কোটি কোটি শিক্ষার্থী যখন স্কুলে পুরোদমে ক্লাস করার অপেক্ষায়, ব্যবসায়ীরা যখন আশার আলো দেখছিলেন, একে একে বিশ্বের অনেক দেশে করোনা হাসপাতালগুলো সরকার বন্ধ করছিল বা করার পরিকল্পনা করছিল; তখনই করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন আঘাত হেনেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া নতুন এই ধরনের ভ্যারিয়েন্ট সারা বিশ্বে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ব্রিটেনসহ পশ্চিমা বিশ্বে আবারও বিধিনিষেধ জারি শুরু হয়ে গেছে। হাজার হাজার ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেছে।
প্রতিবেশী ভারতেও টানা পাঁচদিন সংক্রমণের উচ্চগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিশ্বের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখানে উন্নত হলেও ডেল্টার পর ওমিক্রনের চাপে আবার খানিকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, মহামারি শুরু থেকে এ পর্যন্ত ইউরোপে করোনায় সংক্রমিতের সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে। তা গোটা বিশ্বের মোট করোনা আক্রান্তের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি।
আর ওমিক্রনে আক্রান্তের ৬০ শতাংশই ইউরোপে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি সপ্তাহে ২৫ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন। তারা আরও সতর্ক করছেন, ওমিক্রনের সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে তাতে চলতি বছরের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের দৈনন্দিন জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটতে পারে। ওমিক্রনের হাত ধরে করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে ভারতে। লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। মুম্বাই-গোয়ার একটি ক্রুজের ৬৬ জন যাত্রী কোভিড পজিটিভ। অন্যদিকে আতঙ্কের পরিবেশে শিক্ষার্থীদের অফলাইন ক্লাস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে মুম্বাইয়ে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার অফিসগুলোতে বায়োমেট্রিক হাজিরা বন্ধ করে দিয়েছে।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া মানেই বাংলাদেশে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া। তবে আমাদের দেশে ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণে লকডাউন নয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপরই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে চায় সরকার। এ জন্য মাস্কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে। মাস্ক ছাড়া চলাফেরা করা যাবে না। মাস্ক ছাড়া ঘরের বাইরে বের হলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দণ্ড ও জরিমানা গুণতে হবে।
গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়। বিশ্বব্যাপী ওমিক্রন সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া এবং দেশে ভাইরাসটির বিস্তার রোধে এ সভা ডাকা হয়। সভায় সিদ্ধান্তগুলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নির্দেশনা আকারে জারি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ওমিক্রন সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও সংকট অন্যখানে। আমাদের দেশের মানুষ যেন করোনা ভুলতে বসেছে। বিশেষত গণটিকা নেয়ার পরে এটা আরও ভয়াবহ আকার নিয়েছে। করোনায় আমরা কতটা সর্বনাশের মুখোমুখি হয়েছি, তা যেন কারো মনে নেই! আমাদের রাজধানী শহর ঢাকা থেকে অজস্র মানুষ যারা গ্রামে চলে গিয়েছিল জীবন- যাপন সাশ্রয়ের জন্য, যাদের আশা ছিল গ্রাম থেকে আবার শহরে আসবে, আবার ছেলে-মেয়েদের স্কুলে দেবে, তাদের সে আশা পূরণ হয়নি।
গ্রামে বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে। গ্রামে বাল্যবিবাহ বেড়েছে, বেড়েছে পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। সম্প্রতি এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের পর এটা আরও প্রকট হয়েছে। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সব মিলিয়ে আসন রয়েছে ২৬ লাখ ৯ হাজার ২৪৯টি। আর এবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৪৬ জন। সরকারি এই হিসাবেই আসন খালি থাকবে ৫ লাখ ১২ হাজার ৭০৩টি। তাহলে বাকি শিক্ষার্থীরা কোথায়?
এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের বিস্তারের এ সময় বাল্যবিবাহের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্রামীণ পরিবারগুলোতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। যার জন্য বাল্যবিবাহ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সংগঠন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল সংস্থার এক প্রতিবেদন বলছে, গেল বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে জেলায় বাল্যবিবাহর সংখ্যা ছিল ৮ শতাংশ। এপ্রিলে এসে এটি ১ শতাংশ বেড়ে যায়। মে মাসে মোট বিয়ের ১১ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়। এই চার মাসে ধীরে ধীরে নিবন্ধিত বিয়ের সংখ্যা কমছে, বাড়ছে অনিবন্ধিত বিয়ে। আবার এ সময়ে বাল্যবিবাহ ঠেকানোর ঘটনা কমে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে যেখানে ১৪টি বিয়ে ঠেকানো হয়েছিল, মে মাসে সেখানে ঠেকানোর সংখ্যা মাত্র দুই।
সামাজিক শক্তিগুলোর সহযোগিতায় বাল্যবিবাহ কমছিল। কিন্তু করোনার কারণে এই সামাজিক শক্তিগুলোর সক্ষমতা কমতে শুরু করে। সব মিলে একধরনের স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। অর্থাৎ যেসব মানুষ স্কুল-কলেজগামী ছেলেমেয়েদের নিয়ে গ্রামে গিয়েছিল, তাদের আশা ছিল আবার শহরে আসবে। ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে ভর্তি করাবে। তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। সরকার যে প্রণোদনা করোনাকালে দিয়েছিল তাতে এসব পরিবারে তার আঁচ লেগেছিল কি না জানি না। তবে এবারের শূন্য আসন আর বাল্যবিবাহের আধিক্যে বোঝা যায় করোনা কী সর্বনাশ করেছে! আবার সংক্রমণ শুরু হয়েছে।
ইতোমধ্যে ১০ রোগী শনাক্তের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। সংক্রমণের হার চার শতাংশের বেশি। তৃতীয় ঢেউয়ের পথে করোনা। সুতরাং সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে আবার লকডাউন, আবার মানুষ গ্রামে যাবে। অজস্র শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে শিক্ষা থেকে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, বিশেষ করে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। আর লকডাউন চাই না। আর হারাতে চাই না স্কুলগামী শিশু- কিশোরদের দুরন্ত শৈশব। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মধ্য দিয়ে ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন দেশের আপামর জনসাধারণের।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপের সঙ্গে গণপরিবহনে যাত্রী চলাচলের বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করার বিষয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় আলোচনা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এ বিষয়ে বলা হয়, পরিবহন বাসে যাত্রীসংখ্যা কমিয়ে চলাচল করতে হবে। লঞ্চ ও ট্রেনের ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্ত মানতে হবে।
গণপরিবহনে চলাচলকারী যাত্রীদের মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হবে। তবে গণপরিবহন কতসংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও পরিবহন মালিকরা তা নির্ধারণ করবেন। শপিংমল ও দোকানপাট চালু রাখার বিষয়ে বলা হয়, রাত ৮টার পর শপিংমল ও দোকানপাট বন্ধ রাখতে হবে। হোটেল ও রেস্টুরেন্টে বসে খাবার খেতে গেলে তার টিকা কার্ড প্রদর্শন করতে হবে। স্কুল-কলেজ আপাতত খোলা রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে বলা হয়, স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেভাবে ক্লাস ও পরীক্ষা চলছে, তা অব্যাহত থাকবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সব ধরনের পরীক্ষা গ্রহণও অব্যাহত রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু করতে হবে। আমরা মনে করি ওমিক্রন সংক্রমণ এড়াতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক ব্যবহার একান্ত জরুরি। দেশের অর্থনীতি করোনার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই যদি আবার লকডাউন দিতে হয় তাহলে সংকট দৃঢ় হবে। তাই আগে থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোর হলে সংকট এড়ানো সম্ভব। একই সঙ্গে জনসচেতনতা বাড়ানোও জরুরি।
লেখক: গবেষক-প্রবন্ধকার, সাংবাদিক।