বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিষফোড়া থেকে ক্যানসার!

  •    
  • ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৪:০০

কদিন আগে বিভিন্ন পত্রিকায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার মুদ্রিত মুদ্রা চালুর খবর এসেছে। সেই মুদ্রায় আরসার নেতা আতাউল্লাহর ছবিও আছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ভিন্ন একটি মুদ্রা প্রচলনের চেষ্টা ভয়ংকর ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। এখনই সতর্ক না হলে রোহিঙ্গা নামের বিষফোড়াটি একদিন বাংলাদেশের জন্য নিরাময় অযোগ্য ক্যানসারে রূপ নিতে পারে।

একাত্তরে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত খোলা মনে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, খুলে দিয়েছিল তাদের সীমান্ত। বাংলাদেশ থেকে কোটি শরণার্থী ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। অবশ্য বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর শরণার্থীদের প্রায় সবাই ফিরে এসেছিলেন বাংলাদেশে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশ নিজেদের দুর্দশার কথা ভুলে যায়নি। তাই বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে।

স্বাধীনতার পর থেকেই আটকেপরা পাকিস্তানিদের ভার বহন করছে বাংলাদেশ। ৭০-এর দশকের শেষ দিক থেকে বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসে। বিভিন্ন সময়ে তাদের অনেকে ফিরেও গেছেন। তবে ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের যে ঢল নামে তা নজিরবিহীন। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট এবং জনবহুল দেশ চার বছর ধরে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বহন করছে, সত্যিকার অর্থে যে সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই।

২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গারা যখন প্রাণভয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসছিল, তখনকার পরিস্থিতিটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তাদের স্বাগত জানিয়েছেল। শুধু রাষ্ট্র নয়, অধিকাংশ নাগরিকও যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। অনেকে ধর্মীয় বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। শুধু রোহিঙ্গা বলে নয়; বিশ্বের যেখানেই মুসলমানরা নির্যাতিত হবে; সেটা কাশ্মীর হোক, চীন হোক, প্যালেস্টাইনে হোক; তাদের পাশে বাংলাদেশ সবসময় আছে। শুধু মুসলমান বলে নয়- যেখানেই মানবতা নির্যাতিত হবে, নিপীড়িত হবে; মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তাদের পাশে থাকবে। কিন্তু পাশে আর ১০ লাখ লোকের ভার বহন এক কথা নয়।

রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর আরও অনেক দেশই মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছিল, বাংলাদেশের মানবিক ভূমিকার প্রশংসা হয়েছিল বিশ্বজুড়ে। কিন্তু আজ চার বছর পর বাংলাদেশের পাশে আর কেউ নেই। মানবিকতার সব দায় যেন বাংলাদেশের একার। রোহিঙ্গাদের পক্ষে যখন দেশজুড়ে প্রবল জনসহানুভূতি, তখনও আমি লিখেছিলাম- ‘মানবিক থেকে পারমাণবিক’। তখনই আমার শঙ্কা ছিল, রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের এই মানবিকতা একদিন পারমাণবিক বোমার মতো ভয়াবহতা নিয়ে আসবে আমাদের জন্য। চার বছর পর আজ বলতেই হচ্ছে, রোহিঙ্গা সমস্যা আমাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ভয়াবহ এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুব শিগগিরই যে সমস্যা সমাধানের কোনো ইঙ্গিত নেই। যত দিন যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য সমস্যা তত জটিল হচ্ছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগ তত কমছে।

চার বছর আগে মিয়ানমার প্রসঙ্গ এলেই সবাই রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলত। আর এখন মিয়ামনার প্রসঙ্গ এলেই সেনাবাহিনীর আগ্রাসন, অং সান সুচির গ্রেপ্তার নিয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসা রোহিঙ্গা সংকট এখন বিশ্ব সিলেবাসের বাইরে। তবে এই চার বছরে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলে, আদালতে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা কম হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা হলো- সমাধান প্রশ্নে এক ইঞ্চি অগ্রগতিও হয়নি। একজন রোহিঙ্গাও ফিরে যাননি।

ফিরে যাননি বলার চেয়ে, ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি বলাই ভালো। মিয়ানমার ফিরিয়ে নেয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের তাড়ায়নি। মিয়ানমার সবসময় দাবি করে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে সেখানে গেছে। তাই তারা কখনো রোহিঙ্গাদের স্বীকারই করেনি। মিয়ানমারের মূল লক্ষ্য ছিল আরাকান রাজ্যকে রোহিঙ্গাশূন্য করা। সেই লক্ষ্যে তারা অনেকটাই সফল। রোহিঙ্গাদের দেশচ্যুত করার সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরাকানের গ্রামের পর গ্রাম মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। রোহিঙ্গারা ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেলেও গিয়ে নিজেদের ভিটা আর খুঁজে পাবে না, সবকিছু মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। মিয়ামনার একটি আস্ত রাজ্য খালি করে ফেললেও আন্তর্জাতিক মহল তাদের ঠেকাতে পারেনি। এখন সব মানবাধিকার রক্ষার দায় বাংলাদেশের।

রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে না চাইলে, তাদের জোর করে পাঠানো যাবে না। শুধু ফিরে যাওয়াটাই যে তাদের ইচ্ছায় হতে হবে, তাই নয়। বাংলাদেশে তারা কোথায় থাকবে, সেটাও তাদেরই মর্জি অনুযায়ী হতে হবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচর নামে আস্ত একটি দ্বীপ দিয়ে দিয়েছে। সেখানেই জীবনযাপনের আধুনিক ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিদর্শন শেষে সার্টিফিকেট দেয়ার পরও রোহিঙ্গাদের অনেকে সেখানে যেতে চান না। শুধু যারা স্বেচ্ছায় যেতে চেয়েছেন, তাদেরই সেখানে পুনর্বাসন করা হয়েছে। টেকনাফ বা ভাসনচর যেখানেই থাকুক রোহিঙ্গাদের সর্বোচ্চ মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের কত মানুষ না খেয়ে থাকে, কত মানুষের মাথা গোজার ঠাঁই নেই। তা নিয়ে বিশ্বের কারো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে জেগে ওঠে বিশ্বমানবতা।

রোহিঙ্গা সংকটের শুরু দিকে যেসব আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তা অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। টেকনাফের মানচিত্রই পাল্টে যাওয়ার দশা। টেকনাফের পরিবেশের বারোটা বেজেছে অনেক আগেই। সবচেয়ে বড় শঙ্কাটা ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। নির্যাতিত, নিপীড়িত, ঘরছাড়া, দেশহারা, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া একটি জনগোষ্ঠী নানারকম বেআইনি তৎপরতায় জড়িয়ে যাবে; এটা অস্বাভাবিক নয়।

রোহিঙ্গারা এখন চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যাচ্ছে। নানা জঙ্গী তৎপরতার খবরও আমাদের শঙ্কিত করে। গত চার বছরে শতাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তার মধ্যে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় হয়েছে রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ড নিয়ে। মহিবুল্লাহ বরাবরই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে ছিলেন। যারা প্রত্যাবাসন চায় না, তারাই মহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে। অভিযোগের তির রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরসার দিকে। বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার উপস্থিতির কথা স্বীকার না করলেও আরসা রীতিমতো শিকড় গেড়ে বসেছে।

কদিন আগে বিভিন্ন পত্রিকায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার মুদ্রিত মুদ্রা চালুর খবর এসেছে। সেই মুদ্রায় আরসার নেতা আতাউল্লাহর ছবিও আছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ভিন্ন একটি মুদ্রা প্রচলনের চেষ্টা ভয়ংকর ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। এখনই সতর্ক না হলে রোহিঙ্গা নামের বিষফোড়াটি একদিন বাংলাদেশের জন্য নিরাময় অযোগ্য ক্যানসারে রূপ নিতে পারে। আন্তর্জাতিক মহলের মানবাধিকার প্রায়োরিটিতে রোহিঙ্গা এখন অনেক পেছনে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তা এক নম্বর। তাই সব মহলের কাছে সর্বোচ্চ চেষ্টা নিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর