অতিক্রান্ত হতে চলেছে ২০২১, ২০২২ সময়ের দরজায় কড়া নাড়ছে। আর মাত্র ৪দিন, তারপর খ্রিস্টাব্দের নতুন বছর বরণ করে নেবে বিশ্ববাসী। করোনা মহামারিজনিত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বর্ষবরণে উৎসাহ উদ্দীপনায় এতটুকু ঘাটতি নেই। এই একটি প্রসঙ্গ থেকেই আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি সেই চিরসত্য যে, শত বিপর্যয়েও থেমে থাকে না জীবনের পথচলা। কেননা গতিতেই জীবন।
সময়ের সেই গতিপ্রবাহেই ২৫ ডিসেম্বরও অতিক্রান্ত হলো। বাংলাদেশসহ বিশ্বেব্যাপী উদযাপিত হলো খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব বড়দিন। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহটিকে আলোকিত করা বড়দিনের উৎসব করোনাজনিত সতর্কতার বিধিনিষেধের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অপার আনন্দের আমেজ ছড়িয়ে গেছে। বিলম্বিত হলেও বলতেই হয় শুভ বড়দিন!
এই শুভেচ্ছা বিনিময়ের যে সংস্কৃতি বিশেষ করে বাংলাদেশে আমরা দীর্ঘদিন থেকে দেখে আসছি, তাতে কথা বলতেই পারি- মানুষের ধর্মাচারের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সব ধর্মেই আছে। উৎসবের দুটি দিক একটি ধর্মকেন্দ্রিক নিয়মকানুন আচার প্রতিপালন, অন্যটি ধর্মীয় উৎসবের সাংস্কৃতিক সর্বজনীনতা! অর্থাৎ উৎসবের আনন্দ ছুঁয়ে যায় সব ধর্মের মানুষকেই। এটাই অসাম্প্রদায়িক আদর্শের আলো ছড়ায় মানুষের মনে।
এ প্রসঙ্গে বলতে চাই- মুক্তিযুদ্ধের রক্তফসল বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এখনও প্রবলভাবে বিশ্বাসী। যদিও সেই চেতনার বিপরীত দর্শনের রাজনীতি বার বার বাধাগ্রস্ত করেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে।
রাষ্ট্রদর্শন হিসেবে পরিপূর্ণভাবে অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তারপরও অব্যাহত আছে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ প্রায় দুই দশক সাম্প্রদায়িকতাই বিস্তৃত হয়েছে অসাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা হয়েছিল ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ আনুকূল্য
পেয়ে। সুতরাং দীর্ঘকালের এই অবক্ষয় রাতারাতি দূর করা সম্ভাব নয় জেনেও আমরা আশা পোষণ করতে পারি যে, একদিন সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ সমূলে উৎপাটিত হবে এই বাংলাদেশের মাটি থেকে। ধর্মের প্রতি অনুরাগ আর ধর্মান্ধতা কখনও যে এক হতে পারে না- এই সত্য সমাজের প্রতিটি স্তরের জনমনে প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা সেই সুদিনেরই প্রতীক্ষায়।
বিদায়ী বছরটির অনেক কিছুই হারিয়ে যাবে স্মৃতি-বিস্মৃতির চিরন্তন নিয়মে। কিন্তু হারিয়ে যাবে না ঐতিহাসিক গৌরবের স্মৃতিময় মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালার কথা। জাতি বিস্মৃত হবে না ২০২১ খ্রিস্টাব্দকে আরও একটি কারণে, তাহলো স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানমালার সমাপ্তি ঘটেছিল এই ডিসেম্বরেই।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর মুজিববর্ষ উদযাপনের স্মৃতিবিজড়িত বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে, কালের দুয়ারে কড়া নাড়ছে নতুন বছর ২০২২। কিন্তু যে বছররটি চলে যাচ্ছে তা কি চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে? নিশ্চয়ই না। স্মরণীয় ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতিই শুধু নয়, থেকে যাবে বিগত বছরে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার রেশ। তারই জের ধরে এগিয়ে যাবে নতুন ২০২২ সাল। অতীতের ভালো-মন্দ নিয়েই বর্তমান আর বর্তমানের কার্যক্রম নিয়েই আগামীর পথচলা।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরটি অনেক আনন্দের পাশে অনেক বেদনাবিধুর স্মৃতিও আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে রাখবে অনেকদিন। করোনা মহামারির কারণে অনেক মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে। জাতীয় জীবনে আমরা হারিয়েছি স্মরণীয় এমন অনেক ব্যক্তিত্বকে যাদের শূন্যতা কখনও পূরণ হওয়ার নয়।
শিক্ষা-সাহিত্য, সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে এই একটি বছরে আমরা হারিয়ে ফেলেছি নক্ষত্রপ্রতিম অনেক ব্যক্তিত্বকে। মনে পড়বে কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক ও রাবেয়া খাতুনের পাশাপাশি বুলবুল চৌধুরীকেও, গল্পকার সাংবাদিক ফিউড়ি খন্দকারও চলে গেছেন এ বছরই। বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও সভাপতি শামসুজ্জামান খান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ, রিয়াজ উদ্দিন আহমদ, শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী, স্বনামখ্যাত ব্যাংকার ও চিন্তাবিদ ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ- এরকম আরও কত কত নাম! ইন্দ্রমোহন রাজবংশী কিংবা মিতা হকের মতো কণ্ঠশিল্পী, ড. ইনামুল হক কিংবা এটিএম শামসুজ্জামানের মতো অভিনেতা, কবরী সারোয়ারের মতো অসামান্য নন্দিত অভিনেত্রী যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করেন না। এসব ক্ষণজন্মা শিল্পী-সাহিত্যিককে আমরা সুবর্ণজয়ন্তীর বছরই হারালাম।
হয়তো আগামী অনেকদিন মনে পড়বে গীতিকবি ফজল-এ-খোদার কথা যিনি বহু কালজয়ী গান লিখেছেন, মনে পড়বে গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীরের কথাও। অসামান্য জনপ্রিয় প্রবীণ সুরস্রষ্টা আলী হোসেনকে আমরা হারিয়েছি ২০২১-এ। বাংলাদেশের বাইরে যদি তাকাই কবি শঙ্খ ঘোষ, কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় আবৃত্তিশিল্পী গৌরি ঘোষ- এদের কথাও কি ভুলে যাওয়া যাবে? নিশ্চয়ই না।
রাজনৈতিক অঙ্গনেও ক্ষতির ক্ষতটা মারাত্মক। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এইচটি ইমামের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রয়াণ ঘটেছে এবছর। জানি না ডিসেম্বরের বাকি কটি দিনে আরও কোনো তারকাকে হারায় বাংলাদেশ!
জরা ব্যাধি দুঃখ-কষ্ট মৃত্যুশোক এসব নিয়েই তো জীবন। একদিকে পাবার আনন্দে অন্যদিকে হারাবার বিয়োগব্যথা। কান্নাহাসির-দোল-দোলানো এই বাস্তবতার মধ্য দিয়েই আমাদের যেতে হয়। বছরে অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে সারা দেশে হয়তো সেগুলো সালতামামি যারা লিখবেন তাদের লেখায় আসবে।
শুধু চকিত দৃষ্টিপাতে যেসব ঘটনা মনের মধ্যে ঢেউ তুলছে তারই দুএকটি উল্লেখ করতে ইচ্ছে হয়। বছরটি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বিএনপিপ্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানোর দাবি নিয়ে। এই দাবির আন্দোলন রাজপথে ব্যাপক না হলেও বিএনপি নড়েচড়ে বসেছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ইস্যুকে কেন্দ্র করে পথসভা, মিটিং-মিছিল বিক্ষোভ প্রকাশ করছেন, কর্মীরা আগের তুলনায় কিছুটা চাঙা এখন। বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার পথে প্রধান বাধা তিনি একজন দণ্ডিত আসামি। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া আওয়ামী লীগ কেন দেবে সেটাও ভেবে দেখবার বিষয় বটে!
নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে ২০২২-এর প্রথম সপ্তাহে। নিরপেক্ষ ইসি গঠনের দাবিতেও সোচ্চার বিএনপি। এদিকে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসেছেন। কয়েকটি দল অংশগ্রহণ করলেও এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত বিএনপি অংশগ্রহণ করছে না।
ইসি গঠনের বিতর্ক বাংলাদেশে আসলে কোনোদিন শেষ হবে বলে মনে হয় না। এর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং একটি কার্যকর আইন থাকা প্রয়োজন, যে আইনের বিধানবলে প্রকৃতই নিরপেক্ষ এবং সত্যিকারের স্বাধীন একটি কমিশন কাজ করতে পারে।
আমাদের মনে কাঁটার মতো গেঁথে থাকবে ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে যে সহিংসতা সারা বছর ধরে চলল বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে। শত শত মানুষ হতাহত হয়েছে ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায়। বিদায়ী বছরের এই দুঃখজনক স্মৃতি সহজে ভোলা যাবে না। এত বিদ্রোহী প্রার্থী আওয়ামী লীগের কেন এই প্রশ্ন কাঁটার মতো বিঁধছে সচেতন নাগরিকদের মনে।
রাজনীতির গুণগতমান কি ভয়ংকরভাবে নষ্ট হয়েছে এসব ঘটনা তারই প্রতিফলন। রাজনীতির গুণগতমান উৎকর্ষতর হতে চাইলে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকেই আরও পরিশীলিত হতে হবে, তাদের মানোন্নয়ন ঘটাতে হবে। উপরে ঠিক হলে নিচের দিকে তার প্রভাব পড়বেই।
চিত্রনায়িকা পরীমনিকে নিয়ে আদালতে যে টানাহ্যাঁচড়া আর দফায় দফায় রিমান্ডের ঘটনা, যা দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে পর্যন্ত বিচলিত করেছে, রিমান্ডদাতা বিচারকদের উচ্চ আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে, চাইতে হয়েছে ক্ষমা। এসব ঘটনা দেশবাসী ভুলবে না। এটি বিচার ব্যবস্থার কোনো আলোকিত ছবি দেয় না।
মন্ত্রিত্ব হারানো সাবেক তথ্যপ্রতিমন্ত্রীর যে অশ্লীল অশালীন কাণ্ড, তা দেশবাসীকে চমকে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দল আওয়ামী লীগে এরকম নষ্ট লোকেরা কীভাবে জায়গা পায়, তা এক মারাত্মক অমীমাংসিত প্রশ্ন। এ প্রসঙ্গে মনে পড়বে গাজীপুরের পথহারানো মেয়র এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আরও দুই-একজন মেয়রের পথহারানোর ঘটনা। তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করে না অথচ এরা গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান করে নিয়েছিল।
প্রশাসনের সঙ্গে কোথাও কোথাও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিরোধ আর ক্ষমতার পরস্পর প্রদর্শনের যে ভয়ংকর চিত্র ২০২১ খ্রিস্টাব্দে দেখা গেল, তা এক অশনিসংকেত বৈ কিছু নয়। বিশেষ করে বরিশালের টিএনও এবং মেয়রকে কেন্দ্র করে সমস্ত প্রশাসনের ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত তা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য কোনো সুখবর বয়ে আনছে না।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে রাজনীতির যে গুণগত মান সে মান যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি এই সত্যটা বুঝিয়ে দিতে হবে যে, এটা ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের বাংলা নয়, এটা মুক্তিযুদ্ধের রক্তফসল গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র বাংলাদেশ। অতীত আমলাতন্ত্রের বলয় থেকে স্বাধীন দেশের আমলাতন্ত্রে যে করে হোক উত্তীর্ণ হতেই হবে।
সারাবছর অনেক উক্তি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কিন্তু একটি উক্তি কোনোদিন কেউ হয়তো ভুলবে না সেটি হচ্ছে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল সাহেবের সেই উক্তি, “বাংলাদেশের প্রথম মহিলা মুক্তিযোদ্ধা বেগম খালেদা জিয়া”! মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ঢাকা সেনানিবাসে বসে বেগম খালেদা জিয়া কী মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তা বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন! হায় সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ! আলেকজান্ডারের সেই উক্তি স্মরণ করি। বিদায় ২০২১! আগাম স্বাগত জানাই ২০২২ তোমাকে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক পরিচালক (বার্তা) বাংলাদেশ টেলিভিশন।