একাত্তরের ২৬ মার্চ সকালে একজন পাকিস্তানি মেজর খুব কাছ থেকে পর পর তিনটি গুলি করে সাংবাদিক চিশতীর বুক বরাবর। প্রথম গুলিটি লাগার সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করেন চিশতী। সে শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই বাংলার জমিনে ছিটকে পড়ে চিশতীর দেহটি। পাকিস্তানিদের বর্বর নিধনযজ্ঞে শুধু চিশতী নয়, তার মতো আরও হাজারো মানুষের তাজা-উষ্ণ রক্তের বিনিময়ে শুরু হয়েছিল ইতিহাসের এক মহাকাব্যিক যাত্রা। যে কাব্যের শেষ অঙ্কে লালসবুজের পতাকা আর রক্তের দামে কেনা একটি মানচিত্র পায় সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি।
সাংবাদিক চিশতীর পুরো নাম চিশতী শাহ হেলালুর রহমান। তিনি ১৯৭১ সালে দৈনিক আজাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ছিলেন। থাকতেন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ২১২ নম্বর কক্ষে। শুধু সাংবাদিকতা নয়, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই তরুণ একজন দক্ষ সংগঠকও ছিলেন।
জহুরুল হক হলের ছাত্র সংসদের পাঠাগার সম্পাদকের দায়িত্বটিও ছিল তার। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির সহসভাপতি ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন চিশতী শাহ হেলালুর রহমান।
হলের হাজারো ছাত্রের মধ্যে চিশতীকে সহজেই চেনা যেত তার আলাদা বৈশিষ্ট্যের জন্য। তিনি বঙ্গবন্ধুর মতোই সাদা কাপড়ের পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন। তিনিও মোটা ফ্রেম এবং খুব ভারী কাচের লেন্সের চশমা পরতেন চিশতী, ছিলেন গ্লুকোমার রোগী। চুলের মাঝখান দিয়ে সিঁথি কাটতেন বলে সহজেই চিশতীকে আলাদা করে চেনা যেত। সবসময় হাসি লেগেই থাকত তার মুখে।
আগাগোড়া রাজনীতি-সচেতন চিশতী ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১১ দফা আদায়ের এক মিছিলে ‘আইয়ুব-মোনেম ভাই ভাই, এক রশিতে ফাঁসি চাই’- উচ্চকণ্ঠে এই স্লোগান দিতে দিতে বর্বর পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন তিনি। রাইফেলের বাটের আঘাতে থেঁতলে যায় তার এক পা।
একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতেও প্রতিবাদ সমাবেশে সবসময় সামনের সারিতে ছিলেন চিশতী। যার বর্ণনা পাওয়া যায় তার বন্ধু মফিজুল ইসলামের বর্ণনাতে। মফিজুল ‘আমার বন্ধু’ শিরোনামের এক লেখাতে মার্চের উত্তাল দিন, তথা চিশতীর জীবনের শেষ দিককার বর্ণনা তুলে ধরেছেন বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘স্মৃতি: ১৯৭১’ সংকলনে। মফিজুল ইসলাম লিখেছেন-
“চিশতী এদেশের মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির একটি সংগ্রামী কণ্ঠ। পয়লা মার্চ দুপুরের দিকে ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণের পর পরই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে স্লোগান দিতে দিতে এক বিশাল ছাত্র জনতাকে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় চিশতী। মনে হলো, যেন হাজার বছরের জমে থাকা আগুন একসঙ্গে জ্বলে উঠল ওর কণ্ঠ। ... স্লোগানের ঐ কণ্ঠে কী যে এক বিদ্রোহী চেতনা বুকের মধ্যে জেগে উঠতো, তা বুঝানো যাবে না।” (পৃষ্ঠা ৪১৭, প্রথম খণ্ড, স্মৃতি: ১৯৭১)
শুধু তাই নয়, ৫ মার্চ সেসময়ের ইকবাল হলে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে সালাম জানান চিশতী। শপথ নেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। এর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের টানা অসহযোগ কর্মসূচি আর দুর্বার আন্দোলনের মধ্যে বাঙালি জাতির জীবনে আসে ২৫ মার্চ কালরাত। যে রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যতম টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষ করে জহুরুল হক হল (সেসময়ের ইকবাল হল)।
কারণ, এ হল ছিল আন্দোলনের দুর্গ; এছাড়া আন্দোলনের সামনের সারির ছাত্র-নেতারা এই হলেই থাকতেন। এখান থেকেই ঘোষিত হতো বিভিন্ন কর্মসূচি, আসত গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত। ইতিহাসের বর্বর ওই রাতে হলটির উপর প্রবল আক্রোশে গোলাবর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনারা।
যা থেকে বাঁচতে চিশতী তার হল আর মিলনায়তনের মধ্যকার শেডের উপর লাফিয়ে পড়েন এবং সারারাত ওখানেই অবস্থান করেন। দিনের আলো ফোটার পর সেখান থেকে মাথা উঁচু করতেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান চিশতী। এরপর তাকে নেয়া হয় পুকুরের পাশে একজন পাকিস্তানি মেজরের সামনে। সেখানেই চিশতীকে হত্যা করা হয়।
সাংবাদিক চিশতীকে হত্যার বর্ণনায় তার বন্ধু মফিজুল ইসলাম আরও লিখেছেন-
“দৈনিক আজাদের বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে নিজের পরিচয়পত্র পেশ করল চিশতী। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। হলের পেছন দিক থেকে ডাইনিং হলের দিকে যেতে যে সরু রাস্তাটা- তারই পাশে ড্রেনের কাছে গাছটির নিচে দাঁড় করিয়ে পর পর তিনটি গুলি করা হয় চিশতীকে।” (পৃষ্ঠা ৪১৮, প্রথম খণ্ড, স্মৃতি: ১৯৭১)
২৭ মার্চ জহুরুল হক হলের মাঠে লাশের সারির মধ্যে চিশতীকে খুঁজে পেয়েছিলেন কবি নিমর্লেন্দু গুণ। হাজারো লাশের মিছিলে একজন চিশতীর স্মৃতি রক্ষায় এই কবি লেখেন-
“জহুর হলের মাঠে শুয়ে আছে একদল সারিবদ্ধ যুবা,
যন্ত্রণাবিকৃত মুখ তবু দেশমাতৃকার গর্বে অমলিন।”
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।