ফ্রান্সে স্ত্রী-সন্তান থাকার বিষয়টি গোপন রেখেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলার ছাত্রী এলমা চৌধুরী মেঘলাকে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন ইফতেখার আবেদীন চলতি বছরের এপ্রিলে। অর্থবিত্তে এগিয়ে থাকা ইফতেখারের ব্যাপারে শুরু থেকেই এলমার পরিবারের আপত্তি ছিল। তবুও মেয়ের ইচ্ছার কাছে হার মানতে হয় তাদের। আর বিয়ের ৮ মাসের মাথায় স্বামীর নিষ্ঠুরতার কাছে হার মানতে হয় এলমাকে। ১৪ ডিসেম্বর স্বামী ইফতেখারের বনানীর বাসায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাকে। অভিযোগ সেই স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির দিকে। জানা যায়, বিয়ের পরদিন থেকেই নির্যাতন করা হতো এলমাকে।
তার বিভাগের শিক্ষকেরা বলেছেন, সদা প্রাণবন্ত আর উচ্ছল তরুণীটিকে বিয়ের পরই চোখের সামনে বদলে যেতে দেখেছেন তারা। প্রভাব এবং বিত্তের জোরে এলমার স্বামী তার পড়াশোনা, বাবার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়াও বন্ধ করেছে। বন্ধু দূরের কথা, বান্ধবীদের সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ করতে বাধ্য করেছে। একদিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেও পুরো সময় ভিডিও কলে ওয়াচ করেছে দেশের বাইরে থেকে। নৃত্যকলার ছাত্রীকে বাধ্য করেছে বোরকা পরতে। এত অবিশ্বাস আর অসম্মান নিয়ে স্বাভাবিক জীবন কোনোমতেই চলে না। তাই মৃত্যুর কাছে পরাজিত হলো মেধাবী এলমা।
শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন সইতে না পেরে এ বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা শহরের নয় তলা ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন ৩২ বছর বয়সি ইভানা লায়লা চৌধুরী। স্কলাস্টিকার মতো প্রথম সারির ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের ক্যারিয়ার গাইডেন্স কাউন্সেলর ছিলেন ইভানা। ব্যারিস্টার স্বামী আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসানের নির্যাতন এবং পরকীয়ার কারণে দুই শিশু সন্তান রেখেই আত্মহত্যা করেন তিনি। দুই সন্তানের ছোটটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। এই অটিস্টিক শিশু জন্ম দেয়ার জন্যও দায়ী করা হতো ইভানাকে। বিয়ের জন্যই বিত্তশালী পরিবারের এই মেয়েকে ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল।
চট্টগ্রামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি-পড়ুয়া মাহমুদা খাতুন আঁখিকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে তার আইনজীবী স্বামী। লোহার রড দিয়ে পেটে আঘাত করলে খাদ্যনালী ছিঁড়ে যায় আঁখির। ১৯ ডিসেম্বর গুরুতর আহত আঁখি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
প্রাচীনকাল থেকেই নারীর ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন-নির্যাতন যেন অনিবার্যভাবে চলে আসছে। এসব কোনোভাবে বন্ধ তো হচ্ছেই না, বরং কমারও উল্লেখযোগ্য লক্ষণ দেখা যায় না। বর্তমান সামাজিক কাঠামোতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণিপেশার নারীই কমবেশি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
যৌতুক-পরকীয়া, বিয়ের পর পড়াশোনা করতে না দেয়া, চাকরি করতে বাধা, সংসারে মনোযোগী না হওয়া, শ্বশুরবাড়ির মানুষের মন জুগিয়ে চলতে না পারা, যৌন-সম্পর্ক স্থাপনে অনাগ্রহ, বাবার বাড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা, বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা; এমন হাজারও কারণে সহিংসতা হয় নারীর ওপর। তবে নারীকে অবদমন করে রাখাই নারীর প্রতি সহিংসতার মূল উদ্দেশ্য।
পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের কবলে পড়ে সমুদ্রের বিপুল ঢেউয়ের বিরুদ্ধে সাঁতরে নারী আসলেই টিকে থাকতে পারছে না। আধিপত্যবাদের এই কাঠামো পরিবর্তন করতে না পারার কারণেই এলমা, মাহমুদা বা ইভানা লায়লা চৌধুরীদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনও যাচ্ছে। উল্লিখিত তিন নারীই সমাজের এগিয়ে থাকা অংশের প্রতিনিধি, তবুও তারা বাঁচতে পারেনি।
তাদের আত্মহত্যা, হত্যা বা বিবাহ ইত্যাদি নিয়ে নানা মত আছে। আছে চুলচেরা বিশ্লেষণও। ইভানার ক্ষেত্রে বলা হয় স্বামীর সঙ্গে না মিললে ডিভোর্স নিতে কিংবা আলাদা থাকতে পারত, কিন্তু আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে ঠিক করেননি। এলমার ক্ষেত্রে বলা হয় উচ্চাভিলাষী হয়ে বাছবিচার না করেই বিত্তশালী ব্যক্তিকে বিয়ে করা উচিত হয়নি।
অনেক কিছুই উচিত হয় না। আমরা সবসময় উচিত-অনুচিত আর সত্য-মিথ্যার ফারাক বুঝতে পারি না। নারী নিজেরা যেমন পারে না, বেশিরভাগ সময় পরিবারগুলোও বোঝে না। তবে এই বুঝতে না পারার জন্যই কি অমানুষিক নির্যাতন বা হত্যা করতে হবে, আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে হবে?আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না কার মনে কেমন ঝড় ওঠে। নির্যাতন-অবিশ্বাস আর ভালোবাসাহীনতায় একজন নারী ক্রমে ধ্বংসের দিকে যায়। প্রতিনিয়ত তার দিকে আঙুল তুললে কতক্ষণ আর নিজেকে সামলে রাখা সম্ভব? তালাকের পর নাজুক মানসিকতার কারণে বিরূপ পরিস্থিতির মোকাবিলা করা বেশিরভাগ নারীর পক্ষেই সম্ভব হয় না।
এখনও আমাদের সমাজ বিচ্ছেদকে ভালো চোখে দেখে না। পরিবার-সমাজ সবখান থেকে মেয়েটিকেই দোষারোপ করা হয়; যেন মেয়েটির কারণেই সংসার ভেঙেছে। বাবার বাড়ি থেকেই মেনে নেয়ার চাপটা বেশি আসে। সচরাচর একটা কথা শোনা যায়, ‘মেনে নাও’। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু হায়! সময় যায়, মেনে নিতে নিতে জীবনও যায়। সমাধান আসে না।
মেয়েটি সহ্য করতে করতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় জীবন ছেড়ে দেয় নিয়তির হাতে। ততদিনে সে বুঝে যায়, শখ-আহ্লাদ আর আদর-ভালোবাসা তার জন্য নয়; প্রাণটা নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে এটাই ঢের। এভাবেই এক সময় চলে আসে বার্ধক্য। অনেকটা বেঁচে থাকতে থাকতে মরে যাওয়া অথবা মরার মতো বেঁচে থাকা। কারণ ততদিনে প্রতিবাদ করার শেষ শক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে আসে।
একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা বলছে, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ৮৩ শতাংশ নারী। জীবনসঙ্গী বা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার এই নারীরা বিবাহবিচ্ছেদ কিংবা আরও নির্যাতনের ভয়ে সহজে কোনো পদক্ষেপ নিতে চায় না। তবুও কেউ কেউ প্রতিবাদ করে। যার কারণে শারীরিক নির্যাতন হয় তাদের নিত্যসঙ্গী। প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, পারিবারিক ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার ২০০ নারীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭৩ জনকে শারীরিক নির্যাতনের কারণে চিকিৎসা নিতে হয়। চিকিৎসা নিয়ে শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিক আঘাত রয়ে গিয়েছে। সেই আঘাত দূর করার কথা কেউ ভাবে না।
শারীরিক নির্যাতন তো দূরের কথা, কাউকে মানসিকভাবে নির্যাতন করাও যে একটি গুরুতর অপরাধ; এ বিষয়ে ধারণাই নেই অধিকাংশ পুরুষ এমনকি নারীরও। স্বামীর হাতে মার খাওয়াকে যৌক্তিক বলে মনে করে অনেক নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাল্টিপল ইন্ডিকেটর সার্ভে ২০১৯-এ ওঠে এসেছে, দেশের প্রতি ৪ জন বিবাহিত নারীর একজন স্বামীর হাতে মার খাওয়াকে যৌক্তিক বলে মনে করে। অর্থাৎ, পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের এ মানসিকতা যে শুধু পুরুষকেই অপরাধী হিসেবে গড়ে তুলছে তা কিন্তু নয়; বরং তা নারীর মধ্যেও পুরুষের অপরাধকে যৌক্তিক বলে মেনে নেয়ার মানসিকতা তৈরি করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি জরিপ বলছে, দেশে স্বামীর দ্বারা কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হয় ৮৭.০৭% নারী। এর মধ্যে ৮১.০৬% মানসিক, ৫৩.০২% অর্থনৈতিক, ৩৬.০৫% যৌন আর ৬৪.০৬% নারী শারীরিক নির্যাতন ভোগ করে। আর নির্যাতনকারী পুরুষের অধিকাংশই এসব নির্যাতনকে নির্যাতন হিসেবে স্বীকারই করে না, বরং যেকোনো উপায়ে স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণে রাখাকে তারা তাদের অধিকার বলে মনে করে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের এ ধরনের অপরাধের জন্য নিজেকে অপরাধী ভাবার কোনো প্রশ্ন ওঠে না।
নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, নারীর প্রতি পুরুষের সহিংস আচরণ কীভাবে পুরুষকে অমানবিক ও হিংস্র করে তুলছে, সে সম্পর্কে পুরুষকে জানতে ও বুঝতে সহায়তা করা। অধিকার এবং অপরাধের ফারাক স্পষ্ট করা জরুরি। সহিংস আচরণের জন্য পুরুষকে লজ্জিত ও অনুতপ্ত করানোই হতে পারে নারীর প্রতি সহিংসতারোধের প্রথম পদক্ষেপ।
অপরাধকে চিনতে না শিখলে অপরাধমুক্ত থাকার চিন্তাও জন্ম নেবে না।আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নে খানিকটা অগ্রগতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সহিংসতা প্রতিরোধে নারী-আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন ও সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ রয়েছে। তা সত্ত্বেও নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা ও ভয়াবহতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।সহিংসতা বন্ধের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে।
এরমধ্যে পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত সংস্কৃতিচর্চা, নারীর জন্য ক্ষতিকর প্রথা (বাল্যবিবাহ, যৌতুক, পারিবারিক সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত সালিশি কার্যক্রম ও বহুবিবাহ) বন্ধ করা, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন ও বিচারিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে নারীবান্ধবের পাশাপাশি জেন্ডার সংবেদনশীল করে তোলা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-কর্মস্থলে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নরোধে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে আইন প্রণয়ন ও বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন পরিবর্তন করে সব নাগরিকের সম-অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অভিন্ন পারিবারিক আইন চালু করা উল্লেখযোগ্য।
নারীকে জেগে উঠতে হবে আপন শক্তিতেই। নইলে এলমা, মাহমুদা আর ইভানাদের মতো জীবনটাই খোয়াতে হবে। রবিঠাকুরের ভাষায় বলতে চাই-“ভয় হতে তব অভয়মাঝে নূতন জনম দাও হে।দীনতা হতে অক্ষয় ধনে, সংশয় হতে সত্যসদনে,জড়তা হতে নবীন জীবনে নূতন জনম দাও হে।”
লেখক: শিক্ষক-প্রাবন্ধিক