বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিকড় সন্ধানী গবেষক রফিকুল ইসলাম

  • আহমেদ রিয়াজ   
  • ১ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৫:১৫

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে জেলখানায় বন্দি করে রাখা হয়। কিছুদিন জেলও খেটেছেন। তবে ওয়াশিংটন ডিসিতে তার কিছু বন্ধু ছিল। সেই বন্ধুরা এক সিনেটরের মাধ্যমে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে চাপ দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুক্ত করার জন্য। সেই চাপে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে তিনিও মুক্তি পান। যদিও মুক্তির পর মুনাফেক ভুট্টোই আবার শিক্ষকদের খুঁজে বের করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মন্ত্রীদের বাড়ি ঘেরাও করলেন। বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ তখন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবন। সচিবালয়ের পাশাপাশি সেটাও ঘেরাও করলেন ছাত্ররা। সেটাই ছিল প্রথম সচিবালয় ঘেরাও।

সে ঘেরাওয়ে পিকেটিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নাইমুদ্দিন আহমেদ, শওকত আলী, আজীজ আহমেদসহ অনেক ছাত্রনেতা। আন্দোলনে ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ করল ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ল পাকিস্তানি পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হলো অসংখ্য ছাত্রকে। পরিবারের সঙ্গে তখন রমনায় ফজলুল হক হলের উল্টো দিকে রেলওয়ে কলোনির বাসায় থাকতেন রফিকুল ইসলাম। তিনি তখন সেন্টগ্রেগরি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র।

অপার কৌতূহল নিয়ে দূর থেকে প্রত্যক্ষ করলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন; বঙ্গবন্ধুকে জীবনে প্রথম দেখলেন। ছাত্ররা মাটিতে শুয়ে সচিবালয়ের প্রবেশপথ আটকে দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবকেও মাটিতে শুয়ে পড়তে দেখেছিলেন। আর দেখলেন একজন আহতকে (শওকত) রিকশায় করে মেডিক্যালে নিয়ে যাচ্ছেন শেখ মুজিব। ওটা ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথমপর্যায়।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চূড়ান্তপর্যায় ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। রফিকুল ইসলাম তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্রদের মিছিলে অংশ নিলেন তিনি। তার হাতে একটা ভয়েগল্যান্ডার ক্যামেরা। ক্যামেরায় ছবি তোলার শখ তার ছোটবেলা থেকেই। ১৯৪৩ সালে তার ছিল একটি ‘কোডাক’ ব্র্যান্ডের ‘সিক্স টুয়েন্টি বক্স’ ক্যামেরা। সে ক্যামেরা দিয়ে রমনার সৌন্দর্য ধরে রাখতেন ছবি তুলে তুলে। তখন এক রোল ফিল্মে আটটা সাদা-কালো ছবি উঠত। আর সে ছবি ডেভেলপ ও প্রিন্ট করতে চলে যেতেন নবাবপুর রোডের ‘ডস’ স্টুডিওতে।

ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশবিভাগ হলো ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক উৎসব হয়েছিল কার্জন হলের সামনের মাঠে। সে অনুষ্ঠানের ছবি তুললেন নিজের ক্যামেরায়। কিন্তু ছবিগুলো ভালো হয়নি। ১৯৪৮ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের মাস, মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে বোন ফাতেমা জিন্নাহসহ ঢাকায় এলেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।

রমনার ঘোড়দৌড় মাঠের জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন জিন্নাহ। তার বক্স ক্যামেরায় সেদিনকার জনসভার ছবিও তুলেছিলেন রফিকুল ইসলাম। কিন্তু সে ছবিও ভালো হয়নি। তারপর ১৯৪৯ সালে এক বিলাতফেরত ভাইয়ের কাছ থেকে উপহার পেলেন জার্মানির তৈরি ক্যামেরা ‘ভয়েগল্যান্ডার’ ব্র্যান্ডের ফোর পয়েন্ট ফাইভ ল্যান্সরিফ্লেক্ট ক্যামেরা। যদিও ক্যামেরাটি ‘রোলি ফ্ল্যাস্ক’ বা ‘রোলি কড’-এর মতো অটোমেটিক ছিল না; অ্যাপারচার, ডিসটেন্স ও টাইমিং ঠিক করতে হতো হাতে। তবু এ ক্যামেরা দিয়ে জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, কলিম শরাফী, কামেলা শরাফীর মতো ব্যক্তিত্বের চমৎকার ছবি তুলেছিলেন।

আর তুলেছিলেন একটি জাতির উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ছবি। তার সবচেয়ে আলোচিত ছবি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবন প্রাঙ্গণে ছাত্রছাত্রীদের ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে রফিকুল ইসলাম বলেছেন-

“১৪৪ ধারা ভঙ্গের ছবি তোলার জন্য আমাকে কলাভবনের ছাদে উঠতে হবে। কিন্তু সমস্যা ছিল এই যে ছাদে ওঠার কোনো সিঁড়ি ছিল না, ছিল একটা ছোট ফোকর। ওই ফোকর দিয়ে আমার বন্ধুরা আমাকে ছাদে তুলে দিল। আমি সেখান থেকে আমতলার সভার এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন দলের লম্বা লাইনের ছবি তুলতে লাগলাম।”

(সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ছবি তোলা: রফিকুল ইসলাম-প্রথম আলো ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)

এছাড়া বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির মিছিল, ১৯৫৩ সালে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের পিছনে অবস্থিত ঢাকা কলেজের পুরোনো ক্যাম্পাসে ইডেন কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রীদের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রভাতফেরি, কলাভবনের উপর কালো পতাকা উত্তোলন, আজিমপুর গোরস্থানে শহীদ আবুল বরকতের কবরের পাশে মুর্শিদাবাদ থেকে আসা বরকতের মা, ঢাকার নয়াপল্টনে বসবাসকারী বরকতের বোন ও দুলাভাই, ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল শামসুজ্জামান চৌধুরী, উর্দু প্রফেসর আহসান আহমদ আশক ও ইডেন কলেজের প্রিন্সিপাল মিসেস ফজিলতুন্নেসা জোহা কর্তৃক ছাত্রছাত্রীদের বাধা দেয়ার ছবিসহ অনেক ছবি তুলেছিলেন। যে ছবিগুলো এখন বাঙালি জাতির গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।

শুধু ছবি তুলেই ক্ষান্ত ছিলেন না রফিকুল ইসলাম। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি আন্দোলনের সঙ্গেও সরাসরি জড়িয়ে পড়লেন। ১৯৫১ সালে ‘জবানবন্দী’ নামে মুনির চৌধুরীর একটি নাটকও মঞ্চস্থ করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমি করার দাবি জানানোদের মধ্যেও একজন ছিলেন তিনি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে তাদের দাবি অনুযায়ী বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা পায়।

জাতি হিসেবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনেকগুলো কঠিন ও সংগ্রামময় অধ্যায় পেরিয়ে এসেছে বাঙালি। এর মধ্যে উল্লেযোগ্য ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, ছেষট্টির স্বাধিকার, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ। জাতির এসব প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যময় অধ্যায়ের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন রফিকুল ইসলাম। আর ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে প্রত্যেকটা অধ্যায়ে রয়েছে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৪৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রায় ছয়দশক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই কেটেছে তার দিনগুলো।

রফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার কলাকান্দা গ্রামের পাটওয়ারি বাড়িতে। তার বাবা মো. জুলফিকার আলী ছিলেন রেলওয়ে কর্মকর্তা ও ডাক্তার। মা জান্নাতুন নেছা। শৈশবের কিছুটা সময় গ্রামে থাকলেও, ঢাকায় ছিলেন স্থায়ী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়াশোনার পর, ভাষাতত্ত্বে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন ও গবেষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়, মিশিগান-অ্যান আরবর বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্ট ওয়েস্ট সেন্টারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন ১৯৫৮ সাল থেকে। পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে গবেষণাও করতে থাকেন। নজরুলকে নিয়ে গবেষণা করার পিছনে ছিল তার শিক্ষক প্রফেসর মো. আব্দুল হাইয়ের অনুপ্রেরণা। মো. আব্দুল হাই তাকে বলেছিলেন, “নজরুলের উপর কোনো একাডেমিক কাজ হয়নি, তুমি নজরুলের জীবন ও কবিতার উপর কাজ শুরু করো।”

এরপর তিনি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন। কথা বলেন কবিপত্নী প্রমিলা দেবীর সঙ্গে।

রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশে প্রথম নজরুল গবেষক। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক ও নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে জেলখানায় বন্দি করে রাখা হয়। কিছুদিন জেলও খেটেছেন। তবে ওয়াশিংটন ডিসিতে তার কিছু বন্ধু ছিল। সেই বন্ধুরা এক সিনেটরের মাধ্যমে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে চাপ দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুক্ত করার জন্য।

সেই চাপে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে তিনিও মুক্তি পান। যদিও মুক্তির পর মুনাফেক ভুট্টোই আবার শিক্ষকদের খুঁজে বের করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল। খবর শুনে বেশিরভাগ শিক্ষক পালিয়ে গিয়েছিলেন। পালাতে না পেরে হত্যার শিকার হয়েছিলেন ড. খায়ের। রফিকুল ইসলামের সামনেই হত্যার শিকার হলেন আরও অনেকে। তিনি ছিলেন সেসব গণহত্যার সাক্ষী।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশ পুনর্গঠন কাজে তার ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক অংশগ্রহণ। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর’ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি। সেটার সংশোধিত ও বর্ধিত সংস্করণ ‘শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ বইতে ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা তুলে ধরেছেন।

এ ছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘নজরুল নির্দেশিকা’, ‘ভাষাতত্ত্ব’, ‘নজরুল জীবনী’, ‘বীরের এই রক্তস্রোতে মাতার এ অশ্রুধারা’, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম’, ‘ঢাকার কথা’, ‘ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনার’, ‘কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও কবিতা’, ‘কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সাহিত্য’, ‘কাজী নজরুল ইসলামের গীতি সাহিত্য’, ‘শহীদ মিনার’, ‘আবদুল কাদির’, ‘বাংলা ভাষা আন্দোলন’, ‘বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ’, ‘ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধাবলী’, ‘অমর একুশে ও শহীদ মিনার’, ‘কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সৃষ্টি’, ‘কিশোর কবি নজরুল’ ইত্যাদি।

২০১৮ সালের ১৯ জুন তিনি জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত হন। অর্জন করেছেন স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়ার সময় বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষক ছিলেন রফিকুল ইসলাম। কর্মজীবনে তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। ছিলেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের সভাপতি এবং বাংলা একাডেমির সভাপতি। এছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

বাংলাভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন রফিকুল ইসলাম। তার মতে, ‘‘আমাদের ’৫২, ’৬২র শিক্ষা, ’৬৬র স্বাধিকার, ’৬৯ গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০ নির্বাচন, ’৭১ অসহযোগ ও মুক্তিযুদ্ধ, এই যে এত ধারাবাহিকতা এত দ্রুত ঘটনাগুলো ঘটে গেছে এবং ক্রমশ এটা উত্তরোত্তর এত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। সমস্ত দেশ এমনভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সম্পৃক্ত হয়েছে এবং ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে পাকিস্তানি সশস্ত্র গণহত্যা শুরু করার পর সমস্ত দেশ যেভাবে একাত্ম হয়েছে- বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে কোথাও এ ধরনের ঘটনা নেই। আমরা হাজার বছর ধরে বহিরাগতদের দ্বারা শাসিত হয়েছি, শোষিত হয়েছি, নির্যাতিত হয়েছি, জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়েছি এবং দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম হয়েছি এবং বিদেশি ভাষা দ্বারাও আমরা শাসিত হয়েছি। কিন্তু আমরা ফিরে দাঁড়িয়েছি ’৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে। তারপর আর আমরা পিছনে তাকাই নাই।”

বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলাকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য তার ছিল নিরলস প্রচেষ্টা। এ বিষয়ে তার কিছু অভিমতও আছে। “যেসব কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যম ইংরেজি, তাদের জন্য তো বাংলা ভাষাটা বাধ্যতামূলক করা উচিত। এখানে চার লেভেলে পরীক্ষা হয়। এ লেভেলে ১০০ মার্ক বাংলা আছে। যেখানে নাই, সরকারের উচিত ব্রিটিশ কাউন্সিলকে বলা যে, তোমরা হয় এ লেভেলে ১০০ মার্ক বাংলা ঢোকাও- আগে কিন্তু এটা ছিল- ক্লাস নাইনে বাংলাদেশে আমরা এলাউ করবো না। সবচেয়ে ক্ষতিকর কাজ হচ্ছে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সিরিয়ালে যে ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে এগুলো প্রমিত বাংলাও নয়, কোনো অঞ্চলের উপভাষাও নয়। চট্টগ্রামের না, ঢাকার না, সিলেটের না- কোনো অঞ্চলের নয়। এটা একটা জগাখিচুড়ি করে বাংলা ভাষাটাকে বিকৃতির চরমে নিয়ে গেছে। আমাদের বাংলা ভাষা এমন একটা সুন্দর ভাষা এবং একটা পরিমার্জিত ভাষা, সেটা অমার্জিত অশ্লীল ভাষায় রূপান্তর করার একটা চক্রান্ত ওই পাকিস্তান আমলে একবার হয়েছিল। এখন আবার হচ্ছে।”

(সূত্র: ভাষা আন্দোলনের সময় নিয়ে রফিকুল ইসলামের সাক্ষাৎকার-বেবী মওদুদ। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম-২১ ফেব্রুয়ারি ২০১১)

বাংলাভাষার অন্যতম পুরোধা গবেষক, অন্যতম লেখক রফিকুল ইসলাম ৮৭ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন গতকাল ৩০ নভেম্বর। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি তার প্রয়াণে শোকবার্তা জানিয়েছেন। তার প্রয়াণ বাংলা ভাষার গবেষণায় অপূর্ণতা রয়ে গেল। তবে তিনি বাঙালির জন্য রেখে গিয়েছেন তার অসংখ্য গবেষণাকর্ম, সাহিত্যকর্ম, আলোকচিত্রকর্ম।

আর এসব কর্মই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে বাঙালি হৃদেয়ে। শিকড় হয়ে রইলেন। আরেক সাক্ষাৎকারে তিনি যেমন বলেছিলেন- “কলাভবনের সামনের বটগাছটা দেখেছেন? এটা আসল গাছটা নয়, জানেন? মুক্তিযুদ্ধের পর সিনেটর কেনেডি এসেছিলেন। তাকে দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কেটে ফেলা আসল গাছটির একটি অংশ লাগানো হয়। তবে এভাবে কি চাইলেই একটা গাছ কেটে ফেলা যায়? শিকড় তো রয়েই যায়।”

সহায়ক:

চাঁদপুরের চাঁদমুখ: সম্পাদনা আশিক বিন রহিম

Prof. Rafiqul Islam: A Witness to the Language Movement and the Liberation of Bangladesh-The Daily Star- Feb 17, 2018

লেখক: শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

এ বিভাগের আরো খবর