বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন যে জন্য প্রয়োজন

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স   
  • ৩ জানুয়ারি, ২০২২ ১৩:২৭

নয় মাসে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, দশ মাসে দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করতে পেরেছি। কিন্তু এরপর ৫০ বছর কেটে গেছে, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আজ অবধি একটি স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করতে পারিনি।

আমাদের দেশে গণতন্ত্র বলতে আমরা নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতন্ত্রকেই বুঝি। আমাদের রাজনীতিতে বা সংবিধান অনুযায়ী এর বাইরে জনগণের অবশ্য কোনো ভূমিকাও নেই। স্থানীয় পরিষদ বা সরকারের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হলে নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা জনগণের রাজনৈতিক অধিকার। শুধু এদেশেই নয়, সব দেশে এটাই গণতান্ত্রিক রেওয়াজ। অন্যান্য দেশে হয়তো সংসদ বা আইনসভা আরও বেশি কার্যকর হওয়ায় গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী। কিন্তু আমাদের আছে শুধু ভোট।

ভোটাধিকার প্রয়োগ করা নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার। এদেশে ভোট যেমন একটি উৎসব, তেমনি ভোটের জন্য সহিংসতা ও হানাহানিও কম হয়নি। জাতীয় নির্বাচন শুধু নয়, স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনও এখানে সহিংস রূপ ধারণ করেছে। চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

২০২১ সালে আমরা আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়ের অর্ধশত বছর উদযাপন করলাম। স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় অর্জন একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড- বাংলাদেশ। ৫০তম বছরে যে প্রশ্নটি সবার আগে আসে তা হচ্ছে- যে গণতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সূচনা, সেই চেতনা কি বাস্তবায়িত হয়েছে? আমাদের অর্থনীতি বড় হয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্র ও জনগণের রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের পথযাত্রায় অগ্রগতি কতটুকু এ প্রশ্নটি অতি জরুরি। আগামীর পথ রচনার জন্যই সেটা জরুরি।

টেকসই গণতন্ত্রের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। টেকসই গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা এর প্রমাণ পাই। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকভাবে কাজ করলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিও ধীরে ধীরে পরিশিলীত হয়। পুরোপুরি আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়তো একটি ধারণামাত্র। এর কোনো আদর্শ নজির রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছেও নেই। কাজেই, একটি রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় অঙ্গ বা প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তত গণতন্ত্রমুখী আচরণ করবে এটা প্রত্যাশিত।

আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অঙ্গ। এই তিন বিভাগের ক্ষমতায়ন ও এদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য টেকসই গণতন্ত্রের ভিত রচনা করে। কিন্তু সাংবিধানিকভাবেই এই তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য অনুপস্থিত। আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণ করেছি। এর মাধ্যমে মূলত সাংবিধানিক ও রাজনৈতিকভাবে আমাদের শাসন বিভাগ দিনকে দিন শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু একই গতিতে আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ শক্তিশালী হয়নি। ফলে, সাংবিধানিকভাবেই এখানে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা পায়নি।

পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রপতি চাইলে নির্বাচিত সংসদ ভেঙে দিতে পারতেন। তখন সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী ছিল না। এখন সব রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ক্ষমতা একদিকেই ধাবিত হচ্ছে। ক্ষমতা একদিকে বেশি হওয়া মানে আরেক দিকে কমে যাওয়া। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও শক্তিশালী না হওয়ার পেছনে এটি একটি কারণ।

উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে আইন বিভাগ শাসন বিভাগকে ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টকেও সিনেটে জবাবদিহি করতে হয়। তিনি অনেক রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিলেও দিনশেষে সিনেটে সেগুলো পাস করাতে না পারলে তার সে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আইনসভা ও শাসন বিভাগের মধ্যে এই ভারসাম্যই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

উদীয়মান বা নিবু নিবু গণতন্ত্রে আমরা দেখি শাসন বিভাগ আইনসভাকে ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করে। সংসদকে দিয়ে শাসন বিভাগ তার প্রয়োজনমতো আইন পাস করিয়ে নেয়। আবার প্রয়োজন না হলে ৫০ বছরেও কোনো কোনো আইন পাস হয় না। ক্ষমতায় কোন দল আছে সেটি বড় কথা নয়। দল নির্বিশেষে এদেশে এটিই বাস্তবতা। প্রয়োজনে একরাতের মধ্যেও আইন হতে পারে, আবার প্রয়োজনেই সেই আইনই আলোর দেখা পায় না।

আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করলাম। নয় মাসে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, দশ মাসে দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করতে পেরেছি। কিন্তু এরপর ৫০ বছর কেটে গেছে, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আজ অবধি একটি স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করতে পারিনি।

আইন ‍প্রণয়ন হলেই যে নির্বাচন কমিশন জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারবে বিষয়টি সেরকম নয়। তবে মূল কথা হচ্ছে, যেহেতু সংবিধানে এরকম একটি আইন করার কথা বলা আছে, সেহেতু সে আইন না থাকা মানে সংবিধানের ব্যত্যয়। আর যদি আইন প্রণয়নের প্রয়োজন না-ই হয়, তবে সংবিধানে ওই বিধান রাখার দরকার কী?

সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদ বলছে-

“প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।”

এখানে আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ করবেন- এটাই বিধান। এটি রাষ্ট্রপতির জন্য ঐচ্ছিক বিষয় নয়, বাধ্যতামূলক। তাকে আইনের বিধান অনুসরণ করেই কমিশন গঠন করতে হবে। যেহেতু আইন নেই তাই রাষ্ট্রপতি আইন ছাড়াই কমিশন গঠন করছেন। আইন করা আইনসভার কাজ। আইন না থাকায় রাষ্ট্রপতি তার নিজের বিবেচনামতো কখনও সংলাপ করে কখনও সংলাপ ছাড়া কমিশন গঠন করছেন।

আইন প্রণয়ন না হওয়ায় সংবিধানের এরকম আরও একটি বিধান আজও কার্যকর হয়নি। সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ন্যায়পাল আইন আজও প্রণয়ন করা হয়নি। ৭৭ (১) অনুচ্ছেদ বলছে-

“সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ-প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে পারিবেন।” এ বিধানটি সংসদের জন্য ঐচ্ছিক, মানে সংসদ বিধান করতেও পারে আবার না-ও পারে।

কিন্তু কমিশনার নিয়োগ করতে হলে রাষ্ট্রপতিকে আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষেই করতে হবে। এটাই সংবিধানের বিধান। সে আইন থাকায় রাষ্ট্রপতি এখন সংলাপ করছেন। সংলাপ আইনের বিকল্প নয়, আবার সংলাপ করতে আইনত কোনো বাধাও নেই। আবার আইন হওয়ার পরেও রাষ্ট্রপতি সংলাপ করতে পারবেন, যদি আইনে নিষেধ করা না হয়। কাজেই, সংলাপ করে রাষ্ট্রপতি একটি কমিশন গঠন করতে পারেন, এটি তার জন্য ঐচ্ছিক একটি বিষয়। সংলাপ হয়তো তার ওপর অর্পিত দায়িত্বটি পালন করতে তাকে সাহায্য করবে।

সংলাপে তিনি হয়তো একটি দিকনির্দেশনা বা পরামর্শ পাবেন। কিন্তু সংলাপের মাধ্যমে তিনি যা-ই মনস্থির করুন না কেন সেটি বাস্তবায়ন তার ইচ্ছাধীন নয়। রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ এখানেও রাষ্ট্রপতির ওপর ক্ষমতাশালী। কাজেই, ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা কেবল রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মধ্যেই নয়, একই বিভাগের মধ্যেও বিদ্যমান। তাই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেও ক্ষমতার ভারসাম্য প্রয়োজন।

এক রাতেই আইন করা যায়। তবে সংসদীয় রেওয়াজ মেনে আইন করতে সময় লাগে। সে সময় হাতে নেই। ফেব্রুয়ারিতে কমিশন গঠন হলে এখন আইন করে সেটি সম্ভব নয়। ১৬ জানুয়ারি বসছে বছরের প্রথম অধিবেশন। তাই হাতে সে সময় নেই। কিন্তু বর্তমান সংসদ বহাল থাকাকালীন এরকম একটি আইন হতে পারে।

আইনের মাধ্যমে কমিশন গঠন হলেই যে কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হবে; সে রকম না-ও হতে পারে। সংলাপের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সংলাপের মাধ্যমে যে গ্রহণযোগ্য কমিশন গঠন সম্ভব নয়, সেটিতো প্রমাণিত। এর আগে আরও দুবার সংলাপ হয়েছে। সেই কমিশনের অধীনে সংঘটিত দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচন ও অনেক স্থানীয় নির্বাচনে যা দৃশ্যমান হয়েছে তাতে ভোট কেমন হয়েছে তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। নূরুল হুদা, রকিব উদ্দিন, সাদেক অথবা আজিজ কমিশন নির্বাচন কমিশনের মডেল হতে পারে না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কোনো বিকল্প হতে পারে না। যদিও তারা চারটি (’৯০-এর অস্থায়ী সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ) নির্বাচন সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন করতে পেরেছে। কিন্তু ২০১১ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের সংক্ষিপ্ত রায় ও অতঃপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল-সংক্রান্ত আইন পাসের মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করা হয়। কাজেই, এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনই একমাত্র সাংবিধানিক বিকল্প। সে পথেই আমাদের সমাধান খুঁজতে হবে।

স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে গণতন্ত্র ও সুশাসনকে সুযোগ দিতে হবে। সেজন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনগণের কাছে আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আস্থাভাজন নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমেই এ কাজটি শুরু হতে পারে।

গণতন্ত্র, সুশাসন ও উন্নয়নই আমাদের আজকের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা। স্বাধীনতার অর্ধ শতকে আমাদের অর্জনকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু গণতন্ত্র ও সুশাসন রাজনৈতিক বিষয়, রাজনীতিকদের বিষয়। সুশাসনের জন্য কিছুটা সময় লাগলেও গণতন্ত্র ঠিক থাকলে সুশাসন ধীরে ধীরে আসবেই। সে জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর