বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আমাদের বিজয়ের ৫০ বছর

  •    
  • ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৮:০৫

মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাসে নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম-আত্মত্যাগ ও জাতীয়তাবাদের মূল আদর্শ থেকে দূরে ঠেলে আবার সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বিভাজনে ফেলে দেয়া হয়েছিল। প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে নৈরাজ্যবাদ-নিষ্ঠুরতা, বৈষম্য ও বিদ্বেষের মনোভাব জাগিয়ে তোলা হয়। ফলে হারিয়ে ফেলতে হয়েছিল স্বাধীনতার আলোকিত পথ, ধ্যান-ধারণা এবং রাষ্ট্রের যথাযথ ভবিষ্যৎ।

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম ও ৯ মাসের একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সময়। তখন কেউ নিশ্চিত ছিল না, কবে ও কীভাবে এই মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে। এর প্রধান কারণ ছিল, বর্বর পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে প্রথমে প্রতিরোধ ও পরে প্রস্তুতিবিহীন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করা। এমনকি তখন কোনো নির্ধারিত রণাঙ্গন পর্যন্ত ছিল না।

প্রথমে পুরো প্রতিরোধ ও যুদ্ধ ছিল অপ্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চালিত। যদিও পরে কিছুটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, যারা গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর, রাজাকার-আল বদর ও আল শামস বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করে।

দেশ থেকে প্রায় ১ কোটি মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সংগঠন ও সরকার বাধ্য হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধটি সংগঠিত করতে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ বেশ কিছু দেশের সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল।

সুতরাং, দেশের ভেতরে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে অসম এক সশস্ত্র ও কূটনৈতিক যুদ্ধ পরিচালনা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা মোটেও সহজ ছিল না । তবে, প্রায় অসম্ভব এই বিষয়কে সম্ভব করতে এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে এবং সমর্থন-সহযোগিতা দিতে হয়েছিল।

একইসঙ্গে ভারত ও সোভিয়েতসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বের সরকার ও জনগণের সমর্থন নিয়ে বিরোধীশক্তির ষড়যন্ত্র ও কূটনীতিকে পরাস্ত করতে মুক্তিযুদ্ধের সরকারকে দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করতে হয়েছিল। ফলে অনেক মানুষের আত্মত্যাগ-ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস ও অত্যাচার-নির্যাতনের পর অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে বিজয় আনন্দের মধ্য দিয়ে।

তখনও বেশিরভাগ মানুষ ভাবতে পারেনি বাস্তবিকই এতসব অপশক্তিকে পরাজিত করা গিয়েছে। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি দুর্ধর্ষ সেনাসদস্যদের আত্মসমর্পণের দৃশ্য দেখেও বিশ্বাস করতে দ্বিধা হচ্ছিল এই অসম্ভব আসলেই সম্ভব হয়েছে। সেকারণেই ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ঘোষিত হওয়ার পর সমগ্র বাংলাদেশ-ভূখণ্ডে একত্রে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছিল। আনন্দের ঢেউ বয়ে গিয়েছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত।

সব মানুষ একসঙ্গে সেদিন স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করতে পেরেছিল। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাম উচ্চারণ করেছিল।

১৬ ডিসেম্বরের দৃশ্য যারা দেখেনি, তারা কল্পনা করেও বুঝতে পারবে না কেমন আনন্দঘন মুহূর্ত ছিল সেদিন গোটা জাতির জীবনে।

এমন দিন আর বাঙালির জীবনে কোনোদিন আসেনি, আসবেও না। সেদিন বড়-ছোট, গরিব-ধনী, ধর্ম-বর্ণ ও জাতি-উপজাতির মধ্যে কোনো ভেদাভেদ দেখা যায়নি। সবাই একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আনন্দে উল্লাস প্রকাশ করেছে মুক্ত বাতাসের স্পর্শ নিয়ে। অনেক প্রাণ ও ক্ষয়ক্ষতির মূল্যে পাওয়া এই বিজয়। সেকারণেই সেদিনের আনন্দের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যকোনো আনন্দের তুলনা হয় না।

বাঙালির হাতে তখন এই আনন্দ উপভোগ করার মতো অর্থবিত্ত ও খাবার ছিল না। তাই বিজয়ের সেই মুহূর্তটি খাদ্য পরিবেশন দিয়ে নয়, মনের উচ্ছ্বাস-আবেগ, ভালোবাসা ও স্বতঃস্ফূর্ততার বহিঃপ্রকাশ দিয়ে ঘটানো হয়েছিল।

অনেকেই নেচে-গেয়ে সেই আনন্দকে মুখরিত করেছিল। অনেকেই একত্রিত হয়ে শপথ উচ্চারণ করেছিল, মুক্তিযুদ্ধের এই বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে সব ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে। নিজেদের ত্যাগ, কঠোর শ্রম ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে।

সেই মুহূর্তে উচ্চারিত হয়েছিল, এই বিজয় পূর্ণতা পাবে যেদিন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু সবার মাঝে ফিরে আসবেন এবং যখন এই বিজয় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সরকারঘোষিত আদর্শ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে সেদিন।

সেদিন লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হতে শোনা যায়- শোষণ-বৈষম্যহীন, ক্ষুধামুক্ত, অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তার বিধান বাস্তবায়ন করে এই স্বাধীনতাকে যেকোনো মূল্যে পূর্ণতা দিতে হবে। এ ছিল ৫০ বছর আগের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠালগ্নের বাস্তবতা।

সেই বাংলাদেশের আজ ৫০ বছর পূর্ণ হলো। এই ৫০ বছরে অর্জনের যেমন তালিকা একেবারে ছোট নয়, আবার অপ্রাপ্তি ও অসাফল্যের তালিকাও একেবারে কম নয়। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পথচলার এই ৫০ বছর ছিল নানা উত্থান-পতনের ঘটনায় পূর্ণ।

ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে একমাত্র মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিকশক্তি সফল হওয়ার আশা করতে পারত। সেই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে চলতে পারলে বিজয়ের ৫০তম বছরে বর্তমান বাস্তবতার চাইতে অনেক বেশি অর্জন নিয়ে একসঙ্গে উদযাপন করা যেত, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই ৫০ বছরের মধ্যে মাত্র ২১ বছর স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ এবং আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার রাজনৈতিক সরকারের রাষ্ট্রনির্মাণ-পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হওয়া গেছে। বাকি ২৯ বছর কেটেছে সামরিক ও আধা-সামরিক শাসকগোষ্ঠীর শাসনে। যারা আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রনির্মাণের মূলধারা থেকে এ দেশকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল।

দেশ তখন ছিল কক্ষচ্যুত একটি ভিন্ন ও কল্পিত রাষ্ট্রের পথহারা জগতে। ফলে সেই সময়ে এ রাষ্ট্রের অর্জন ছিল বিসর্জনে ভরপুর। পুরো জাতিকে করা হয় বিভক্ত, বিভ্রান্ত-দিকভ্রান্ত।

মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাসে নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম-আত্মত্যাগ ও জাতীয়তাবাদের মূল আদর্শ থেকে দূরে ঠেলে আবার সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বিভাজনে ফেলে দেয়া হয়েছিল। প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে নৈরাজ্যবাদ-নিষ্ঠুরতা, বৈষম্য ও বিদ্বেষের মনোভাব জাগিয়ে তোলা হয়। ফলে হারিয়ে ফেলতে হয়েছিল স্বাধীনতার আলোকিত পথ, ধ্যান-ধারণা এবং রাষ্ট্রের যথাযথ ভবিষ্যৎ।

এই কারণেই ৫০ বছরের ভেতর ২৯ বছরে অর্জন অতি নগণ্য। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির কোনো হাতছানি দেখা যায়নি, পাওয়া যায়নি রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা। একইসঙ্গে শিক্ষা, মেধা-মনন, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনীতেও এই ২৯ বছরের অর্জনে উল্লেখ করার মতো কিছু ছিল না।

যে ২১ বছর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বাংলাদেশ চলেছে, তাতে অর্জনের তালিকা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র্যসীমাও অনেকটাই নামিয়ে আনা গেছে। একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যারা নিম্নবিত্তকে উপরে তুলে আনার অজস্র সিঁড়ি স্থাপন করছে। এখন ৩০ শতাংশ মানুষ মধ্যবিত্তের পরিচয়ে পরিচিত হতে পারছে।

১৯৯১ সালেও এই সংখ্যা ১০ শতাংশের নিচে ছিল। ২০০৮-এ মাথাপিছু আয় ছিল ৭০০ ডলার। ১৩ বছরে তা ক্রমাগত বেড়ে এখন ২ হাজার ৫৫৭ ডলারের সুসংবাদ দিচ্ছে। এ দেশের জনসংখ্যায় নারীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উৎপাদিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখছে। মাতৃ-শিশুমৃত্যু এশিয়ার এই অঞ্চলের দেশগুলোর চাইতে অনেক কমে গেছে। গড় আয়ু ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে।

সামাজিক নিরাপত্তাবলয় এই অঞ্চলের দেশগুলোর সবার চাইতে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি অর্থনীতি, শিল্প-বাণিজ্য, গার্মেন্টস, প্রবাসীর রেমিট্যান্স ও নানা ধরনের দেশি উদ্যোক্তাশিল্প দ্রুত বর্ধনশীলতা লাভ করছে। আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিতভাবে দেখছে।

মনে রাখা জরুরি, ৫০ বছর আগে এ দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। এখন তা ১৮ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু এত জনঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও মানুষকে অন্তত অন্ন-বস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা গেছে। চিকিৎসা-শিক্ষা ও বাসস্থান-সমস্যার সমাধান অচিরেই হয়তো করা সম্ভব হবে। তবে পরিমাণগতভাবে দেশের যে উন্নয়ন ঘটেছে সেটি তখনই টেকসই হবে, যখন এর গুণগত মান শুধু বৃদ্ধিই নয় নিশ্চিতও করতে সক্ষম হওয়া যাবে।

নিকট ভবিষ্যতের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বৈষম্য দূর করে সব মানুষকে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ-কাঠামোতে বসবাসের উপযোগী করে তোলার কঠিন কাজটি সম্পন্ন করা। সেটিও সম্ভব হবে যদি জাতি রাষ্ট্রচিন্তার রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, নাগরিকসমাজ, উৎপাদক ও উৎপাদিকাশক্তি আধুনিক-মননশীল, উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল চিন্তায় সমন্বিতভাবে এগিয়ে যাওয়ার পথে থাকে। সাম্প্রদায়িকতা নয়, জাতিগত ধর্মীয় সম্প্রীতিবোধ ও মানসিকতায় ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালের মতো চলতে হবে।

লেখক: গবেষক ও অধ্যাপক।

এ বিভাগের আরো খবর