বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এই সাফল্য এই সীমাবদ্ধতা

  • নাসির আহমেদ   
  • ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৮:০৪

কোনো রাষ্ট্র তা যতই ধনী হোক, অর্থনৈতিকভাবে যত সমৃদ্ধির অধিকারী হোক, সে দেশ কখনোই উন্নত দেশ নয়, যতদিন না তার উন্নত মানবসম্পদ আর সভ্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করেছে, সন্দেহ নেই। বিস্ময়করভাবে বদলে গেছে মানুষের জীবনমান। গ্রাম-শহরের বৈষম্য আস্তে আস্তে কমে আসছে। কিন্তু যা হয়নি, তা হচ্ছে মানবিক ইতিবাচক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমের সেই ঐতিহ্য যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেখে গেছেন।

আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা এবং সেই স্বাধীনতার মর্মমূলে জেগে আছে এমন এক গৌরবের ইতিহাস যার কোনো তুলনা নেই। অতুলনীয় সেই গৌরবের পাশেই উজ্জ্বল সূর্যের মতো দীপ্যমান এক নাম: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহাবিজয়ের ডিসেম্বর আমাদের স্মৃতির দুয়ার খুলে দেয়। খুলে যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতাও। সমগ্র জাতির অতুলনীয় আত্মত্যাগের সেই ইতিহাস, অনন্য ঐক্যে গভীর দেশপ্রেমে সেই একবারই বাঙালির জাগরণ ঘটেছিল ১৯৭১ সালে। তার মূল চালিকাশক্তি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

সবার জানা সেই ইতিহাস নতুন করে আবার উন্মোচিত হলো গত ১৬ ডিসেম্বর। মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে সেই ইতিহাস ফিরিয়ে আনা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে। করোনা পরিস্থিতির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মুজিববর্ষের সমাপনী ও স্বাধীনতার মহাবিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সংসদ সদস্যগণ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা দেশি-বিদেশি কূটনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ, সামরিক-বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তারাসহ সব পর্যায়ের উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

এবার অক্ষম সাফল্যের কথা নয়। অনুষ্ঠানের বাড়তি আকর্ষণ ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। এই অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল এই যে, ডিজিটাল বাংলাদেশের অনলাইন সুবিধা কাজে লাগিয়ে সারা পৃথিবীতে মুহূর্তে ছড়িয়ে দেয়া গিয়েছিল বাংলাদেশের এই মহান গৌরবের ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো। এমন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণশপথ গ্রহণ করিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক নতুন ইতিহাস গড়লেন। এই শপথে ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে না দেয়া’র যে অঙ্গীকার তিনি করেছেন ও সবাইকে করিয়েছেন তাতে নতুন- তরুণ প্রজন্মকে উদ্বেলিত এবং অনুপ্রাণিত করবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

এর বাইরে দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা থেকে গ্রাম ইউনিয়নপর্যায় পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ ও মহাবিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব বিস্তৃত করা সম্ভব হয়। জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা এবং জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে দুই দিনব্যাপী সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানমালায় কুচকাওয়াজে, নানা মাত্রিক সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় জীবন্ত হয়ে উঠেছিল ১৯৭১, একদিকে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন, অন্যদিকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে মৃত্যুকে তুচ্ছ করে বাংলার সর্বস্তরের মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের পথে এগিয়ে চলা মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত দিনরাত্রি। সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল অতুলনীয় একাত্তরের সেই অবিস্মরণীয় ইতিহাস।

নিঃসন্দেহে বর্তমান প্রজন্ম তথা তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে নমাসের সেই অবিস্মরণীয় দিনরাত্রির প্রতীক্ষার উৎকণ্ঠায়, অর্জনের মহিমায়, আত্মত্যাগের প্রোজ্জ্বল সাহসে গরীয়ান সেই ইতিহাস, যা বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথের প্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য দেশমাতৃকার লাখ লাখ বীর সন্তান কী অনায়াসে হাসিমুখে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে, সেই ইতিহাস আজ বার বার তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতেই হবে।

কারণ, বাংলাদেশ একাত্তরের সেই অনন্য ঐক্যের অবস্থানে আজ আর নেই। তরুণ প্রজন্মের সামনে ত্যাগের কোনো দীক্ষাও নেই। সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া সমাজ-বাস্তবতায় শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবারই উদগ্র ভোগলিপ্সা তরুণ প্রজন্মের কাছে কোনো মহৎ আদর্শ তুলে ধরে না। ফলে তারাও ভোগবাদী আর নীতি-নৈতিকতাহীন জীবনের পঙ্কিল পথে এগিয়ে চলেছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের যে অর্জন তার কোনো তুলনা নেই, বিশ্বে কি না জানি না, তবে সমগ্র এশিয়াতেই যে নেই, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কৃষি উৎপাদনে, মাছ, শাকসবজি ডিম, মাংস, উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি দেশের অন্যতম বাংলাদেশ। গার্মেন্টস শিল্পে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও জনশক্তি রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গৌরবের। নারীশিক্ষা-গণশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নসহ বহু ক্ষেত্রে জীবনমানে বাংলাদেশ বিশ্বের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে আজ। মাতৃমৃত্যুর হার বিস্ময়করভাবে কমানো সম্ভব হয়েছে। এর জন্য জাতিসংঘের পুরস্কার লাভ করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ৮ গুণ বড় রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন বাংলাদেশে কোথায় আর পাকিস্তান কোথায়! বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আজ পাকিস্তান হাহাকার করছে!

অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি, তা বিস্ময়কর! যুদ্ধবিধ্বস্ত যে বাংলাদেশের ১০০টি ডলারও ছিল না ১৯৭২ সালে, সেই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আজ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত হয়নি এটা ঠিক, কিন্তু এদেশে কেউ অতীতের মতো না খেয়ে মরে না।

পুঁজিবাদী বিশ্ব বাস্তবতায় ধনী-গরিবের বৈষম্য উচ্ছেদ করা যাবে না, একথা সত্য কিন্তু বৈষম্যটা কমিয়ে আনা গেলে বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক সাফল্যের তাৎপর্য আরও প্রসারিত হতো, গণমানুষের কল্যাণে অধিক কার্যকর হতো

বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই সোনার বাংলা বাস্তবায়নের অনুকূল ছিল তখন বিশ্বব্যবস্থা। একদিকে শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক পৃথিবী অন্যদিকে পুঁজিবাদী পৃথিবী। ফলে সামরিক ক্ষেত্রে যেমন একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স পরিস্থিতি ছিল তেমনি অর্থব্যবস্থারও একটা ভারসাম্য ছিল।

বঙ্গবন্ধু মাত্র তিনটি অর্থবছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। ওই তিনটি অর্থবছরের বাজেট দিয়েছিলেন সেদিনের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। সেই বাজেটগুলো দেখলে কিংবা পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে ছোট পুঁজির বাজেটও কতটা গণমুখী হতে পারে। আরও সহজ করে বললে বৃহত্তর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণ কতবেশি গুরুত্ব পেতে পারে।

সেই বাজেট ধনীকে আরও ধনী হতে এবং গরিবকে আরও গরিব হওয়ার পথ খোলা রাখেনি। ওই রকম বাজেট এই বাংলাদেশ আর কখনও হয়নি আর হবে কি না ভবিষ্যতে তাও বলা অসম্ভব। কারণ এখন পরিবর্তিত বাংলাদেশ গভীর দেশপ্রেম থাকলেও অনেক কিছুর সঙ্গে আপস করে যেতে হয়। জেনে শুনে বিষ পান করার মতোই এসব গরল গিলেই ক্ষমতায় থাকতে হয়। এমনকি ধর্মান্ধতা মৌলবাদ অপছন্দ হলেও অনেক ক্ষেত্রে মেনে নিতেই হচ্ছে। তা না হলে তো হারিয়ে যাওয়া!

ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন, দেশকে সমৃদ্ধশালী করবেন, নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাবেন, কিন্তু তাদের যে পুঁজি সেই পুঁজি রাষ্ট্রের সম্পদ লুট করে নেয়া হবে কেন! বহু ব্যবসায়ী-শিল্পপতি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং বেসরকারি বহু ব্যাংকের ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করেননি! অথচ তারা সেই টাকা নিয়ে বিদেশে ব্যবসা করছেন কেউ কেউ বিশ্বের ধনী দেশগুলোতে বাড়ি কিনছেন বিলাসী জীবন-যাপন করছেন। বাংলাদেশের গত ৩০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই অপসংস্কৃতি, লুটপাটের অর্থনীতির এই ভয়াবহ চিত্রই বেরিয়ে আসবে।

আগেও একটি লেখায় বলার চেষ্টা করেছিলাম যে, কোনো রাষ্ট্র তা যতই ধনী হোক, অর্থনৈতিকভাবে যত সমৃদ্ধির অধিকারী হোক, সে দেশ কখনোই উন্নত দেশ নয়, যতদিন না তার উন্নত মানবসম্পদ আর সভ্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করেছে, সন্দেহ নেই। বিস্ময়করভাবে বদলে গেছে মানুষের জীবনমান। গ্রাম-শহরের বৈষম্য আস্তে আস্তে কমে আসছে। কিন্তু যা হয়নি, তা হচ্ছে মানবিক ইতিবাচক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমের সেই ঐতিহ্য যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেখে গেছেন।

এখন যে নৈতিকতাহীন ধনী হবার প্রতিযোগিতা, অনুপার্জিত অর্থের মালিক হওয়ার উদগ্র লিপ্সা, এমনকি সমাজের সব ক্ষেত্রে ভয়াবহ স্বার্থপরতা আর আত্মকেন্দ্রিকতার যে চরম প্রকাশ ঘটছে, তা দেখে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। শিশুদের যদি শেখানো হয় (চিপসের বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখি) একা একা খাও, দরজা বন্ধ করে খাও, সেই সমাজ কী ভয়ংকর স্বার্থপর ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না।

একটা ছোট্ট দৃষ্টান্ত দিই। ১৯৯২ সালে একটি ছোট গার্মেন্ট নিয়ে ব্যবসা শুরু করা একজন গার্মেন্টস মালিক গত ২৯ বছরের কম করে হলেও সহস্রাধিক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সেই একটি ছোট গার্মেন্ট এখন অন্তত নয়টি গার্মেন্টে উন্নীত। কিন্তু তার কারখানায় শ্রমিকটি কাজ করে, সে ঢাকায় মাথার গোঁজার মতো একটি বাসস্থান তৈরি করার কথা তো চিন্তাই করতে পারছে না।

একজন শ্রমিকের বছরের পর বছর চাকরি করে জীবনমানের কোনো উন্নতি হয় না, তার মাথা গোঁজার ঠিকানা ঠিক হয় না সন্তানদের লেখাপড়া করানোর মতো অর্থের সংস্থান হয় না। চিকিৎসা, বাসস্থান তো পরের কথা। গার্মেন্ট-শিল্প শুধু নয়, সব শিল্প-কারখানাতেই শ্রমিককে যত কম দেয়া যায় আর যত বেশি শ্রম আদায় করা যায়-এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চলমান ধর্ম। এই ভয়ংকর বাস্তবতা বিফল আমরা দেখি প্রত্যেকটি ঈদ আসলেই ঈদের বেতন-বোনাসের দাবি নিয়ে রাস্তায় বসে যেতে হয় শ্রমিকদের।

এই নিষ্ঠুরতার অর্থনীতি, এই শোষণের অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকারকে ব্যবসায়ীদের কাছে কিছুটা হলেও অপ্রিয় হতেই হবে। বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে পুঁজিপতি, চোরাকারবারি, ভোগলিপ্সু সরকারি আমলাদের কারো কাছেই প্রিয় ছিলেন না। এদের তীব্র সমালোচনা তিনি নিয়মিত করতেন। আজকের সরকার- ব্যবস্থায় যা কল্পনাও করা যায় না। আজ মনে হয় সব আমলাতন্ত্রের কাছেই জিম্মি সরকার।

যারা যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে সম্পদ আহরণ করছেন, যারা সরকারের চাকরি করে অনৈতিক পথে ধন-সম্পদের মালিক হচ্ছেন তাদের মধ্যে মানবিক চেতনার উদয় হবে এমন আশা করা যায় না। অপ্রিয় হয়ে সরকারকে নীতিকৌশল করে এই শোষণের অর্থনীতির যাত্রা সংকুচিত করতেই হবে। তাহলেই স্বাধীনতার অর্জন সত্যিকারের অর্জনে রূপান্তরিত হবে।

লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক। সাবেক পরিচালক (বার্তা) বাংলাদেশ টেলিভিশন।

এ বিভাগের আরো খবর