বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

গণতন্ত্র উন্মুক্ত হওয়ার দিন

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৪:০৩

মধ্যদুপুরে কোনো মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে বলতেন, গতকাল রাতে স্বপ্ন দেখেছেন এই মসজিদে তিনি নামাজ পড়বেন। জেনারেল এরশাদের এই ভণ্ডামি খুব বেশি দিন এ দেশের মানুষের কাছে চাপা থাকেনি। কেননা যে মসজিদে এরশাদ নামাজ পড়বেন বলে আগের রাতে স্বপ্নে দেখতেন, সেই মসজিদের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন সাত দিন আগে থেকেই তৎপর থাকতেন। এতে ওই এলাকার মানুষ সহজেই বুঝতে পারতেন এরশাদ কিছুদিনের মধ্যেই এই মসজিদে নামাজ পড়ার স্বপ্ন দেখবেন! ধর্ম নিয়ে এমন মিথ্যাচার ও ভণ্ডামি ইতিহাসে বিরল।

সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৯০-এর ৬ ডিসেম্বর গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। দিনটিকে আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’, বিএনপি ‘গণতন্ত্র দিবস’ ও এরশাদের জাতীয় পার্টি ‘সংবিধান সংরক্ষণ দিবস’ হিসেবে পালন করে। এ ছাড়া অনেক রাজনৈতিক দল এই দিনটিকে ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ হিসেবেও পালন করে থাকে।

এরশাদ কী ছিলেন, কত বড় স্বৈরাচারী ছিলেন; আশির দশকে এরশাদের শাসন যারা দেখেনি, তারা কল্পনাও করতে পারবে না। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ যথার্থই বলেছেন- ‘‘আশির দশকের শুরু থেকেই ভালো করে ঘুম হচ্ছিল না বাঙালির, দুঃস্বপ্নের মধ্যেই কাটছিল দিন রাত; বিরাশির চব্বিশে মার্চের ভোরে দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠে বাঙালি পড়ে আরেক দুঃস্বপ্নে…সেই শুরু হয় বাংলাদেশের কালরাত্রি; ওই কালরাত্রির নাম এরশাদ, বাঙলার ইতিহাসের ঘৃণ্যতম নামগুলোর একটি; আর বাঙালি জীবনের প্রায় একটি দশক, আট বছর আট মাস তের দিন কেটে যায় কালরাত্রির গ্রাসে। যা কিছু অশুভ তার সব নিয়ে সে আসে; আশির দশকে বাংলাদেশে চরম অশুভ মানুষের মুখোশ পরে দেখা দিয়েছিল তার নাম এরশাদ। বাঙলায় বলতে পারি অশুভ বা কালরাত্রি। তার কাছে কোন কিছু পবিত্র ছিল না, তাই সব কিছু সে অপবিত্র করে গেছে; তার নৈতিকতা ছিল না, তাই সে বাঙলার সব কিছুকে অনৈতিকতায় আক্রান্ত করে গেছে; কোন সুস্থতা ছিল না, তাই সে সবকিছুকে অসুস্থ করে গেছে। দিনের পর দিন সে বাঙলাকে অন্ধ থেকে অন্ধতর করে তুলেছে, বছরের পর বছর সে বাঙলাকে করে তুলেছে অপবিত্র।” (হুমায়ুন আজাদ, নরকে অনন্ত ঋতু, পৃষ্ঠা ৯৭)।

এই লোকটি দেশের রাজনীতিকে নষ্ট করেছেন। সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে নষ্ট করেছেন। ধর্মকে নষ্ট করেছেন। দেশের নির্বাচন-ব্যবস্থাকে নষ্ট করেছেন। নষ্ট করেছেন প্রশাসন ও ছাত্র-যুবাদেরকেও। পুরো দেশকেই দূষিত করে গেছেন। যার ফল এখনও ভোগ করতে হচ্ছে।

এরশাদ ১৯৮২-এর ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। নিজেকে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে সামরিক শাসন জারি করেন তিনি, স্থগিত করেন সংবিধান। ১৯৮৩ সালে তিনি রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসেন।

মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলসহ ৩ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীদের বিশাল মিছিলটি সচিবালয়ে যাওয়ার পথে হাইকোর্টের সামনে পৌঁছালে এরশাদের পুলিশ বাহিনী বেপরোয়া গুলি চালায়। এতে মৃত্যুবরণ করেন জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালী সাহাসহ নাম না জানা আরও অনেকে। কালো পিচ ঢালা রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়। সেই শুরু, এর পরের ইতিহাস কেবলই এরশাদের খুনে রাজপথ রঞ্জিত হওয়ার ইতিহাস। পরদিন অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোজাম্মেল পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

পরের বছর ১৯৮৪-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি এরশাদের রাষ্ট্রীয় পেটোয়া বাহিনী ছাত্রমিছিলে ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে হত্যা করে ইব্রাহিম হোসেন সেলিম এবং কাজী দেলোয়ার হোসেনকে। এর পর ধারাবাহিকভাবে গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে। এরশাদের পুলিশ এবং সন্ত্রাসী বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে দেশের নিরীহ ছাত্র-জনতাকে।

১৯৮৪-এর ১ মার্চ দেশব্যাপী আহূত শিল্প-ধর্মঘট ও হরতালের সমর্থনে আগের দিন মধ্যরাতে আদমজী জুট মিল এলাকায় কমরেড তাজুলের নেতৃত্বে শ্রমিকরা প্রচার মিছিল বের করলে স্বৈরশাসক এরশাদের সশস্ত্র অনুচরেরা মধ্যরাতে মিছিলে হামলা চালিয়ে মাথা থেঁতলে নির্মমভাবে হত্যা করে তাজুলকে।

একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল চলাকালে নিজ নির্বাচনি এলাকা গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জের মাটিতে রাজপথে মিছিলের নেতৃত্ব দেয়ার সময় পুলিশের সহযোগিতায় এরশাদের লেলিয়ে দেয়া পেটোয়া বাহিনী দেশপ্রেমিক রাজনীতিক মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিনকে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এদিন সারা দেশে পুলিশের গুলিতে আরও অন্তত ছয়জন নিহত হন। একই বছরের ২৪ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গায় ফজলুর রহমান নামে একজন নিহত হন। ২২ ডিসেম্বর রাজশাহীতে মিছিলে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয় হলের বাবুর্চি আশরাফ, ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজ ও পত্রিকার হকার আব্দুল আজিজ।

১৯৮৫-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিলে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রাউফুন বসুনিয়া। ৩১ অক্টোবর ঢাকার মিরপুরে বিডিআরের গুলিতে ছাত্র স্বপন ও রমিজ নিহত হন।

১৯৮৬ সালের ৭ মে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পাঁচজন, ১৪ মে হরতালে আটজন, ১৫ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রতিরোধ আন্দোলনে ১১ জন, ১০ নভেম্বর হরতাল চলাকালে ঢাকার কাঁটাবন এলাকায় সাহাদত নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়।

১৯৮৭-এর ২২ জুলাই জেলা পরিষদ বিল প্রতিরোধ ও স্কপের হরতালে তিনজন, ২৪ অক্টোবর শ্রমিকনেতা শামসুল আলম, ২৬ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের লক্ষ্মীপুরে কৃষক জয়নাল ও ১ নভেম্বর কৃষকনেতা হাফিজুর রহমান মোল্লা নিহত হন।

একই বছর ১০ নভেম্বর ‘সচিবালয় ঘেরাও’ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর জিরো পয়েন্ট এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন যুবলীগ নেতা নূর হোসেন। যুবলীগের আরেক নেতা নূরুল হুদা বাবুল ও কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের খেতমজুর নেতা আমিনুল হুদা টিটোও সেদিন শহীদ হন।

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে মিছিলে গুলিবর্ষণে খেতমজুর নেতা রমেশ বৈদ্য, হোটেল কর্মচারী জি কে চৌধুরী, ছাত্র মহিউদ্দিন শামীম, বদরুল, শেখ মোহাম্মদ, সাজ্জাদ হোসেন, মোহাম্মদ হোসেন ও আলবার্ট গোমেজ, আবদুল মান্নান, কাশেম, ডি কে দাস, কুদ্দুস, পংকজ বৈদ্য, চান মিঞা, হাসান, সমর দত্ত, পলাশ, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন এবং সাহাদাত হোসেনসহ অন্তত ২২ জন নিহত হন। ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিরোধ আন্দোলনের সময় হামলায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়।

এরপর আসে ১৯৯০ সাল, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতির বছর। এ বছর ১০ অক্টোবর সচিবালয়ে অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের গুলিতে ছাত্র জেহাদ ও মনোয়ার, হকার জাকির ও ভিক্ষুক দুলাল নিহত হন। ১৩ অক্টোবর পুলিশের গুলিতে নিহত হন পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ছাত্র মনিরুজ্জামান ও সাধন চন্দ্র শীল। ২৭ অক্টোবর হরতাল চলাকালে ঢাকার বাইরে দুজন, ১৪ নভেম্বর আদমজীতে ১১ জন, ২৬ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিকশাচালক নিমাই, ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্বদ্যিলয়ের টিএসসি চত্বরে ডা. শামসুল আলম মিলন, ২৮ নভেম্বর মালিবাগ রেলপথ অবরোধে দুজন, ৩০ নভেম্বর রামপুরায় বিডিআরের গুলিতে একজন, ১ ডিসেম্বর মিরপুরে ছাত্র জাফর, ইটভাঙা শ্রমিক আব্দুল খালেক ও একজন মহিলা গার্মেন্টসকর্মীসহ সাতজন।

২৭ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে ময়মনসিংহে দুজন, রাজশাহীতে দুজন, ধানমন্ডিতে একজন ও জিগাতলায় একজন নিহত হন। ৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন দুজন। এভাবে দীর্ঘ ৯ বছর অসংখ্য মানুষের খুনের রক্তে রক্তাক্ত এরশাদ অবশেষে ১৯৯০-এর ৬ ডিসেম্বর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

স্বৈরশাসক এরশাদ শুধু ঠান্ডা মাথার খুনিই ছিলেন না, তিনি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিরও বারোটা বাজিয়েছেন। ক্ষমতায় টিকে থাকতে এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে কাছে টানতে তিনি ১৯৮৮ সালের ৭ জুন সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন। মধ্যদুপুরে কোনো মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে বলতেন, গতকাল রাতে স্বপ্ন দেখেছেন এই মসজিদে তিনি নামাজ পড়বেন।

জেনারেল এরশাদের এই ভণ্ডামি খুব বেশি দিন এ দেশের মানুষের কাছে চাপা থাকেনি। কেননা যে মসজিদে এরশাদ নামাজ পড়বেন বলে আগের রাতে স্বপ্নে দেখতেন, সেই মসজিদের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন সাত দিন আগে থেকেই তৎপর থাকতেন। এতে ওই এলাকার মানুষ সহজেই বুঝতে পারতেন এরশাদ কিছুদিনের মধ্যেই এই মসজিদে নামাজ পড়ার স্বপ্ন দেখবেন! ধর্ম নিয়ে এমন মিথ্যাচার ও ভণ্ডামি ইতিহাসে বিরল।

তার মৃত্যুর পর অনেকেই এরশাদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেছে। অন্যান্য শাসনামলের সঙ্গে তুলনা টেনে এরশাদের দুষ্কর্ম ও অপরাধকে লঘু করে দেখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু একজন খুনিকে কি আরেকজনের খুন দিয়ে বিচার করা যায়? আরেকজন খারাপের তুলনা টেনে খারাপকে ভালো বলা যায়?

ইয়াহিয়া-টিক্কা খান যেমন ১৯৭১-এ ঠান্ডা মাথায় ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল, এরশাদও ক্ষমতায় থাকার জন্য ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ঠান্ডা মাথায় হাজার হাজার প্রতিবাদী মানুষকে খুন করেছেন। এমন একজন নৃশংস খুনিকে যদি আমরা ক্ষমা করে দিই, তাহলে আইয়ুব-ইয়াহিয়া এবং টিক্কা খানদেরও ক্ষমা করে দিতে হয়। এরশাদের অন্য সব অপকর্মের কথা বাদ দিলেও, নিরীহ মানুষ হত্যার কথা ভোলা অসম্ভব।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সাবেক ছাত্রনেতা।

এ বিভাগের আরো খবর