বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আবদুর রাজ্জাকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি

  • মোহাম্মদ শাহজাহান   
  • ২৩ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৮:৫৩

১৫ আগস্টের পর দিল্লিপ্রবাসী শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আনার কারিগর ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে পানিসম্পদমন্ত্রী হিসেবে আবদুর রাজ্জাকই ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক ফারাক্কা চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের মূল সংগঠক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক।

২৩ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী আবদুর রাজ্জাকের দশম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১১ সালের ২৩ ডিসেম্বর লন্ডনের কিংস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ আবদুর রাজ্জাক অল্প বয়সেই বঙ্গবন্ধুকে জয় করেছিলেন।

অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা তৈরির কারিগর, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবদুর রাজ্জাককে বলতেন ‘আমার রাজ্জাক’। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ায়। অতুলনীয় সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী রাজ্জাক ভাই জীবনে রাজনীতির শুরুতে পরপর দুবার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক (১৯৬৫-১৯৬৭) এবং একইভাবে পর পর দুবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

১৫ আগস্টের পর দিল্লিপ্রবাসী শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আনার কারিগর ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে পানিসম্পদমন্ত্রী হিসেবে আবদুর রাজ্জাকই ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক ফারাক্কা চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের মূল সংগঠক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক।

সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে এই লড়াকু মানুষ আবদুর রাজ্জাকের জীবনে বিভিন্ন সময় প্রতিকূলতার প্রাচীর সামনে দাঁড়ালেও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে তিনি তা অতিক্রম করেছেন।

আমাদের দেশে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলসহ অন্য দলগুলোর রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে একের সঙ্গে অন্যের তেমন সদ্ভাব না থাকলেও রাজ্জাক ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন কর্মীবান্ধব নেতা। দলের যেকোনো পর্যায়ের কর্মী তার সঙ্গে যেকোনো সময় দেখা করতে পারতেন।

একজন সত্যিকার রাজনীতিবিদের যতগুলো গুণ থাকা দরকার, এর সবগুলোই প্রয়াত এই নেতার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তাঁর মতো এমন পরিশ্রমী, দক্ষ, যোগ্য, কৌশলী ও প্রাণখোলা রাজনৈতিক সংগঠক দ্বিতীয়জন খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হবে। তার সমসাময়িককালে সংগঠক হিসেবে তার তুলনা তিনিই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালে মাত্র ২৭ বছরের আবদুর রাজ্জাককে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেন।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ৩০ বছরের আবদুর রাজ্জাককে এই বিশাল দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। ১৯৭৫ সালে বিশেষ পরিস্থিতিতে জাতীয় দল বাকশাল গঠন করার পর দলের তিন সম্পাদকের অন্যতম ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ষাটের দশক খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় ১৯৭২ সালে ছাত্রসমাজে শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে কথিত লৌহমানব আইয়ুব খানের তখতে তাউস কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

এই দশকেই আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন, শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু, শেখ মুজিবের দলের সভাপতি হওয়া, স্বাধীনতার লক্ষ্যে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দেয়া, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ দেশপ্রেমিকের নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬ দফা দেয়ার পর ৭ জুনের হরতাল বাঙালির প্রাথমিক বিদ্রোহ, আইয়ুব-মোনায়েম কর্তৃক শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে হত্যার ষড়যন্ত্র, শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ, সত্তরের জাতীয় নির্বাচনে মুজিবের আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়- এরপর একাত্তরে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী নেতৃত্বে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা লাভ করে। ইতিহাস সৃষ্টিকারী সব কটি আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্বের প্রথম সারিতে ছিলেন গণমানুষের নেতা আবদুর রাজ্জাক।

আজকাল তো ইউপি মেম্বার ও চেয়ারম্যান হলেই বাড়ি-গাড়ি হয়ে যায়। মন্ত্রী, এমপি বা দলের বড় নেতা হলে কীভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়, সেই কথা আর নাই-বা বললাম। পদের লোভ কার না থাকে? রাজ্জাকের সহকর্মী শাহ মোয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান, তোফায়েল আহমদরা মন্ত্রী বা মন্ত্রীর মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু রাজ্জাক ভাইকে যখন যেখানে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, বিনাদ্বিধায় আনন্দচিত্তে তিনি নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেক অনুসারীর মধ্যে তিনি ছিলেন নেতার অন্ধ অনুসারী।

বলা যায়, রাজ্জাক ভাইয়ের ব্যক্তিগত কোনো ‘চয়েজ’ ছিল না। নেতার চয়েজই তার চয়েজ। শুনতে আশ্চর্যই মনে হবে, ঢাকা শহরে রাজ্জাক ভাইয়ের কোনো নিজস্ব বাড়ি এমনকি ফ্ল্যাট বা কোনো জায়গা-জমিও ছিল না। ড. আতিউর রহমানের লেখা থেকে জানা যায়, আশির দশকে রাজ্জাক ভাইয়ের নিজস্ব কোনো গাড়িও ছিল না। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় একদিন রাজপথে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা এই জাতীয় নেতাকে অনুরোধ করে তার গাড়ির মাধ্যমে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

জাতির পিতার হত্যার পর অনেক সিনিয়র নেতা থাকা সত্ত্বেও শতকরা ৯০/৯৫ জন নেতাকর্মীর সমর্থনে একক নেতা হয়ে যান ৩৬ বছরের আবদুর রাজ্জাক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে একক নেতা হওয়া সত্ত্বেও দলীয় কোন্দল সামাল দিতে পারছিলেন না তিনি। দেশ, জাতি ও দলের কঠিন সময়ে সবার আগে আবদুর রাজ্জাক উপলব্ধি করেন, দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে হলে শেখ হাসিনাকে দলের দায়িত্বে আনতে হবে। শেষপর্যন্ত রাজ্জাক ভাই সফল হন।

জাতির পিতার প্রবাসী শোকাহত কন্যাকে দলের নেতৃত্বে আনতে সক্ষম হন ১৯৮১-এর ফেব্রুয়ারির কাউন্সিল অধিবেশনে। ১৯৭০ সালে তিনি এমপিএ হন। স্বাধীন বাংলাদেশে ২০০৮ পর্যন্ত ৫টি নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

অনেক বিরল গুণের অধিকারী ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। কর্মিবান্ধব এই নেতা কর্মীদের এমন গোপনে সহায়তা করতেন যেমন ডান হাত সহযোগিতা করলে বাম হাত যেন টের না পায়। জীবনের শেষদিকে যেকোনো কারণেই হোক, আবদুর রাজ্জাক নেত্রীর কাছ থেকে দূরে সরে যান। তবে তিনি যে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এই স্বল্প পরিসরে রাজ্জাক ভাইয়ের রাজনৈতিক গুণাবলি নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়। ১৯৯১ সালে তিনি দলে ফিরে আসেন বাকশাল বিলুপ্ত করে।

বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির ইতিহাসে আবদুর রাজ্জাক ছিলেন সব সময়ের জন্য এক সাহসী মানুষ, উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনুকরণীয় চরিত্র। বড় আদর্শ। রাজ্জাক ভাইয়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক গবেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর