বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নাগরিকের ভূমি না থাকা রাষ্ট্রের লজ্জা

  •    
  • ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৩:২৭

প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ তিনি আসপিয়া এবং মীমকে জমি দিয়েছেন, তাদের চাকরির ব্যবস্থাও হচ্ছে। কিন্তু আসপিয়া বা মীম তো ব্যক্তিমাত্র। চাকরি পেতে হলে কাউকে ফেসবুকে ভাইরাল হতে হবে, এটা তো ন্যায়বিচারের কথা নয়। আসপিয়ার আগেও অনেকে এই বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। আসপিয়ার ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর আরও অনেকে তাদের বঞ্চনার কথা বলছেন। ভূমিহীন হলে চাকরি পাবে না, এই নিয়মের যৌক্তিক সমাধান হতে হবে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে শেখ হাসিনা ভূমিহীনদের জমি ও বাড়ি করে দিচ্ছেন। তার এই স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে হয়তো একদিন দেশে কোনো ভূমিহীন থাকবে না।

প্রকৃতি বৈষম্য করে না। গ্রামে একটা কথা বলা হয়, মুখ দিয়েছেন যিনি, আহার দিবেন তিনি। এটা এক অর্থে সত্যি আবার অন্য অর্থে ডাহা মিথ্যা। আপনি যদি কিছু না করে ঘরে বসে থাকেন, কেউ আপনার মুখে খাবার পৌঁছে দেবে না। আপনাকে কষ্ট করে, কাজ করে খাবারটা জোগাড় করতে হবে। কিন্তু সত্যি এই অর্থে যে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য খাবার আছে প্রকৃতিতে। মানুষের কথা বাদ দিন, পশু-পাখির সংখ্যা যা-ই হোক, খাবারের অভাবে কিন্তু কেউ মারা যায় না। প্রকৃতিতে সবার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। খালি খুঁজে নিতে হবে।

পশুরা তাদের মতো খাবার জোগাড় করে নিলেও মানুষ যত সভ্য হয়েছে, ততই সৃষ্টি হয়েছে বৈষম্য। কোনো পশু খাবারের অভাবে মারা না গেলেও বিশ্বের অনেক মানুষ দুর্ভিক্ষের কারণে মারা যায়, অনেকে মানুষের মাথা গোজার ঠাঁই নেই। কেন নেই? যিনি মুখ দিয়েছেন, তিনি কেন আহার দিচ্ছেন না! আসলেই প্রকৃতিতে কিন্তু প্রতিটি প্রাণের বেঁচে থাকার মতো উপাদান আছে। কিন্তু মানুষ পদে পদে বৈষম্য সৃষ্টি করে মানুষকেই বিপদে ফেলে। অনেক মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি খাবার খায় বা অপচয় করে, তাই অনেক মানুষকে না খেয়ে থাকতে হয়। অনেক মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি জায়গা দখল করে রাখে, তাই অনেক মানুষ থাকার জায়গাই পায় না।

ব্যাপারটা এমন নয় যে, বাংলাদেশের ৫৫ হাজার বর্গমাইল ভূমি ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দিতে হবে। আবার কারো দখলে শত শত একর জমি থাকবে, কেউ মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে না; এটাও দৃষ্টিকটু। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, সব মানুষের অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করা। কেউ না খেয়ে থাকলে বা কেউ ভূমিহীন হলে সেটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, রাষ্ট্রের জন্য লজ্জা। একাত্তর সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল একটি শোষণহীন, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে এই আকাঙ্ক্ষার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন কঠিনই শুধু নয়, অসম্ভব। কিন্তু যত অসম্ভবই হোক, বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে ভূমিহীনের হাহাকার আমাদের সবার আনন্দকেই ম্লান করে দেয়।

আসপিয়া ইসলাম নামে এক নারীর বিষয় হঠাৎ করে ভূমিহীন প্রসঙ্গটি সামনে এনেছে। পিতৃহীন আসপিয়ার স্বপ্ন ছিল পুলিশে চাকরি করে সংসারের হাল ধরবেন। নিয়ম মেনে তিনি পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরির জন্য আবেদন করেন। চাকরির জন্য সাত ধাপের সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি, মেধা তালিকায় হন পঞ্চম। চাকরির স্বপ্নে যখন পুরো পরিবার বিভোর, তখনই আসপিয়া জানতে পারেন, তার চাকরি হচ্ছে না। কারণ তার কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই, কোনো জমিজমা নেই। আসপিয়ার বাবার বাড়ি ভোলায়। কিন্তু নদীভাঙনে সব হারিয়ে তিনি ভাসতে ভাসতে বরিশালের হিজলায় এসে থিতু হন। এখানেই ভাড়া বাসায় তার সংসার। কিন্তু স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় আসপিয়ার চাকরি হবে না। মেধা তালিকায় পঞ্চম হওয়ার পরও ভূমি না থাকায় চাকরি না পাওয়ার বিষয়ে জানতে বরিশাল পুলিশ লাইনসের গেটের সামনে অপেক্ষা করেন আসপিয়া।

তার বসে থাকার ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয় সব মহলে। পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় তার পৈত্রিক অল্প কিছু জমিজমা আছে, সেটা তার পিতৃভূমিতে। অবশ্য আসপিয়ার নিজস্ব কোনো জমিজমা বা স্থায়ী ঠিকানা নেই। একই ধরনের ঘটনা জানা যায় খুলনার মীম ইসলামের বেলায়ও। মেধা তালিকায় প্রথম হওয়ার পরও চাকরি হচ্ছিল না তার। দুটি ঘটনাই প্রধানমন্ত্রীর নজরে এসেছে। তাদের দুজনকেই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জমি দেয়া হচ্ছে, দেয়া হচ্ছে ঘর। তারা দুজনই চাকরি পাবেন বলে আশার আলো দেখা যাচ্ছে।

মীম ইসলামের চাকরি না পাওয়ার বিষয়টি হাইকোর্টের নজরেও এসেছে। হাইকোর্ট বলেছেন, ‘জমি না থাকায় চাকরি হবে না, এটা তো হতে পারে না। পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে এতে তো তাকে আরও উৎসাহ দেওয়া উচিত। প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার মানুষ নদীভাঙনের শিকার হয়। তারা কি চাকরি পাবে না?’ হাইকোর্ট সমস্যার গভীরেই আলো ফেলেছেন। শুধু পুলিশ নয়, জেলা কোটায় সরকারি চাকরি পেতে হলে ভূমি এবং স্থায়ী ঠিকানা থাকাটা আবশ্যিক শর্ত। এটা করা হয়েছে, কেউ যাতে জেলাকোটার অপব্যবহার করতে না পারে।

তাছাড়া চাকরিপ্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা আছে কি না বা তিনি কোনো রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার সঙ্গে জড়িত কি না, তাও যাচাই করা হয়। কিন্তু মান্ধাতার আমলের এই নিয়ম বদলানো এখন সময়ের দাবি। চাকরিপ্রার্থী বাংলাদেশের নাগরিক কি না, সেটা যাচাই করাই তার চাকরি পাওয়ার জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিত। কারো যদি জাতীয় পরিচয়পত্র-এনআইডি বা পাসপোর্ট থাকে তাহলে তার জমি আছে কি না, সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন এনআইডি থাকলেই একজন মানুষকে শনাক্ত করা সম্ভব। আর মানুষ অনেক কারণেই ভূমিহীন হতে পারে।

ভূমিহীন হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ নদীভাঙন। নদীমাতৃক বাংলাদেশ একরাতে একজন জমিদারকে ভূমিহীন করে দিতে পারে। প্রতিবছর ২ হাজার মানুষ ভূমিহীন হয়। তারা কি তাহলে সরকারি চাকরি পাবে না? শুধু নদীভাঙন নয়; দারিদ্র্য, অসুস্থতা, ব্যক্তিগত কারণেও অনেকে ভূমিহীন হয়ে যেতে পারেন। পরিবারের কারো জটিল অসুখ হলে অনেক সময় জমিজমা বিক্রি করে চিকিৎসা করেন। অনেকে সন্তানের শিক্ষা বা কন্যার বিয়ের জন্যও জমিজমা বিক্রি করে দেন। আবার অনেকে গ্রামের জমি বিক্রি করে শহরে এসে থিতু হন। অনেকে সব বিক্রি করে বিদেশে চলে যান। পরে ফিরে এলেও তার আর স্থায়ী ঠিকানা থাকে না। যেভাবেই হোক ভূমিহীন হলেও সরকারি চাকরি পাবে না, এ অন্যায় চলতে পারে না।

প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ তিনি আসপিয়া এবং মীমকে জমি দিয়েছেন, তাদের চাকরির ব্যবস্থাও হচ্ছে। কিন্তু আসপিয়া বা মীম তো ব্যক্তিমাত্র। চাকরি পেতে হলে কাউকে ফেসবুকে ভাইরাল হতে হবে, এটা তো ন্যায়বিচারের কথা নয়। আসপিয়ার আগেও অনেকে এই বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। আসপিয়ার ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর আরও অনেকে তাদের বঞ্চনার কথা বলছেন। ভূমিহীন হলে চাকরি পাবে না, এই নিয়মের যৌক্তিক সমাধান হতে হবে।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে শেখ হাসিনা ভূমিহীনদের জমি ও বাড়ি করে দিচ্ছেন। তার এই স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে হয়তো একদিন দেশে কোনো ভূমিহীন থাকবে না। তবে স্বপ্নের সেই সোনার বাংলা বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সব মানুষ যাতে নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। বিজয়ের স্বপ্ন হলো সব মানুষের সমান অধিকারের রাষ্ট্র গড়ে তোলা।

লেখক: সাংবাদিক-কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর