বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মানবদরদি সায়মা ওয়াজেদ

  • আহমেদ রিয়াজ   
  • ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৬:২০

সমাজ ও দেশের অবহেলিত এক গোষ্ঠীকে তিনি সমাজের মূলস্রোতে এনে মিশিয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আলো দেখাচ্ছেন। যা মনে করিয়ে দেয় ইউরোপের আঠারো শতকের লেডি উইথ দ্য ল্যাম্পের কথা। দেশ ও সমাজের অসহায় মানুষের সেবায় ইতালির ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল যে পথ তৈরি করেছেন, সে পথে দুনিয়ার সব দেশ ঠিকই একসময় শামিল হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ‘ফাইভ অন ফ্রাইডে’ ব্যানারে ১০০ নারী নেতৃত্বের একটি তালিকা প্রকাশ করে ২০১৯-এর ২০ সেপ্টেম্বর। মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা, প্রতিরোধ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অবদান রেখেছেন যেসব নারী এটি তাদের তালিকা। এই তালিকায় রয়েছেন আইনজীবী-স্বেচ্ছাসেবী, নেত্রী-লেখক, আঁকিয়ে ও বিজ্ঞানীসহ নানা পেশার নারী; এসব নারী তাদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী দক্ষতায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। শুধু স্বেচ্ছাশ্রম হিসেবে অলাভজনকভাবে তাদের এই সেবাদান- নিশ্চয়ই মানবসমাজের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। ওই ১০০ নারীর একজন হচ্ছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তার কাজের কিছু বিবরণ দেয়া হয়েছে এভাবে-

Saima is currently the Chairperson of the Bangladesh National Advisory Committee for Autism and Neurodevelopmental Disorders as well as a Member of the World Health Organization’s Expert Advisory Panel on Mental Health. Recently, she was chosen as WHO’s Goodwill Ambassador for Autism in the South East Asia Region for her innovative work as a spokesperson for individuals with autism in Bangladesh.

(https://www.cugmhp.org/five-on-friday-posts/innovative-women-leaders-in-global-mental-health/)

অর্থাৎ, সায়মা বর্তমানে অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার বিষয়ক বাংলাদেশ জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্য। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশে অটিজম-আক্রান্ত ব্যক্তিদের মুখপাত্র হিসেবে উদ্ভাবনী কাজের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে অটিজম-বিষয়ক ডব্লিউএইচও (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)-এর শুভেচ্ছা দূত হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদ মিয়ার কন্যা। জন্ম ১৯৭২-এর ৯ ডিসেম্বর, ঢাকায়। তার নানা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পুতুলের জন্মের সময় তার নানা ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায়।

১৯৭৫-এ নানার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে বিদেশে ছিলেন। নানার মৃত্যুর পর চরম অর্থনৈতিক-মানসিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে বড় হন পুতুল। তবে পারিবারিক শিক্ষা থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া নৈতিকতা ও নিজের জীবন থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন দেশ বা সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত গোষ্ঠীর সেবায়। আর সেকারণেই বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের ১০০ জনের তালিকায় স্থান করে নিতে পেরেছেন।

এ অর্জন হুট করে হয়নি। তার জীবনের লক্ষ্যই ছিল এটা। এমনকি তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ধরন থেকেই বোঝা যায় অনেক বছর ধরে এ লক্ষ্যে নিজেকে তৈরি করেছেন। ১৯৯৭-এ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক ও ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল মনস্তত্ত্বে স্নাতকোত্তর এবং ২০০৪-এ স্কুল মনস্তত্ত্বে ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময়ই বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়ন বিষয়ে গবেষণা করেন সায়মা ওয়াজেদ। তার গবেষণা কাজটি ফ্লোরিডার অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সায়েন্টিফিক উপস্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

অনেক বছর ধরে তিনি মানবসেবামূলক কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি বিশ্বের অটিস্টিক শিশুদের অধিকার এবং শিশুদের অটিজম-সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০১৩ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত আছেন।

তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলেরও সদস্য। শুধু তাই নয়, পুতুল একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত মনোবিজ্ঞানী ও আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪-এর সেপ্টেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাকে ‘হু অ্যাক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ডে’ সম্মানিত করে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অটিজম স্পিক্সের পরামর্শক হিসেবেও কাজ করছেন সায়মা ওয়াজেদ। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে মানসিক ভারসাম্য ও শারিরীক প্রতিবন্ধী মানুষকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসার চেষ্টায় নিয়োজিত আছেন।

জাতিসংঘের অটিজম সচেতনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে আসছেন ২০১২ সাল থেকে। এছাড়া জাতিসংঘ আয়োজিত ‘অ্যাড্রেসিং দ্য সোশিওইকোনমিক নিডস অব ইন্ডিভিজ্যুয়ালস, ফ্যামিলিস অ্যান্ড সোসাইটিজ অ্যাফেকটেড বাই অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডারস, ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডারস অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড ডিজ-অ্যাবিলিটিজ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ।

অটিজম নিয়ে উদ্ভাবনী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছেন ‘ইন্টারন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পুনম ক্ষেত্রপাল সিংয়ের উদ্যোগে এ অঞ্চলের ১১টি দেশের জন্য এই পুরস্কার চালু করা হয়।

সায়মা ওয়াজেদের উদ্যোগে অটিজম সচেতনতায় বাংলাদেশের একটি প্রস্তাব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পরিষদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যাবলিতে তিনি অটিজম যুক্ত করেন।

২০১১-এর জুলাইয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অটিজম নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন সায়মা ওয়াজেদ। মানসিক স্বাস্থ্য-বিষয়ক গ্লোবাল অ্যাডভাইজরি প্যানেলের সদস্যও হন তিনি। ২০১১ সালে তার উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় অটিজম-বিষয়ক আর্ন্তজাতিক সম্মেলন।

২০১৭ সালে দক্ষিণপূর্ব এশীয় অঞ্চলে অটিজম-বিষয়ক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে মনোনিত হয়েছিলেন সায়মা ওয়াজেদ। অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার ও অন্যান্য মানসিক এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বিষয়ে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আকর্ষণে সহায়তার কারণেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তিনি চ্যাম্পিয়ন।

বর্তমান পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। জলবায়ু ঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্বের অনেক অঞ্চল। এসব অঞ্চল সমুদ্রগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে দীর্ঘদিন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রবল ঝুঁকিতে থাকা ৪৮টি দেশ মিলে তৈরি জোট ক্লাইমেট ভলনারেবল ফোরাম বা সিভিএফ। আর্ন্তজাতিক এ সংগঠনের ‘থিমেটিক দূত’ মনোনিত হয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ। অর্থাৎ মানসিক ও অটিজম ছাড়া জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলাতেও এগিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রীকন্যা।

বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অটিজম ও স্নায়ুবৈকল্য-বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির চেয়ারম্যান সায়মা ওয়াজেদ। তার নেতৃত্বে অটিজম মোকাবিলায় প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বিশ্ব-দরবারে স্থাপন করেছে অনন্য দৃষ্টান্ত। এ লক্ষ্যে ২০১৪ সালে ‘সূচনা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ নামে একটি অলাভজনক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন সায়মা ওয়াজেদ।

অটিজম ও মানসিক স্বাস্থ্য-সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের আর্থিকভাবে সহায়তা করার জন্য তার এই উদ্যোগ। সায়মা ওয়াজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে- প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, তাদের সম্পদ হিসেবে গড়ে দেশ ও দশের উন্নয়নের অংশীদার করে তোলা। এ কারণে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও কাজের সুযোগ তৈরিতে তিনি সদা তৎপর। বাংলাদেশে ২০১৩ সালে পাস হয় ‘নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি ট্রাস্ট অ্যাক্ট’।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। প্রতিবন্ধীদের মনে করা হতো সমাজের বোঝা। কিন্তু সমাজের এই বোঝাকে সম্পদে পরিণত করার যে উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন; তাদের নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছেন এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে যে পরিশ্রম করছেন নিঃসন্দেহে তা কেবল প্রশংসার দাবিদারই নয়, অনুপ্রেরণাও।

সমাজ ও দেশের অবহেলিত এক গোষ্ঠীকে তিনি সমাজের মূলস্রোতে এনে মিশিয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আলো দেখাচ্ছেন। যা মনে করিয়ে দেয় ইউরোপের আঠারো শতকের লেডি উইথ দ্য ল্যাম্পের কথা। দেশ ও সমাজের অসহায় মানুষের সেবায় ইতালির ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল যে পথ তৈরি করেছেন, সে পথে দুনিয়ার সব দেশ ঠিকই একসময় শামিল হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কন্যা হিসেবে আয়েশি জীবনযাপন করতে পারতেন সায়মা ওয়াজেদ। কিন্তু তিনকন্যা আর একপুত্রের জননী সায়মা ওয়াজেদ শুধু প্রধানমন্ত্রীর কন্যাই নন, তিনি যে জাতির পিতার নাতনিও। জাতির পিতার মানবদরদি হৃদয়ের তিনিও উত্তরাধিকার। নানা ও মায়ের মতো তিনিও মানুষ নিয়ে ভাবেন। মানুষের দুখে দুখী হয়ে ওঠেন।

মানুষের জন্য কাজ করেন। ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য তিনি নিজেকে তৈরি করছেন কি না, সেটা ভবিষ্যতই নির্ধারণ করবে। তবে তার এই মানবসেবা নিঃসন্দেহে তাকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য তৈরি হতে সহায়তা করছে। কারণ মানবসেবাই হচ্ছে নেতৃত্বের প্রধান গুণ।

সমাজের অবহেলিতদের আত্মকর্মসংস্থান তৈরি করে, তাদের আত্মসম্মান বজায় রেখে পথ চলতে সহায়তা করার যে কঠিন কাজটি করে দেখাচ্ছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল; একসময় অন্যান্য দেশও তার দেখানো এই পথে হাঁটবে না, সেটা কে বলতে পারে?

লেখক: শিশুসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর