বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিক্ষার্থীদের দাবি মানতে বাধা কোথায়?

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স   
  • ৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৮:৪৯

বিশ্বের অনেক দেশে এখনও শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া প্রচলিত আছে। হাফ ভাড়ার এই দাবিটি যৌক্তিক হলেও কেন শিক্ষার্থীদের এখনও পড়ার টেবিল ছেড়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হচ্ছে সেটাই প্রশ্ন। পাকিস্তান আমলের দাবি নিয়ে এদেশে এখনও মাঠে আন্দোলন করতে হচ্ছে এটি লজ্জাজনক নয়? ১৯৬৯-এর ঐতিহাসিক ১১ দফার মধ্যেও শিক্ষার্থীদের বাসভাড়া অর্ধেক করার দাবি ছিল।

ঢাকায় শিক্ষার্থীরা অর্ধেক ভাড়া দেবে আর ঢাকার বাইরে কী হবে সেটি এখনও ফয়সালা হয়নি। তেলের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে বাসমালিকরা বাসভাড়া বাড়িয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। তেলের দাম বাড়ানোর পেছনে সরকারি অজুহাত ছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়া। জানা যায়, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম আবার কমেছে। কিন্তু আমাদের দেশে বাসভাড়া বলি আর বাসা ভাড়া- কোনোটির দাম একবার বাড়লে তা আর কমতে দেখা যায় না।

তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমার পরেও এখনও সমন্বয় করা হয়নি। কিন্তু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠিকই সমন্বয়ের নামে রাতারাতি বাড়ানো হয়েছে। যে অজুহাতে বাস মালিকরা বাসভাড়া বাড়িয়েছে ধারণা করা যায়, এখন যদি সরকার তেলের দাম কমায়ও, বাসভাড়া আর কমবে না। আসলে এদেশের জনগণকেই সব অনিয়মের সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে হয়।

বাসভাড়া ইস্যুকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা এখনও সড়কে অবস্থান করছে। তাদের দাবি হাফ পাস। বাসমালিক কর্তৃপক্ষ তাদের দাবি মেনেও নিয়েছে। কিন্তু শুধু ঢাকার জন্য। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক প্রশ্ন ঢাকার বাইরে কেন নয়?

গণমাধ্যমে এসেছে, অর্ধেক ভাড়া দিতে চাওয়ায় এক বাস হেলপার নাকি একজন ছাত্রীকে ধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে! এই ঘটনার কয়েকটি অর্ন্তনিহিত বিষয় রয়েছে। নারীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই ঘটনায়। সেই সঙ্গে গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নটিও এর সঙ্গে জড়িত। সর্বোপরি গণপরিবহনে বিরাজমান নৈরাজ্যের বিষয়টি তো রয়েছেই।

দিল্লিতে বাসে ধর্ষণকাণ্ডে (১৬ ডিসেম্বর ২০১৩) দিল্লির জনগণ রাস্তায় নেমেছিল। কিন্তু এর কিছুদিন আগেই (৬ ডিসেম্বর ২০১৩) আমাদের টাঙ্গাইলেও একই ঘটনা ঘটে। দিল্লির জনগণ রাস্তায় নামলেও ঢাকায় কেউ ওভাবে প্রতিবাদ করেনি। গণমাধ্যমে কিছু লেখালেখি হয়েছে কেবল। নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিটিই এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, নারী ধর্ষণকে অনেকেই স্বাভাবিকভাবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তা না হলে একজন ছাত্রী বা নারী হাফ ভাড়া দিতে চাইলে তাকে ধর্ষণ করার হুমকি কীভাবে দেয়া যায়? আর চোখের সামনে সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয় যাত্রীসাধারণ; যারা এই সমাজেরই মানুষ।

এদেশে গণপরিবহনে নারী এখনও পুরোপুরি নিরাপদ নয়। বাসে ওঠা থেকে শুরু করে বাস থেকে না নামা পর্যন্ত নারী-যাত্রীকে তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হয়। বাসে অন্য যাত্রী না থাকলে তো কথাই নেই। স্বল্প সংখ্যক যাত্রী থাকলেও একই কথা। কারণ, বাকিরা তো সব পুরুষ যাত্রী। এমন ভীতিকর গণপরিবহন নারীর কাম্য নয়।

মানুষ শুধু মাঝেমধ্যে এমন ঘটনা ঘটলে একটু প্রতিবাদ করবে। গণমাধ্যমে সংবাদ হলেও পারে না হলেও পারে- এ অবস্থা আর কতদিন! দেশে নারীদেরও পথ চলতে হয়, কাজেই সবার আগে নারীসহ সবার জন্য নিরাপদ সড়ক চাই, এরপর অন্য কথা।

অনেক সময় নারীরা বাসে ওঠার সময় পুরুষ হেলপার ওঠাতে সাহায্য করার নামে তাদের গায়ে হাত দেয়। অবস্থা এমন যে, হেলপারকে পুরুষ যাত্রীর গায়ে হাত দিতে দেখা না গেলেও; নারী যাত্রীদের পিঠে হাত দিয়ে বাসে ওঠাতেই হবে। নারী-যাত্রীরা যাতে বাস থেকে ওঠার সময় পড়ে না যায় সে জন্যই তারা পিঠে হাত দিয়ে বাসে ওঠানো- এটাই তাদের অজুহাত। কিন্তু এই অজুহাতে নারীর গায়ে হাত দিয়ে বাসে ওঠানো শ্লীলতাহানীরই নামান্তর। এসব বন্ধ করা জরুরি।

দিনের পর চোখের সামনে এসব হচ্ছে। আর চলন্ত বাস থেকে নামা ও চলন্ত অবস্থাতেই যাত্রী ওঠানো এদেশে যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। শুধু নামার সময় হেলপারদের বলতে শোনা যায়- বাম পা আগে দেন। বাসস্টপে বাস ঠিকভাবে থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানোর বালাই নেই। বলা যায়, ঢাকায় যেন কোনো বাসস্টপ নেই অথবা পুরো ঢাকা শহরই একটি বাসস্টপ। যেখানে সেখানে যাত্রী নামানো-ওঠানো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে রাস্তায় আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতাও রয়েছে। সুশৃঙ্খলভাবে বাস চলাচল নিশ্চিত করা না গেলে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

রাজধানীতে বাসের প্রতিযোগিতায় প্রাণ-হারানোর ঘটনা নতুন নয়। এ নিয়ে আগেও অনেক হাঙ্গামা হয়েছে। গত সোমবার (২৯ নভেম্বর) আবারও এক শিক্ষার্থী প্রাণ হারান। রামপুরায় অনাবিল পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায় নিহত মাঈনুদ্দীন ইসলাম নামের ওই শিক্ষার্থী বাসায় ফিরছিলেন।

এই প্রতিযোগিতায় যে শুধু যাত্রী বা পথচারীরাই নিহত হয় তা নয়, বাসের হেলপারও নিহত হয়েছে। ৯ ফেব্রুয়ারি উত্তরা থেকে পোস্তগোলাগামী রাইদা পরিবহনের দুটি বাসের প্রতিযোগিতায় এক হেলপার নিহত হয়। আগে গিয়ে যাত্রী ওঠানোর জন্যই এমন প্রতিযোগিতা।

ঢাকার সড়ক ব্যবস্থাপনার ওপর আপাতদৃষ্টিতে কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। যে যেভাবে পারছে গাড়ি চালাচ্ছে। সড়কের অন্তত তিনভাগের একভাগ বাজারের দখলে। কুড়িল থেকে শুরু করে মালিবাগ-গুলিস্তান পর্যন্ত অন্তত এক-তৃতীয়াংশ সড়কের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। যেখানে-সেখানে গাড়ি থামিয়ে রাখা হয়। মূলত, সড়কের এক লেন দিয়েই গাড়ি চলাচল করে। অন্য লেনে যাত্রী ওঠানো ও নামানো হয়; ওই একই লেনে রিকশাও চলে। ওদিকে প্রথম লেনটি বাজারের দখলে, যেখানে আবার যাত্রীরা বাসের জন্য অপেক্ষা করে। কমবেশি সব সড়কে একই অবস্থা। এই অনিয়মের মাঝেই যতটুকু নিয়ম করে চলা যায় যাত্রীরা চলাচল করছে।

বাসভাড়া বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য হাফ ভাড়ার দাবি করলেও এক সময় এদেশের গণপরিবহনে তারা হাফ ভাড়াই দিত। পরিচয়পত্র দেখে হাফ ভাড়া কার্যকর হতো। মালিকপক্ষের কারসাজিতে বাসে সিটিং সার্ভিস চালু হয়। এর মাধ্যমে হাফ ভাড়া দেয়ার প্রথাও বাতিল হয়ে যায়। বিশ্বের অনেক দেশে এখনও শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া প্রচলিত আছে।

হাফ ভাড়ার এই দাবিটি যৌক্তিক হলেও কেন শিক্ষার্থীদের এখনও পড়ার টেবিল ছেড়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হচ্ছে সেটাই প্রশ্ন। পাকিস্তান আমলের দাবি নিয়ে এদেশে এখনও মাঠে আন্দোলন করতে হচ্ছে এটি লজ্জাজনক নয়? ১৯৬৯-এর ঐতিহাসিক ১১ দফার মধ্যেও শিক্ষার্থীদের বাসভাড়া অর্ধেক করার দাবি ছিল। দফা ১-এর (ঢ) উপদফায় বলা ছিল- “ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের ‘আইডেন্টিটি কার্ড’ দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ‘কন্সেসনে’ টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও ‘কন্সেসন’ দিতে হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের মত বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যেকোনো স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলে বাস যাতায়াতেও শতকরা ৫০ ভাগ ‘কন্সেসন’ দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সরকারি ও আধাসরকারি উদ্যোগে আয়োজিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের শতকরা ৫০ ভাগ ‘কন্সেসন’ দিতে হইবে।”

প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকার বাইরে শিক্ষার্থীরা হাফ ভাড়া কেন দেবে না? এ কেমন বৈষম্য? ঢাকার বাইরে বাস ভাড়া কি কম? নাকি সেখানকার শিক্ষার্থীরা অনেক টাকার মালিক? কাজেই, ঢাকার বাইরেও হাফ ভাড়া মেনে নেয়া যুক্তিযুক্ত। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও যেন শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতে গড়িমসি করা না হয়।

ওই ১১ দফার মধ্যে আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য। তা হচ্ছে- দূরবর্তী অঞ্চলেও বাসে যাতায়াতের জন্য শতকরা ৫০ ভাগ ‘কন্সেসন’ চাওয়া হয়। ঔপনিবেশিক পাকিস্তান আমলে এদেশের শিক্ষার্থীরা যে দাবি করতে পেরেছিল, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসেও সেটি দাবি করার সাহসও পাচ্ছে না। তাই তারা কেবল ঢাকায় বা ঢাকার বাইরে যাতে হাফ ভাড়ার ‍সুযোগ দেয়া হয় সে দাবিই করে যাচ্ছে।

আমাদের ছেলে-মেয়েরা ঢাকা না ঢাকার বাইরে তা নিয়েই দিনের পর দিন রাস্তায় বসে আছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের বাহাসও করতে হচ্ছে।

কাজেই, ছাত্রদের ন্যায়সংগত দাবি পূরণে সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন। হাফ ভাড়ার বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও তা কার্যকর করাও জরুরি। সেই সঙ্গে শৃঙ্খলা আনতে হবে গণপরিবহন ও সড়ক ব্যবস্থাপনায়।

লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর