যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ফোর্বসের ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’-তে জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশের বাসিমা ইসলাম। গেল বুধবার এ তালিকা প্রকাশ করেছে সাময়িকীটি। ফোর্বস প্রতিবছর ২০টি ক্যাটাগরিতে ৩০ জন করে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করে, যাদের বয়স ৩০ বছরের নিচে।
এ ক্যাটাগরিগুলোর একটি বিজ্ঞান, যেখানে স্থান পাওয়া বাসিমা বোস্টনের ওয়েস্টার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কম্পিউটার ও তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগে যোগ দিতে যাচ্ছেন। তার ছোট একটি প্রোফাইলও প্রকাশ করেছে ফোর্বস। এতে লেখা রয়েছে, তিনি ব্যাটারি ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারযোগ্য ডিভাইস ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ (আইওটি) তৈরিতে কাজ করছেন।
এক সাক্ষাৎকারে বাসিমা বলেছেন, তার উদ্ভাবিত ডিভাইসটি বিশ্বব্যাপী ইলেক্ট্রনিক্স জগতে পরিবর্তন আনবে। পৃথিবীতে দৈনিক প্রায় ৮৭ লাখ ডিভাইসে ব্যাটারি পরিবর্তন হয়। এই বিপুল পরিমাণ ব্যাটারি তৈরি ও রিসাইক্লিংয়ে ব্যাপক খরচের পাশাপাশি পরিবেশে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। যার সমাধান হতে পারে আইওটি।
এটি ব্যবহার করে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চিকিৎসা ও কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। বাসিমার লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে এক বিলিয়ন আইওটি ডিভাইস তৈরি করা। দেশের ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং বুয়েট থেকে পড়াশোনা করা বাসিমা ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে সদ্যই নিয়োগ পেয়েছেন ৩৭ বছর বয়সি ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরাগ আগরওয়াল। ২০০৫ সালে মুম্বাই আইআইটি থেকে ব্যাচেলর শেষ করে, সে বছরই আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে যান পিএইচডি করতে। ২০১১ সালে টুইটারে যোগ দেয়ার আগে তিনি এটি অ্যান্ড টি ল্যাব, ইয়াহু এবং মাইক্রোসফটে কাজ করেন। ২০১৭ সালে টুইটারের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও) পদেও বসানো হয় তাকে।
ভারতীয়দের মধ্যে আরও আছেন মাইক্রোসফটের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সত্য নাদেলা, গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই, অ্যাডোবির সিইও শান্তনু নারায়ণ এবং মাস্টারকার্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান অজয়পাল সিং বাঙ্গা।সারা বিশ্বে আমাদের বাসিমার মতো হাতেগোনা দুয়েকজন থাকলেও ভারতের সংখ্যাটা অনেক বড় এবং তারা ততধিক বড় পদে মাথা উঁচু করে কাজ করছেন সম্মান, সম্ভ্রম আর বিনয়ের সঙ্গে।
বিশ্বায়নের কালে ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী, এগিয়েও যাচ্ছে। আর এগিয়ে যাওয়ার এ সময়ে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের ছেলেমেয়েরা মেধা দিয়ে, নিজের যোগ্যতা দিয়ে, শ্রম দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে পৃথিবীর শীর্ষস্থানগুলোতে। সেইসঙ্গে আর্থিক দিকটিও পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। পরাগ আগরওয়ালের আনুষঙ্গিক সুবিধার বাইরের বার্ষিক ১০ লাখ ডলার বেতন, শুধুই তার কাজের স্বীকৃতি।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে চাহিদার এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন রয়েছে। প্রযুক্তি এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বাড়ছে, সেটাই স্বাভাবিক। নিত্যনতুন ডিভাইস, ইলেকট্রনিক পণ্য, দামি বা ফ্যাশনেবল পোশাক, বাড়ি, গাড়ি, দামি ফার্নিচার, আরও কতকিছুই এখন আমাদের চাহিদার তালিকায়।
নিজের জীবন নিয়ে উচ্চাশা দোষের কিছু নয়। প্রতিটি মানুষের আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন থাকে। মেধা আর কঠোর শ্রম দিয়ে সে স্বপ্ন পূরণের সফলতার আনন্দময় গল্পও থাকে, ঠিক বাসিমা ইসলাম, পরাগ আগরওয়াল, সুন্দর পিচাই, সত্য নাদেলাদের মতো।
বিষয়টি হলো কষ্টসাধ্য, দুর্গম পথে হাঁটতে আমাদের বড়ই অনীহা। আমরা তড়তড় করে উপরে ওঠার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছি সহজতর পথ। খ্যাতি-মোহ, অর্থ-বিত্ত সবকিছু নিমিষেই হাতের মুঠোয় পেতে মরিয়া। ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই শ্রম-মেধা দিয়ে সময়ক্ষেপণ করে প্রতিষ্ঠা পাওয়াকে সময়ের অপচয় মনে করে।
অন্যদিকে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য আমাদের না আছে বিশ্বখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, না আছে পারিবারিক-সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভালো পরিবেশ। মেধা বিকশিত করার জন্যও নেই ভালো কারিগর। মানুষ গড়ার এই কারিগর শিক্ষকরা নানা দলে-উপদলে বিভক্ত, কুটিল রাজনীতিতে লিপ্ত। রাজনৈতিক পদ-পদবি পাওয়াকেই শিক্ষকতার সর্বোচ্চ প্রাপ্তি মনে করেন।
নিজের ঘর থেকে যে নৈতিক শিক্ষার শুরু, সেখানেও সমস্যা। পিতামাতা অভিভাবকেরা নিজেরাই গোলক ধাঁধায় ভোগেন। কেবলই অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে যোগ্য মানুষ করে গড়ে তোলার পরিবর্তে বেশি অর্থ উপার্জন করার ভাবনাটাকেই প্রাধান্য দেন। তাই সন্তানদের সঠিক পথে পরিচালনা করাটা তাদের জন্যও সহজ হয় না।
আরও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। আমাদের দেশে যেখানে সেখানে দেখা যাওয়া বিপুলসংখ্যক মানহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা শেষ করে বের হচ্ছে ততধিক মানহীন শিক্ষার্থী। পরবর্তী সময়ে যারা বেকার হিসেবে দুঃসহ জীবন শুরু করে। এই বেকারত্বের বাঁধন ছিন্ন করা বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। যে স্বচ্ছলতার সুখস্বপ্ন নিয়ে তারা পড়তে এসেছিল, পড়া শেষ করে কিছুদিনের ভেতরই তাদের মোহভঙ্গ হয়, আশাহত হয়। অথচ সঠিক দিক নির্দেশনার মাধ্যমে কৌশল অবলম্বন করে বিপুলসংখ্যক ছেলেমেয়েকে বেকারত্বের গ্লানি থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত করা সম্ভব।
এ ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর অধিক মাত্রায় জোর দিয়ে টেকনিক্যাল এক্সপার্ট তৈরি করা গেলে দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকারত্ব অনেকটাই কমে আসবে নিশ্চিত। ভারত যে মহাকাশ গবেষণা, পরমাণু শক্তি গবেষণা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কেমিক্যাল অ্যান্ড বায়োকেমিক্যাল গবেষণা অনেক ক্ষেত্রে অভাবনীয় সফলতা দেখাচ্ছে, তার মূলে হলো তাদের উচ্চমানের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখান থেকে শিক্ষা নিয়েই ছেলেমেয়েরা সাফল্যের মুকুটে নতুন পালক যুক্ত করতে পারছে। যতই দিন যেতে থাকবে ভারত এর সুফল ভোগ করতে থাকবে পূর্ণমাত্রায়।
ভারতের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা শেষ করে কেউ বিদেশে ক্যারিয়ার গড়ে, কেউ দেশেই গড়ে। অনেকেই সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠে, তৈরি হয় বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠান।
দেশে আর্থিক সমস্যা আছে, থাকবে। ভারতেরও আছে। এখনও ভারতে বিপুলসংখ্যক মানুষ একবেলা মাত্র খেতে পায়, চিকিৎসার অভাবে মারা যায় অসংখ্য মানুষ, আকাশের নিচে রাত কাটায়, স্যানিটেশন নেই, আরও আরও অনেক কিছু নেই। কিন্তু উচ্চশিক্ষায় ছাড় দেয়নি ভারত। তুখোড় ছাত্রদের শানিত করবার সব ধরনের ব্যবস্থা করে রেখেছে।
তাই উন্নতমানের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মানবিক গুণ যোগ করে যদি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যায়, তবে তা হবে জ্ঞানের ভাণ্ডার, অর্থেরও ভাণ্ডার। তাহলে আমরা লোভ লালসাহীন, উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন মানবিক এক দেশ দেখব, যেখানে অর্থনীতির সুষম বণ্টন হবে, দুর্নীতির মাত্রা আর দারিদ্র্য কমে যাবে। মানসম্পন্ন আধুনিক সভ্যতার সোপান রচিত হবে।
লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক