রয়োজনে সেনাবাহিনীও কাজে লাগাতে পারে। আসলে প্রয়োজন নির্বাচন কমিশনের সক্রিয় ও দৃঢ় ভূমিকা। সেটা করতে ব্যর্থ হলে নির্বাচনি সহিংসতা প্রত্যাবর্তনের এই দায় তাদেরই নিতে হবে।
লেখক: প্রবন্ধকার, সাবেক ছাত্রনেতা।