১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর খাগড়াছড়িতে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও সাংসদ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ৭২ দফার একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এটি ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি নামে অভিহিত।
সেই সময় বিশ্ব গণমাধ্যম এই চুক্তি স্বাক্ষরকে ব্যাপকভাবে প্রাধান্য পায়। বিভিন্ন সরকার এবং মানবাধিকার সংস্থা এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার জন্য সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতিপ্রধান সন্তু লারমাকে অভিনন্দনও জানায়। এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই দশকের বেশি সময় চলে আসা বিরোধ, সংঘাত ও সংঘর্ষ নিষ্পত্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়। পাহাড়ে নিরীহ, নিরপরাধ পাহাড়ি ও বাঙালি বহু মানুষের প্রাণ ঝরে।
একসময় ৯৬-পূর্ববর্তী সরকারগুলো সামরিক বাহিনী নিয়োগ করে এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা করে আসছিল তা মোটেও গ্রহণযোগ্য ও সফল হয়নি। পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস ও চাষবাসের জায়গায় সমতল ভূমি থেকে নিয়ে আসা সেটেলারদের বসিয়ে দেয়ার ফলে যে বিরোধ সৃষ্টি হয় তাতে ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ এবং নিরাপত্তাহীনতার যথেষ্ট কারণ সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় এবং সেটেলারদের মধ্যে সম্পত্তির দখলসহ নানা কারণে বিরোধে রক্তপাত ঘটতে থাকে। এর ফলে স্থানীয় পাহাড়ি নৃ-জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মরক্ষার্থে সংগঠন গড়ে ওঠে যা পরবর্তী সময়ে সশস্ত্র সংঘাত, রক্তপাত ও প্রণহানিতে রূপ নেয়। জনসংহতি সমিতি দীর্ঘদিন গভীর অরণ্যে স্থানীয় পাহাড়ি তরুণদের নিয়ে সশস্ত্র পন্থায় তাদের অধিকার বাস্তবায়নে লড়াই করতে থাকে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠী দেশের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্টের জন্য এ ধরনের সংগঠনকে উৎসাহিত করতে থাকে। এটি বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিপদ তৈরি করতে যাচ্ছিল। সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ নিরসন কিংবা অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করার মাধ্যমে কখনও শান্তি স্থাপিত হতে পারে না এই সত্যটি উপলব্ধির ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী সরকারসমূহের ধারণার সঙ্গে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল, সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং মানবাধিকারে বিশ্বাসী সংগঠন ও জনগণের মত এবং পথের ভিন্নতা ছিল।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক দল এবং জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে আন্দোলনরত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার নিরসনের দাবি করে আসছিল। কিন্তু সামরিক সরকার ও নির্বাচিত বিএনপি সরকার পার্বত্য অঞ্চলে রক্ত ঝরার অশান্ত পরিস্থিতির সমাধানে আন্দোলনরত জনসংহতির সঙ্গে কোনো আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে উপনীত হতে চায়নি।
লোকদেখানো কিছু উদ্যোগ ছাড়া তেমন কোনো কার্যকর ও আন্তরিক প্রচেষ্টা গৃহীত হয়নি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় মানুষের অবাধ যাতায়াত কিংবা বসবাস প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল। আমাদের রাষ্ট্রের বিরাট একটি অংশে এ ধরনের অশান্ত পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন ও অগ্রগতিকেই শুধু বাধাগ্রস্ত করেনি, পাহাড়ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং জাতিগত পশ্চাদপদতা কাটিয়ে ওঠার সুযোগও সুদূর পরাহত হতে থাকে।
বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তার অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ৬ দফা, যেখানে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও জাতিগত অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের মৌলিক অবস্থান স্পষ্ট ছিল। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জাতিগত ও ভাষা-সাংস্কৃতিক অধিকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। এখানে বিরোধের কোনো সুযোগ নেই। অথচ সরকারগুলো সেই বিরোধকে জিইয়ে রাখার জন্যই সংঘাত, সংঘর্ষ ও রক্তপাতকে সমর্থন করে যাচ্ছিল। আন্দোলনরত জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণ করছিল। এর ফলে বাংলাদেশ দেশ ও বিদেশে জাতিগত বিরোধ ও সংঘাত সম্পর্কে ব্যাপকভাবে ভাবমূর্তির সংকটে পড়ে।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা নির্বাচনে বিজয়লাভ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানে সংসদ সদস্য আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহকে প্রধান করে জনসংহতির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনা, সমস্যার কারণসমূহ চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের উপায় নির্ধারণের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশেষে ৭২ দফার একটি দাবিনামায় সমস্যার সমাধানে উভয়পক্ষ শান্তি চুক্তি সম্পাদনে সম্মত হয়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর খাগড়াছড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার এবং জনসংহতি সমিতির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
বিএনপি, জামায়াতসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করে। তারা এই শান্তি চুক্তিকে দেশভাগের চুক্তি হিসেবে অভিহিত করে। এমনকি ফেনী জেলা থেকে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম অঞ্চল বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বলে অপপ্রচার ও অভিযোগ করা হয়।
ঢাকা থেকে রোডমার্চ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে গাড়িবহর নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করা হয়। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পক্ষে ও বিপক্ষে বাঙালি এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে উপস্থাপন করা হতে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসবাস কিংবা যাতায়তের কোনো অধিকার থাকবে না- এমনও প্রচার করা হয়। এ ধরনের অপপ্রচারে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছেন, অনেকেই ব্যক্তিস্বার্থে বিষয়টিকে দেখেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির প্রতি একশ্রেণির মানুষের লোলুপ দৃষ্টি আগে থেকেই ছিল। তারা সেখানে নানা ধরনের এনজিও, ব্যক্তিগত রিসোর্ট, ভূমিদখল, কেনাকাটা এবং ব্যবসায়িক নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার লক্ষ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিবেচনায় রেখেছিল। এদের অনেকে শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করলেও শান্তি চুক্তি হওয়ার পর তারাই সেসব সুযোগ-সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে থাকে।
পাহাড়ি বাঙালি বিরোধ উসকে দিয়ে এরা পাহাড়ের বিভিন্ন ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীকে আবার ভয় ও আতঙ্কে দূরে সরিয়ে দেয়। ফলে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার প্রকৃত সুফল স্থানীয় দরিদ্র ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীর অধিবাসীরা এখনও ভোগ করার পুরোপুরি সুযোগ পায়নি।
এখনও বেশ কটি সংগঠনে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ের আদি জনগোষ্ঠী নানা সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। এটি মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। প্রয়োজন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক, ভাষা-সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটিয়ে অনগ্রসর মানুষগুলোকে বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় যুক্ত করা। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশাল অঞ্চলের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, একইসঙ্গে ভূমি নিয়ে যে দ্বন্দ্ব ও বৈষম্য এখনও বিরাজ করছে তা দূর করা।
বাঙালি এবং ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ ও দূরত্ব নয়, বরং পারস্পরিক সম্প্রীতি, আস্থা ও প্রতিবেশীসুলভ আচরণের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সবারই সমান মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তাহলেই শান্তি চুক্তি শুধু পাহাড়েই নয়, গোটা দেশে মানুষের মনে শান্তি ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালিদেরই উদার হতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকার শান্তি চুক্তি ও সংবিধানের যথাযথ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে এটিই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: গবেষক-অধ্যাপক।