বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনেক বছর আগে লিখেছিলেন, ‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনও বসে/বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি, ফিকাহ ও হাদিস চষে।’... তিনি কথাগুলো বলেছিলেন ভারতবর্ষের, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারকে ইঙ্গিত করে। তিনি যে বাঙালি মুসলমানদের মনোজগতে আঘাত দিয়ে তাদের চৈতন্যোদয় ঘটাতে চেয়েছিলেন, সেই বাঙালি মুসলমান এখনও জেদ ও ফতোয়াবাজিতে ব্যস্ত।নজরুলের সময় ধর্মীয় ফতোয়া জোরদার ছিল, এখন ধর্মীয় ফতোয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক ফতোয়া যোগ হয়েছে। কথায় কথায় প্রতিপক্ষকে গালমন্দ না করলে, বিদেশের দালাল না বানাতে পারলে নেতানেত্রীদের পেটের ভাত হজম হয় না। এটাই এখন আমাদের দেশে ‘গণতন্ত্র’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হ্যাঁ, গণতন্ত্রের জন্য আমরা ভারতবর্ষ ভেঙেছি। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু গণতন্ত্র অধরাই রয়ে গেছে। গণতন্ত্র বলতে আমরা গোষ্ঠীতন্ত্র ও দলতন্ত্রকেই প্রাধান্য দিয়ে চলেছি। আমাদের নেতানেত্রীরা জর্জ ডব্লিউ বুশের সেই আলোচিত উক্তিকেই অনুসরণ করে চলেছেন, ‘যে আমার সঙ্গে নেই, সে আমার বিরুদ্ধে।’
এই বৈরিতা ও ‘শত্রুতাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে শেষ হয়েছে তৃতীয় দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। এতে যেন ‘শাপে বর’ হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জন্য। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের সবাই যেন মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
যারা দলের মনোনয়ন বাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন, তারা স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে নির্বাচনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এতে করে সংঘাত-সংঘর্ষ বেড়েছে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নির্বাচনি সহিংসতায় তিন দফা নির্বাচনে ৩৫ জনের বেশি মৃত্যু হয়েছে বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে।
রাজনীতির ফাঁকা মাঠে ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে বিরোধ ও সংঘর্ষ অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এতে দলের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাবই প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। আওয়ামী লীগের উচিত এই ধরনের উপদলীয় সংঘর্ষ বন্ধের সমাধান খুঁজে বের করা।
এ ক্ষেত্রে প্রার্থী মনোনয়নের প্রক্রিয়া আরও গণতান্ত্রিকভাবে করতে হবে। একইসঙ্গে নির্বাচনি সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। কেবল কয়েকজন প্রার্থীকে বহিষ্কার করলেই হবে না।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও উন্নত ও প্রাতিষ্ঠানিক করতে যখন বিভিন্ন দেশ নিত্যনতুন উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে, তখন আমাদের দেশে ‘একদলীয়’ নির্বাচনেও সনাতন কায়দায় হানাহানি-খুনোখুনি হচ্ছে। মানুষের রক্ত ঝরছে। এমনিতেই আমাদের দেশের নির্বাচনে নানা কারসাজি হয়।
জয়ী হওয়ার জন্য ক্ষমতাসীনরা নানা উপায় অবলম্বন করে। কেবল শক্ত প্রতিপক্ষই কিছুটা হলেও প্রতিরোধ গড়তে পারে। তা না হলে সব নদী সাগরে মিলে যাওয়ার মতো সব ভোট ক্ষতাসীনদের বাক্সে গিয়ে জমা হয়। এমন এক সর্বনাশা ব্যবস্থা থেকে সরে আসার পথ-পদ্ধতি খুঁজে পাওয়া কিংবা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অঙ্গীকার লক্ষ করা যায় না।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের মাধ্যমে ভোটদানের প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। ইভিএমকে কীভাবে আরও বেশি কার্যকর ও উন্নত করা যায়౼ দেশে দেশে চলছে সেই পরীক্ষা। আমাদের দেশেও জাতীয় সংসদ ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কিছু নির্বাচিত সংসদীয় আসন ও কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তা জনপ্রিয়তা পায়নি। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোও এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেনি। বরং অনেক দল জোরেশোরে এর বিরোধিতা করেছে।
এটা ঠিক, ভোটযন্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রয়োজন গণতন্ত্রের স্বার্থেই। কিন্তু তার চাইতে এতটুকু কম দরকারি নয় যন্ত্রের উপরে জনগণের আস্থা, বিশ্বাস। ভোটপ্রক্রিয়া নিয়ে নাগরিক-সংশয় গণতন্ত্রে অভিপ্রেত নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো আর ইভিএম যন্ত্রগুলোর পেট কেটে তার অ্যানাটমি বোঝার সুযোগ পাবেন না। তাদের নির্ভর করতে হবে বিশেষজ্ঞদের মতামতের উপরেই। আমাদের দেশে তেমন বিশ্বাসী বিশেষজ্ঞরও অভাব রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে যারা আঙুল তুলেছেন এই বোবা ভোটযন্ত্রের সততা আর বিশ্বাসযোগ্যতায়, তাদের মধ্যে রয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা, এমনকি আছেন দস্তুর মতো আইটি বিশেষজ্ঞও।
দোষ অবশ্য যন্ত্রের নয়, যন্ত্র যারা চালায়, যাদের কথায় চালায়, তাদের। কিন্তু তাদের মনোভাব বদল করবে কে? তবে কি হানাহানি মারামারি, খুনোখুনি, ‘মানি না, মানব না’-র পাশাপাশি কাগজের ব্যালটে ষোলো কোটি ভোটারের ভোটপ্রক্রিয়া চলতে থাকবে? আর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের সঙ্গে ইভিএমে ভোটগ্রহণও কেবল প্রশ্ন হয়েই থাকবে?
আমরা দলাদলি নিয়ে যখন ব্যস্ত, দেশের একজন প্রধান নেত্রীর জীবন-মৃত্যু নিয়ে নানাবিধ গুজব নিয়ে মত্ত তখন উন্নত বিশ্বে ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বাধুনিক ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। একটা উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
বিটকয়েন এবং সার্বিকভাবে ক্রিপ্টোমুদ্রা নিয়ে বিপুল বিতর্ক দুনিয়াজুড়ে। সে পরিসরে না ঢুকেও নির্দ্বিধায় বলা চলে যে, বিটকয়েনের চলমান ইতিবৃত্ত দুনিয়াকে দিয়েছে অন্য এক বলিষ্ঠ উত্তরাধিকার। তা হলো ‘ব্লকচেইন প্রযুক্তি’, যার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে বিটকয়েনের বিজ্ঞান এবং নিরাপত্তার চক্রব্যূহ। ব্লকচেইন যেন লেজার বা খেরোর খাতা, যার তথ্যগুলো জমা রয়েছে গাদা গাদা ব্লকের মধ্যে।
একটা ব্লক তথ্যে পূর্ণ হয়ে গেলে, তা জুড়ে দেয়া হয় আগের ব্লকগুলোর সঙ্গে। শিকলের মতো, প্রায় অচ্ছেদ্য এক বন্ধনে। ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে জমা হওয়া তথ্যের প্রায় অলঙ্ঘনীয় নিরাপত্তার কারণেই এর বিপুল ব্যবহার শুরু হয়েছে জমি নিবন্ধনে, শেয়ার বাজারের কেনাবেচায়, ব্যাংকের বিবিধ কাজকর্মে, ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশে। ভোটপ্রক্রিয়াতেও।
ইতোমধ্যেই ভোটের কাজে ব্লকচেইনের ব্যবহার হয়েছে নানা দেশে। ২০২০-র আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্প-বাইডেনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের উত্তেজনার আবহে অনেকেই খেয়াল করেননি, সে দেশের উটাহ (Utah) রাজ্যের উটাহ কাউন্টিতে ভোট হয়েছিল ‘ভোটস’ নামের ভোটিং অ্যাপের সাহায্যে, ব্লকচেইন-ভিত্তিক প্রযুক্তির প্রয়োগে। এটা সম্ভব হয়েছে কারণ আমেরিকার বিভিন্ন অংশে ভোট হয় স্থানীয় নিয়মে। তার অনেক আগে, সেই ২০১৪-তেই, ডেনমার্কের রাজনৈতিক দল ‘লিবারাল অ্যালায়েন্স’ তাদের দলীয় নির্বাচনে ব্যবহার করেছে এই প্রযুক্তি। ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে প্রথম রাষ্ট্রীয় ভোট অবশ্য হয়েছে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনে, ২০১৮-তে। পরবর্তীকালে ব্লকচেইনের সাহায্যে ভোট নেয়ার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে জাপানের সুকুবা শহরের ভোটে, ২০১৯-এ মস্কোর সিটি কাউন্সিলের ভোটে, ২০২০-এ রাশিয়ার সংবিধান সংশোধনের গণভোটে, এই সেপ্টেম্বরের রাশিয়ার পার্লামেন্টের নির্বাচনেও।
প্রাচীন গ্রিসে মাটির পাত্রের ভাঙা টুকরোকে ব্যবহার করা হতো ব্যালট হিসেবে। সেখান থেকে শুরু করে ইভিএম পর্যন্ত এসেই তো এই বিবর্তন থেমে যেতে পারে না। পরের ধাপে ব্লকচেইনের সার্বিক ব্যবহার তাই এক প্রকার নিশ্চিত। তবে নতুন পদ্ধতি প্রয়োগের আগে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলোচনা-সমালোচনা, বাদানুবাদ হবেই।
রাশিয়া বা আমেরিকায় ব্লকচেইন প্রয়োগে কিছু দুর্বলতা দেখা গিয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে আরও উন্নত করতে চাইবেন এর প্রয়োগ-পদ্ধতি। আশা করা যায়, যথেষ্ট নিরাপদ হবে ভবিষ্যৎ ব্লকচেইন ভোটিং।
গণতন্ত্রে ভোটযন্ত্রের প্রযুক্তির নিরপেক্ষতা ও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা যতটা দরকারি, তার চাইতে এতটুকু কম প্রয়োজনীয় নয় জনগণের মনে প্রত্যয় জাগানো যে, ভোট এবং তার গণনা নিরপেক্ষভাবেই হয়েছে। প্রযুক্তি যাচাই করে বিশ্বাসের আবহ বিস্তারের মূল দায়িত্ব অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের। অগণিত সাধারণ মানুষ তো প্রযুক্তি বোঝেন না। যে-সব বিশেষজ্ঞ ইভিএম-এর অ্যানাটমি বোঝেন, ব্লকচেইনের উন্নততর প্রযুক্তি হয়তো তাদেরও অনেকের আয়ত্তের বাইরে। তাতে অবশ্য বিশেষ সমস্যা নেই।
সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিবিদরা ব্লকচেইন-ভোটিংকে সার্টিফিকেট দেবেন, প্রতিষ্ঠান একে ভরসাযোগ্য মনে করে তবেই এর প্রয়োগে উদ্যোগী হবে। প্রচারের মাধ্যমে জনগণের মনে এই যান্ত্রিক ভোটযন্ত্র সম্পর্কে প্রত্যয় জাগানোর চেষ্টাও হবে। তবু, ইভিএম বা ব্লক-চেইন পদ্ধতিতে ভোট হওয়ার পর কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা যে ভবিষ্যতে, বিশেষত ভোটে হারার পরে নতুন ভোটযন্ত্রের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না, তার গ্যারান্টি কে দেবে?
তাই ইভিএম হোক বা ব্লকচেইন-ভিত্তিক ভোটযন্ত্র, কিংবা ভবিষ্যতের অনাগত কোনো প্রযুক্তি, ভোটের ক্ষেত্রে কাগজের বিস্ময়কর ক্ষমতার বন্ধনের সঙ্গে ভোটযন্ত্রকে কুস্তি চালিয়ে যেতেই হবে। আমাদের লড়াইটা অবশ্য আরও অনেক পুরোনো, যা অন্তত ২০ বছর আগে শেষ হওয়ার কথা ছিল অর্থাৎ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ভোটের আয়োজন নিশ্চিত করা। যা আপাত-অবাস্তব, অসম্ভব, অথচ অনিবার্য এক লড়াই।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সাবেক ছাত্রনেতা।