সম্প্রতি আমলাতন্ত্র নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘‘আমলাতন্ত্র মন্দ নয়, আমলাতন্ত্র ভালো। আমলাতন্ত্রের বিকল্পও তো নাই। (এর বিকল্প) কেউ বাইর করতে পারে নাই। সোভিয়েতও পারে নাই, চীনারাও পারে নাই; ফেরাউনও পারে নাই, খলিফারাও পারে নাই।” তিনি আরও বলেন, আমিও এক সময় ছোটখাটো একজন আমলা ছিলাম, মনেপ্রাণে এখনও আমলা আছি। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠসময় কেটেছে আমলাতন্ত্রের ভেতরে।
নিজের পেশা নিয়ে সাধারণত ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের শ্লাঘা থাকে। একটা শ্রেষ্ঠত্বের অনুভব থাকে। পেশাকে ঘিরে এ অনুভব মননে গেঁথে দেয়া সুকৌশলে। এ অনুভব একটি সুখানুভূতি। এতে ব্যক্তি পরিতৃপ্ত হন। সুযোগ পেলে অন্যের সামনে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টিকে বিশ্বাসে পরিণত করাতে চান। এ সুপিরিওরিটি ফিলিং বিভক্তির এক বড় সূচক। এ ধরনের অনুভব নিয়ে পেশাদারি মনোভাব গড়ে তোলা কঠিন। এমন পরিস্থিতিতে আমলাতন্ত্র আর জনবিচ্চুতি হয়ে ওঠে সমার্থক শব্দ।
কোনো পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সে পেশাকে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিতে দেখতে পারাটা একটি বিশেষ সক্ষমতা। পেশায় যোগদানের পর ব্যক্তির এ বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতাকে সমূলে বিনাশ করা হয়। নানা প্রশিক্ষণ, অনুশাসন ও নির্দেশনার মধ্য দিয়ে আমূল বদলে দেয়া হয় ব্যক্তির মনোজগতের খোলনলচে। মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের মধ্য দিয়ে তা করা হয় সুনিপুণভাবে।
যেকোনো ধরনের দীক্ষায়ন মানেই ব্যক্তির আমূল পরিবর্তনের আশঙ্কা। তা কখনও ইতিবাচক কখনওবা নেতিবাচক। যেকোনো দীক্ষায়নের অভিঘাত কত গভীরে পড়ে তা আবারও প্রতিভাত হয় মন্ত্রী মহোদয়ের পেশার গৌরবগাথা নিয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। আমলাতন্ত্রে দীক্ষায়ন প্রকৌশল একটি সফল প্রকল্প।
পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত ভাষাবিদ কলিম খান তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ব্যক্তিজীবন সাধনার একটি বিশেষ দিক হলো ‘বরাহকরণ প্রকল্প’-এর আওতাভুক্ত হওয়া। অর্থাৎ একটি বিশেষ প্রাণীর মতো দলবদ্ধ হওয়া। তিনি আরও উল্লেখ করেন- লেখাপড়া শেষে ব্যক্তি অন্যের অধীনস্থ হওয়ার জন্য চাকরি খোঁজেন, চাকরি পান, অধীনস্থ হন এবং খুশি হয়ে মিষ্টি বিতরণ করেন। এটি হলো শিক্ষাদর্শনের একটি বিশেষ দিক, যেখানে বশ্যতা অনিবার্য পরিণতি হয়ে ওঠে। এ বশ্যতার নিচে যে আখ্যান বা ন্যারেটিভ তৈরি হয় তা মুক্ত বা নিরপেক্ষ হতে পারে না। আমলাতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের গল্প পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। শ্রেষ্ঠ যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা হলো জনগণ, তাদের গৌরবগাথা, যাদের পয়সায় চলে রাষ্ট্রকল্পের মেশিনারিজসমূহ। হিরা ফেলে কাচ নিয়ে আলোচনাটা বড় ধরনের ফ্যালাসি।
বর্তমান বা সাবেক আমলাদের বড় একটা সময় পার হয় নিজেদের স্তুতি গেয়ে। এমন কোনো আমলা আপনি পাবেন না যিনি কোনো ছোটখাটো প্রাণী শিকার করেছেন (রূপক অর্থে)। আমলার জীবন মানেই বাঘ শিকারের গল্প, বিশেষ সাফল্যগাথা, বিশেষ গৌরবগাথার গল্প। এ গল্পের নির্মাতা সে নিজে, যার সর্বজনীন কোনো মূল্য নেই, নিছক একান্ত গল্প। কিন্তু গল্প শোনাটা প্রায় বাধ্যতামূলক। আমলাতন্ত্রের ছায়ার নিচে বাস করে এ গৌরবগাথা না শুনে আজ উপায় নেই।
এমন বীরত্বগাথা শুনে কর্মজীবনের একটা অংশ কেটেছে আমার। আমি ভয় পেতাম যদি সাফল্যগাথা একবার শুরু হয় তাহলে এক ঘণ্টার মিটিং দুঘণ্টা না হয়ে যায়। অধীনস্থদের এ বাধ্যতামূলক গল্প শোনা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। আমলাতন্ত্র মানেই চর্বিতচর্বণ। একই গল্প অনেকবার, অনেক ফর্মে। গল্পে গল্পকারের আত্মপ্রসাদ থাকে। কিন্তু নেই কোনো জনতুষ্টি।
আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমলারা স্বয়ম্ভূ বললে অত্যুক্তি হবে না। আমলাদের নৈকট্য ও সখ্য কে না চায় ? কয়েকদিন আগে অফিসে একজন সংসদ সদস্য এসেছেন, প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে দেখা করার জন্য। তিনি কথা প্রসঙ্গে বললেন, গতকাল একই বিমানে সচিব সাহেবের সঙ্গে এসেছেন। কথাটি খুব সাদামাটা। কিন্তু এর গূঢ় অর্থ বিস্তৃত। তিনি সচিব সাহেবের সঙ্গে বিমানে যে এসেছেন তাতে তার চোখেমুখে তৃপ্তির ছাপ দেখলাম। ইমপাওয়ারমেন্ট ফিলিং অনুভব করলাম। রাজনীতিবিদদের আমলাদের সঙ্গে নৈকট্যের নির্ভরতা বেড়েছে। আমার প্রতীতী এর বড় কারণ হঠাৎ গজিয়ে ওঠা রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যাদের রাজনৈতিক পক্বতার সংকট ও রাষ্ট্রাচার বোঝার অক্ষমতা রয়েছে।
আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরতা কেবল রাজনীতিবিদদের নয়। সাবেক ও বর্তমান আমলাদের ওপর নির্ভরতা দেখি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, গণমাধ্যম, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কমবেশি সবার। একবার আমলাতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে ঢুকে গেলে শ্বাস থাকা অবধি তিনি আয়বর্ধক ও দায়িত্বশীল কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন। আমলারা চিরযুবা। আমলাতন্ত্রের ক্ষয় নেই।
এ ক্ষয়হীন আমলাতন্ত্র একটি উত্তরাধিকার ধারা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও পাকিস্তান শোষণের আমলাতন্ত্রের খোলসের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের কাঠামোগত বিন্যাস। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে এগুলোর মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। আগের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো আমরা বহন করে চলেছি। এ আমলাতান্ত্রিক কাঠামো কতটা জনবান্ধব তা নিয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন ও সংশয় রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে অনেক আমলা মানবিক হলেও সার্বিক বিচারে আমলাতন্ত্র একটি হৃদয়হীন কাঠামো।
বাঙালির জাতীয়তাবাদ বইয়ের আমলাতন্ত্র প্রবন্ধে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী উল্লেখ করেছেন- ‘আমলাতন্ত্রকে নিরপেক্ষ মনে করা হয়, যদিও নিরপেক্ষ সে মোটেও নয়, হতেই পারে না, সবসময় সরকারের পক্ষে থাকে, আর সরকার যেহেতু এখন পর্যন্ত কখনোই জনগণের পক্ষে ছিল না, তাই আমলাতন্ত্রের ঝোঁক জনগণের স্বার্থ দেখার দিকে- এমন দাবী করবার উপায় নেই।’… (পৃ.২৯৪) । তিনি একই প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন- আমলাতান্ত্রিক শাসনে জবাবদিহিতা নেই, স্বচ্ছতাও থাকে না। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের দেশের আমলাতন্ত্রে সদস্যদের ভেতর দেশপ্রেম থাকতে পারে, থাকেও, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক গোটা ব্যবস্থাটাই দেশপ্রেমবিবর্জিত। ...
কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিডেল কাস্ট্রো শেখ মুজিবুর রহমানকে নাকি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, নতুন রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের অবস্থা কী হবে এবং পরামর্শ দিয়েছিলেন ওই যন্ত্রকে ভেঙে নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার। বাংলাদেশে ওই কাজটি করা হয়নি।
দুই.
আজ জনগণ আমলাতন্ত্রের নিচে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। আমলাতন্ত্রের বিন্যাস ও প্রভাব জীবনের সর্বক্ষেত্রে। একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে গণতন্ত্রকে নয় বরং আমলাতন্ত্রকে শ্রেষ্ঠ করে তোলা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক মুনশিয়ানা ও দায়বদ্ধতা দুর্বল হতে থাকলে আমলাতন্ত্র যে শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়াবে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। রাষ্ট্রীয় পরিচালন ব্যবস্থায় আমলারা যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তা নিয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদগণ জাতীয় সংসদে উষ্মাও প্রকাশ করেন।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ এমপি জাতীয় সংসদের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স স্মরণ করিয়ে বলেছেন, সংসদ সদস্যরা সচিবদের ওপরে। তিনি উল্লেখ করেন, এখন জেলায় জেলায় দেয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মানুষ মনে করে আমরা যা দেই (করোনাকালে সাহায্য) এটা প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেয়। এটা কিন্তু ঠিক না। একটি রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিক বা জনপ্রতিনিধিদের যে কর্তত্ব তা ম্লান হয়ে যায়।
জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন, আওয়ামী লীগের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে, কারণ দেশে কোনো রাজনীতি নেই। রাজনীতির নামে এখন পালাগানের অনুষ্ঠান হয়। সন্ধ্যার সময় ওবায়দুল কাদের একদিকে পালাগান করেন, একটু পর টিভিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরেকটা পালাগান করেন।
সাবেক আমলা ও বর্তমানে মন্ত্রী এম এ মান্নান আমলাতন্ত্র নিয়ে আত্মশ্লাঘা দেখিয়েছেন। অন্যদিকে রাজনীতিবিদ কর্তৃত্ব হারানো নিয়ে যে উষ্মা তা আমলাতন্ত্রের ভরা বর্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। রাজনীতিবিদদের ন্যারেটিভে রয়েছে অসহায়ত্ব বিপরীত আমলাতন্ত্র নিয়ে স্তুতি কানে বাজছে।
আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ক্রিয়াশীল একটি বিন্যাস। তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী বা চাকুরে। গণতান্ত্রিক কাঠামোর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনায় তাদের কাজ করতে হয়। তারা হচ্ছেন সরকারের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত সত্ত্বা। আমলাতন্ত্র গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর রুলওভার করতে পারে না। এর কোনো ভিত্তি নেই। কারণ, গণতান্ত্রিক কাঠামোর ড্রাইভিং ফোর্স রাজনৈতিক নেতৃত্ব। দিন শেষে জনপ্রতিনিধিদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, আমলাদের নয়।
রাজনীতিবিদরা জনগণের দেয়া ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে কর্তৃত্ব অর্জন করে, এটি শাসনতান্ত্রিকভাবে বৈধ কর্তৃত্ব। তাদের কর্তৃত্বের ভিত্তি জনগণ বা জনমত। আমলাতন্ত্র জনকর্তৃত্বের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হতে পারে না। কিন্তু আজ গণতান্ত্রিক কাঠামো ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে একটা টানাপোড়েন লক্ষ করা যাচ্ছে। আমলাদের কাছে জনপ্রতিনিধিদের অসহায় দেখাচ্ছে। জনগণের সত্যিকার প্রতিনিধিত্ব, রাজনৈতিক পরিপক্বতা, রাষ্ট্রীয় কাঠামো আমলাতন্ত্রের অবস্থান বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া জনপ্রতিনিধিদের বৈধ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব চর্চা সহজ হবে না। ‘মহান’ আমলাতন্ত্র বলে কিছু নেই। এটি আমলাদের তৈরি রেটোরিক।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিশ্লেষক