বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

উৎসব-অনুষ্ঠানগুলো কেবল পোশাকি আড়ম্বর?

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ২০ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৪:০৯

প্রগতিশীলতার রাজনৈতিক ধ্যানধারণাও সীমাবদ্ধ বৃত্তে আবদ্ধ। জাতীয়তাবাদ বিভাজিত মূলত দলীয় বিভাজনের সূত্র ধরে। বলা যায়, গোটা সমাজই আজ বিভাজিত। একুশ ও একাত্তরের চেতনা এ জায়গাটিতেই মার খেয়েছে। গর্ব আর অহংকারের বিষয়টি ফাঁপা উচ্ছ্বাস বা কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাঙালির কাছে জীবনের অন্য নামই বোধহয় উৎসব। সেটি ঈদ-পূজা, ঋতুবরণ, বিজয়-স্বাধীনতা, ভাষা দিবস বা অন্য কোনো জাতীয় দিবস কিংবা ফুটবল-ক্রিকেট যা-ই হোক। বিভিন্ন বিষয়ে বাঙালি একজোট হতে পারলেই যেন স্বস্তি পায়। তবে সময়ের সঙ্গে পালটেছে বাঙালির আনন্দ প্রকাশের ধরন। আগে ছিল বারো মাসে তেরো পার্বণ। এখন তো প্রতিমাসেই যেন এক ডজন পার্বণ বা উৎসব।

ডিসেম্বরের কথাই ধরা যাক। দুর্নীতিবিরোধী দিবস, মানবাধিকার, রোকেয়া, প্রবাসী, বুদ্ধিজীবী ও বিজয় দিবস। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিকেও উৎসবের মাস বললে অত্যুক্তি হয় না। অমর একুশে বইমেলা, সরস্বতী পূজা-বসন্তবরণ, ভালোবাসা ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ আরও অনেক উৎসব। এ মাসে যেন উৎসবের জোয়ার লাগে সবার প্রাণে।

উৎসব জীবনের রসনির্ঝরিণী। প্রাণপুষ্পের ভোমরা। উৎসবময় জীবন অবশ্যই অনন্ত প্রাণভান্ডার। ঘরোয়া-সামাজিক, দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক হরেক উৎসব।

উৎসবের প্রয়োজন আছে। উৎসবের জোয়ারে সবাই ভেসে যাক, এতে আপত্তির কিছু নেই। তবে প্রশ্ন দেখা দেয়, যখন আর দশটা খেলো উৎসবের মতো বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হারিয়ে শুধুই উৎসবে পরিণত হয়। শহীদ-স্বাধীনতা, বিজয়, জাতির পিতার জন্ম-মৃত্যু ও ঐতিহাসিকভাবে অমর ব্যক্তিত্ব স্মরণ দিবস ইত্যাদি হচ্ছে রাষ্ট্রের দেশাত্মবোধের স্বর্ণসম্পদ। পরম শ্রদ্ধার, অন্তরঙ্গ ভালোবাসার ও ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নৈতিক উৎসব এগুলো।

ভাবনার বিষয় হলো- যতই মহার্ঘ সম্পদ হোক না কেন, এই উৎসবগুলো কি সবার মধ্যে আজকাল অনুরাগ-অনুপ্রেরণা ও আকর্ষণের কোনো চমক দেখাতে পারে? পুরোপুরি ভাবগাম্ভীর্য খুঁজে পাওয়া যায়?

এর কারণ কী? উৎসবের প্রসঙ্গগুলো কি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলছে নাকি কাল-জীর্ণ হয়ে যাচ্ছে? নাকি গ্রহণযোগ্যতার অনুকূল সেরিব্রিয়াল টিস্যুর একরকম দৌর্বল্য দৈন্য? নীতি ও নাগরিক কর্তব্যের প্রসঙ্গ হলেও এ জাতীয় উৎসবে যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে কেন যেন জনমানসের কিছু না কিছু অনীহা ও ক্লান্তিবোধ দেখা যায়।

একটা সময় পর্যন্ত উৎসব-মানসটি ছিল অনাবিল-স্বতঃস্ফূর্ত ও আন্তরিক। জাতীয় দিবসগুলোতে ছিল ভাবগম্ভীর পরিবেশ। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটা আন্তরিক তাগিদের বহিঃপ্রকাশ দেখা যেত সে সময়।

প্রাণের টানে ও চেতনার মশাল জ্বালিয়ে সেসব অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার মধ্যে থাকত শ্রদ্ধা-ভক্তিভাব ও আবেগের প্রকাশ, দেশপ্রেম আর দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধ। রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত ও দোকানপাটে জাতীয় এবং দলীয় পতাকা-ফেস্টুন আর আলোকমালায় ভরে উঠত।

শহর ও শহরতলিতে হতো মিছিল-সভা এবং নানা রকম আলোচনা। জাতীয় বীরদের গৌরবগাথা নিয়ে আলোচনা সভা হতো। তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হতো। জাতি-ধর্ম ও বর্ণ-নির্বিশেষে সমাজের বৃহদংশের ভাবনায় থাকত দেশপ্রেমের চেতনা। উচ্চারিত হতো মানুষকে ভালোবাসার মন্ত্র।

মনে হয় সেদিন আজ আর নেই। আজকাল শহীদ-স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসের মতো ঐতিহাসিক জাতীয় উৎসবের রং বোধহয় অনেকটাই ফিকে। এখন কেবল নামমাত্র পালিত হয় এসব। যেন বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চলেছি। বর্তমানে উৎসবের সমারোহ ও অংশগ্রহণ আছে কিন্তু প্রাণ নেই। ভক্তি-শ্রদ্ধা বা আবেগ নেই। দিবসগুলো কেবল দায়সারা একত্র হওয়া ও স্থূল আনন্দ প্রকাশের উৎসবে পরিণত হচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় উৎসবে জনমানসের বোধহয় তিনটি পর্যায়; উদ্দীপনা-উদাসীনতা ও উত্তেজনা। একতলার বাসিন্দাদের উদ্দীপনা, দোতলায় উদাসীনতা এবং তেতলার বাসিন্দাদের উত্তেজনা। একটা ত্রিতল ভবন যেন। উদ্দীপিত জনমন দেখে পুলক জাগে বইকি। শহর-গ্রামে শোভনীয় মঞ্চ। বেদি জাতীয় পতাকায় সাঁটা, আলপনা। জাতির পিতার ছবি। পতাকা তুলবেন সংসদ সদস্য (মন্ত্রী হলে তো কথাই নেই) অথবা বড় কোনো নেতা। চলবে জোরালো ভাষণ। উপদেশ-প্রতিশ্রুতি, রাজনীতির কড়চা ও মানবপ্রেমের সুধামাখা বচনের বরিষণ। উপস্থিত স্বপ্ন দেখা চোখের ও আশা-আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপিত তরুণ। ‘শুভকর্ম পথে ধরো নির্ভয় গান’। ঘন ঘন স্লোগান— জয় বাংলা, শহীদ দিবস অমর হোক বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, হারিয়ে যেতে দেব না।

মানুষ মন্থর পায়ে সভাস্থলে আসে, মন্থর পায়ে আবার চলে যায়। বিশেষ জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানগুলো জণসাধারণকে টেনে রাখতে পারল না। ওদের অনেকেই হাজির থেকেও মানসিকতায় গরহাজির, উদাসীন ও নির্বিকার। অনুপস্থিতদের কাছে উদ্যোক্তাদের জিজ্ঞাসা ছিল; কী এলে না কেন ভাই? উত্তর- এই এমনিই বা বিভিন্ন ধরনের অজুহাত।

এ পর্যায়ের তরুণদের অনীহা বা উদাসীনতাকে বড় একটা গ্রাহ্যও করে না অনেক দল-সংঘ বা সংস্থা-সমিতি। কেন যে ওরা উদাসীন-নির্লিপ্ত, বুঝবে কে? কোথায় ওদের দুঃখ-অভিমান আর অনুযোগ? তা প্রকাশের কোনো মিডিয়া নেই। তবে ওদের ঘাঁটানোও যায় না। মুখ-বুক ও স্নায়ুতে উত্তেজনা দাবানল হয়ে আছে। তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তথাকথিত ওইসব অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। ধারেকাছেও ঘেঁষে না অথচ ওরা দেশপ্রেমিক—মানবহিতৈষী ও কর্মানুরাগী। তবে? কোনো জিজ্ঞাসারও উত্তর চট করে দেয় না। কোনো অনুষ্ঠান-আয়োজক জিজ্ঞেস করেছিল, কী ভাই দেখলাম না তো! কী জমাট উৎসব হলো!... কিছুক্ষণ গুম মেরে থেকে জবাব দিল— হ্যাঁ, চালিয়ে যান।

জনগণের অধিকার কতটুকু কায়েম হয়েছে বলবেন? মানুষের মূল্যবোধ ও সুবিচারের ফারাক দূর করতে কী করেছেন? পার্বত্য চট্টগ্রাম, গাইবান্ধার নদীভাঙা গ্রাম আর ঢাকার তফাতটা মেটাতে পেরেছেন? বড় পবিত্র শব্দধ্বনি গণপ্রজাতন্ত্র। রূপায়ণটাই কিন্তু আসল কাজ। ব্যস! তর্ক-বিতর্ক, জটলা, হইচই আর বাদানুবাদ।

দেশের উল্লেখযোগ্য উৎসবগুলোতে দেশাত্মবোধের অনুপাত কতটুকু তা ভাবার বিষয়। নিখাদ উদ্দীপনা যাদের, তাদের ভাবনাকেও মূল্য দেয়া জরুরি। হুজুগে উদ্দীপনা বলাবাহুল্য অতি অল্পায়ু। যারা উদাসীন, তাদের ঔদাসীন্য বা নির্বিকারত্বের কথা না ভাবলে বলিষ্ঠ-সুষ্ঠু ও যথার্থ সমাজ সৃষ্টি বোধহয় সম্ভব নয়। তাই তাদের অপাঙক্তেয় করা সমীচীন নয়। আদর্শ দিয়ে ঘনিষ্ঠ করে দেয়া দরকার আন্তরিকতার মাধ্যমে।

উত্তেজনা-ধর্মীদের কথাও ভাবনার বিষয়। তারা যদি দেশপ্রেমশূন্য রাগী তরুণ হয়, তবে পাঙক্তেয় না করা গেলেও- দেশপ্রেম ও মানবকল্যাণের বীজ ওদের চেতনায় থেকে থাকলে, অবশ্যই গণ্য করতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে ওদের যুক্তি ও বক্তব্যকে। কর্ম দিয়ে ওদের মর্মে প্রবেশ করতে হবে। ভাঙতে হবে অভিমান। ওরাও জাতি ও দেশের সম্পদ। এ ধরনের কর্তব্যে এগিয়ে আসতে হবে প্রজ্ঞা-হৃদয়বান, সহনশীল এবং দেশপ্রেমিকদের। তবেই তারুণ্যের মূল্যায়ন ও সমৃদ্ধি সম্ভব।

প্রগতিশীলতার রাজনৈতিক ধ্যানধারণাও সীমাবদ্ধ বৃত্তে আবদ্ধ। জাতীয়তাবাদ বিভাজিত মূলত দলীয় বিভাজনের সূত্র ধরে। বলা যায়, গোটা সমাজই আজ বিভাজিত। একুশ ও একাত্তরের চেতনা এ জায়গাটিতেই মার খেয়েছে। গর্ব আর অহংকারের বিষয়টি ফাঁপা উচ্ছ্বাস বা কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একাত্তরের সংগ্রাম যে জাতিরাষ্ট্রের প্রত্যয় তুলে ধরেছিল, তা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অনেকাংশেই শ্রেণিবিশেষের স্বার্থপূরণের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। জাতিসত্তার শিকড়ে, সমাজের সর্বস্তরে সর্বজনীন স্বার্থের সেচ সামান্যই দেয়া হয়েছে। তাই একুশ-একাত্তরের চেতনা, ঊনসত্তরের গণজাগরণের ঢেউ স্বাধীন বাংলাদেশে ফসলের পরিপুষ্টি নিয়ে বিস্তার লাভ করেনি বরং বিরূপ পরিবেশে সেসব চেতনা ক্রমেই পিছু হটেছে, বিকাশ ঘটা তো দূরের কথা।

শুধু চেতনার বিস্তার ঘটাতে জাতিসত্তার বর্তমান আর্তি। কবির ভাষায় বলা যেতে পারে- ‘জল দাও আমার শিকড়ে’। কিন্তু কে বা কারা দেবে? দেয়ার মতো সংঘবদ্ধ শক্তি কোথায়?

লেখক: প্রবন্ধকার, কলাম লেখক ও সাবেক ছাত্রনেতা।

এ বিভাগের আরো খবর