বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মনোনয়ন-বিতর্ক কেন এড়ানো গেল না

  • রাজন ভট্টাচার্য   
  • ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৫:৫০

প্রশ্ন হলো- মনোনয়ন নিয়ে এত বিতর্ক কেন? ভুল যদি হয়েও থাকে, এর পরিমাণ এত বেশি হতে পারে? এ ছাড়া মনোনয়ন নিয়ে কি বিতর্ক এড়ানো যেত না? প্রথম থেকে চতুর্থ দফা পর্যন্ত ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। কোনো পর্বে কম, কোনো পর্বে বেশি। অথচ প্রথম দফা মনোনয়নের পর আওয়ামী লীগের এ ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এত ভুল প্রমাণ করে মনোনয়নে দায়িত্বশীলতা ও যত্নের অভাব ছিল।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের জেলেপল্লিতে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনায় জড়িত আঁখি চেয়ারম্যানসহ চারজন এবারের প্রথম পর্বের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তাদের নৌকা প্রতীক বরাদ্দের পর বিষয়টি গণমাধ্যমে এলে এ নিয়ে সারা দেশে তুমুল সমালোচনা হয়। বিতর্কের মুখে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের মনোনয়ন বাতিল করে ক্ষমতাসীন দল।

বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে দলের শীর্ষ নেতাদের মুখে দুঃখ প্রকাশের সুরও শোনা গেছে। যুদ্ধাপরাধীর আত্মীয়, বিএনপি-জামায়াত নেতা, ধর্ষণ মামলার আসামি, দখলবাজসহ নানা অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিরাও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ায় গণমাধ্যমে সমালোচনা হয়েছে।

বিতর্কিত ব্যক্তিদের কিছু নাম পরিবর্তন করা হলেও বেশির ভাগ রয়ে গেছে। এর বাইরে ইউপি নির্বাচনে এলাকার ত্যাগী ও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিদের মনোনয়ন না দেয়ার বিতর্ক তো রয়েই গেছে। যার ধারাবাহিকতায় প্রতিটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী দেখা গেছে। ফলাফল, এখন পর্যন্ত বিদ্রোহী প্রার্থীরাই বেশির ভাগ ইউনিয়নে বিজয়ী হয়েছেন।

অনেক আগে থেকেই দাবি উঠেছিল, বিএনপি যেহেতু স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে তাই ইউপি নির্বাচন যেন উন্মুক্ত থাকে। দলের সভানেত্রীকে এই সুপরামর্শটুকু কেউ দেয়নি। হয়তো বলার সাহস নেই, নয়তো ব্যক্তিস্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয় ছিল।

মূল সমস্যা হলো- তিন ধাপ নির্বাচনের পরও মনোনয়ন নিয়ে বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি আওয়ামী লীগ। শেষ ধাপেও পিছু ছাড়েনি বিতর্ক, যা সত্যিই দুঃখজনক ও পরিতাপের বিষয়। প্রতিটি ধাপেই মনোনয়ন কেলেঙ্কারি বেরিয়েছে।

পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতীর বিভিন্ন ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ দেখা গেছে। উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে বিএনপি নেতা ও মাদক মামলার আসামিকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দেয়ায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ উপজেলার ধানশাইল ইউনিয়নের নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে ইউনিয়ন ছাত্রদলের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও মাদক মামলার আসামি তৌফিকুর রহমান এনামুলকে।

হাতীবান্ধা ইউনিয়নে ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সদস্য ওবাইদুল ইসলামকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দেয়ায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। একইভাবে কাংশা ইউনিয়নের বিএনপির সাবেক সভাপতির ছেলে জহুরুল ইসলামকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঝিনাইগাতী সদর ইউনিয়নে তার বাবা গত বছর নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় এবার ছেলেকে দেয়া হয়েছে দলীয় প্রতীক।

এদিকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার ভাতগ্রাম ইউনিয়ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেন সিদ্দিকী। এখানেই শেষ নয়, আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হলো- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি খন্দকার মুশতাকের আত্মীয় পেয়েছে আওয়ামী লীগের দলীয় নৌকা প্রতীক। কুমিল্লার লালমাই উপজেলার ৬ নম্বর পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক পাওয়া ওই ব্যক্তির নাম খন্দকার সাইফুল্লাহ। খন্দকার সাইফুল্লার ছোট চাচা আবু জাফর খন্দকার বিয়ে করেন বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মুশতাকের আপন ভাগ্নি আমাতুল শারমিন খন্দকারকে।

পঞ্চম ধাপে ৭০৭ ইউপি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে আগামী বছরের ৫ জানুয়ারি। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বাঁশতৈল ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আতিকুর রহমান। ২০১২ সালের ১৭ জুলাই গাজীপুরের ভোগড়া থেকে চিকিৎসক এ এন এম মনিরুল হুদার (রুপম) লাশ উদ্ধার করা হয় তারই ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে। ওই চিকিৎসক হত্যা মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন।

যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউপিতে হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি সেলিম রেজাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের মার্চে ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার নয়ারহাট এলাকায় আওয়ামী লীগের কর্মী আবদুর রহিম গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ওই ঘটনায় পারভেজ দেওয়ানকে প্রধান আসামি করে আশুলিয়া থানায় মামলা করে নিহতের পরিবার। পরে তাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। ওই হত্যা মামলার অভিযোগপত্রেও তার নাম আছে। সেই পারভেজ দেওয়ান সাভারের পাথালিয়া ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন।

সাভারের আশুলিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন শাহাব উদ্দিন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করেছিলেন এক তরুণী। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে আনাইতারা ইউপির চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে ভিজিএফের চাল আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। তিনিও এবার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন।

চাল আত্মসাৎসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া ভোলা সদরের রাজাপুর ইউপির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খান আবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। রাজশাহীর বাগমারার গোয়ালকান্দি ইউপিতে মনোনয়ন পাওয়া বর্তমান চেয়ারম্যান আলমগীর সরকারের বিরুদ্ধে কর্মসৃজন কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।

বাগমারা উপজেলার ঝিকড়া ইউপিতে এবারও মনোনয়ন পেয়েছেন আবদুল হামিদ ফৌজদার। তার বিরুদ্ধে করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবারের জন্য এককালীন আড়াই হাজার টাকার নগদ সহায়তা কার্যক্রমের তালিকা তৈরিতে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ছিল।

প্রশ্ন হলো- মনোনয়ন নিয়ে এত বিতর্ক কেন? ভুল যদি হয়েও থাকে, এর পরিমাণ এত বেশি হতে পারে? এ ছাড়া মনোনয়ন নিয়ে কি বিতর্ক এড়ানো যেত না? প্রথম থেকে চতুর্থ দফা পর্যন্ত ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। কোনো পর্বে কম, কোনো পর্বে বেশি। অথচ প্রথম দফা মনোনয়নের পর আওয়ামী লীগের এ ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এত ভুল প্রমাণ করে- মনোনয়নে দায়িত্বশীলতা ও যত্নের অভাব ছিল।

সার্বিকভাবে যদি বলা যায়, রাজনৈতিক প্রভাবের বলয়ে অনেক ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো রকম বিচার-বিশ্লেষণ পর্যন্ত করা হয়নি। এটা ঠিক হয়নি। ব্যক্তির স্বার্থের চেয়ে দলের স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেয়া উচিত ছিল।

অভিযোগ আছে, দলের ধানমন্ডি কার্যালয়ে সভানেত্রী বরাবর যেসব অভিযোগ জমা পড়েছিল তাও দেখা হয়নি। আলোচনা এমনও আছে যে বেশির ভাগ অভিযোগ রেকর্ড পর্যন্ত করা হয়নি। ফেলে দেয়া হয়েছে। যদি জমাকৃত অভিযোগের ২০ ভাগ আমলে নেয়া হতো, তাহলে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে হয়তো অনেক বিতর্ক এড়ানো যেত।

মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে সব দলেরই শৃঙ্খলা ও নিয়মকানুন থাকবে- এটা প্রত্যাশিত। যাতে যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন পায়। দুর্ভাগ্যবশত এখন প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে একটি সিন্ডিকেটের মতো কাজ করে। টাকাপয়সার লেনদেন বা প্রভাবের কারণে অনেক মনোনয়ন দেয়া হয়।

এখন নির্বাচনের ক্ষেত্রে যোগ্যতা-সততা ও জনকল্যাণ গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু দিনশেষে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের কাছ থেকে দেশবাসী বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন আশা করে না। এ ক্ষেত্রে খন্দকার মুশতাকের আত্মীয়কে মনোনয়ন দেয়া মানেই জাতির পিতার প্রতি অমর্যাদা দেখানো।

ধর্ষণ ও হত্যা মামলার আসামি, শ্মশান দখলকারী আর যুদ্ধাপরাধীর স্বজন যদি মনোনয়ন পায়, তাহলে সমাজের ভালো মানুষগুলো আরও বেশি মুখ ফিরিয়ে নেবে। নীরবে-নিভৃতে তারা ঘরে ফিরে যাবে। এতে সমাজের অনেক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই মনোনয়ন বিতর্ক এড়িয়ে আরও সতর্ক হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে হাঁটবে আওয়ামী লীগ- এটাই সময়ের প্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর