বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রাজস্ব প্রশাসন ও করজাল সম্প্রসারণে করণীয়

  • মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া   
  • ৩০ নভেম্বর, ২০২১ ২০:৫১

করের আওতা সম্প্রসারণ করে, করহার সুষম করে, প্রয়োজনীয় অটোমেশন সম্পন্ন করে মোট দেশজ উৎপাদনে করের অনুপাত বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা ও লক্ষ্য থাকলেও উদ্দেশ্য অর্জনে বিলম্ব হচ্ছে। এসডিজি বাস্তবায়নের স্বার্থে ২০২১ সালের মধ্যে কর জিডিপি অনুপাত ১৫ শতাংশে উন্নীত করার স্বপ্ন এখনও অধরা থেকে গেল। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও ২০৪১ সালের মধ্যে এ অনুপাত ২৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যস্থির করা হয়েছে। এনবিআর পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করলে জনগণ ও ব্যবসায়ীদের সঠিকভাবে উদ্বুদ্ধকরণ ও নৈতিক দায়িত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।

সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের দায়িত্ব মূলত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপরই ন্যস্ত। এ সংস্থার অধীন কর, মূল্যসংযোজন কর (ভ্যাট) ও কাস্টমস কমিশনারেটগুলো বার্ষিক বাজেটে এদের ওপরে ন্যস্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে রাজস্ব আহরণে সচেষ্ট থাকে। বাজেট প্রণয়নের সময় এনবিআর প্রয়োজনে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে আইন পরিবর্তন বা সংশোধন এবং প্রশাসনিক আদেশ ও প্রজ্ঞাপন জারি করে সর্বোচ্চ রাজস্ব আহরণের চেষ্টা করে। এসব সংশোধন ও পরিবর্তনে কর হ্রাস-বৃদ্ধি ছাড়াও নীতি সহায়তা থাকে, যার ফলে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে, ফলে স্বাভাবিকভাবে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ে। মূলত রাজস্ব প্রবৃদ্ধিনির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা, আমদানি-রপ্তানি, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সরকারি রাজস্ব ও প্রকল্প বরাদ্দের সুষ্ঠু ব্যয় এবং সর্বোপরি রাজস্ব সংগ্রহে নিয়োজিত কর্মচারীদের পেশাদারত্বের ওপর।

কর, ভ্যাট ও কাস্টমস ডিউটি রাজস্বের এ তিনটি শ্রেণিকে সাধারণত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিগত সরকারগুলো বার্ষিক বাজেট ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনয়নে চেষ্টা করে। সরকার, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী এবং ভোক্তা জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে ক্রমান্বয়ে কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ফলে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও ভোগ চাহিদা বৃদ্ধি পায়, যা বছর শেষে জিডিপির আকার ও শতকরা প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। তাই দেখা যায়, ১৯৭২-৭৩ সালের ৮ বিলিয়ন ডলার জিডিপি বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালে ৪০৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।

সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে দেশের রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ সম্পদের অবদান বাড়তে থাকে এবং বৈদেশিক ঋণের নির্ভরতা কমতে থাকে। বিগত প্রায় ৩০ বছর ধরে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে ৭-২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি থাকলেও দেশের কর জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারেনি, বরং বিগত দু’বছর কর জিডিপির অনুপাত ৮ শতাংশের কাছাকাছি থাকে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে আমাদের করের পরিমাণ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নিম্নতম। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের হিসাব মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় নেপালের কর জিডিপির অনুপাত সবচেয়ে বেশি- প্রায় ১৯ শতাংশ।

ভারতের কর জিডিপির অনুপাত ১২ শতাংশ, ভুটানের ১৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ১১.৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ১১ শতাংশ। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর গড় অনুপাত প্রায় ১৮ শতাংশ। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর কর জিডিপির অনুপাত ৩৫-৪০ শতাংশ। বিগত বছরগুলোতে বাজেট প্রণয়নের সময় কর জিডিপির অনুপাত ১০-১১ শতাংশ অনুমান করলেও কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় না হওয়ায় আমাদের দেশের এ অনুপাত নিম্নমুখী হয়েছে।

আয়কর প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মানুষের অনীহা আগে যা ছিল, এখনও তেমন আছে। অনভ্যাস, অনিচ্ছা, শঙ্কা, আইন অমান্যের প্রবণতা, দেশপ্রেমের অভাব প্রভৃতি কারণে সামর্থ্য থাকলেও দেশের মানুষ কর প্রদান করতে চায় না। বছরে প্রচুর টাকা মানুষ বাজে খরচ কিংবা অপেক্ষাকৃত অল্প প্রয়োজনে খরচ করে। এর কিছু অংশ কর দিলেও নৈতিক দায়িত্ব পালন করা হয়। শুধু ব্যক্তিশ্রেণি নয়, ব্যবসায়ীদের মধ্যেও কর ফাঁকির প্রবণতা বিদ্যমান।

আমাদের দেশের ব্যক্তিশ্রেণির করদাতা জনসংখ্যার অনুপাতে মাত্র ১ শতাংশের মতো। গত বেশ কবছর ধরে আয়কর মেলা এবং নানা বিজ্ঞাপনমূলক প্রচারণা সত্বেও আয়কর রিটার্ন দাখিলকারীর সংখ্যা ২৪-২৫ লাখের উপরে তোলা যায়নি।

উৎসে কর, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদির কর বিবেচনায় প্রায় ১ কোটি লোক কোনো না কোনোভাবে কর দেয় বলে ধরা যায়। জমি ক্রয়, নানাক্ষেত্রে আয়কর রেয়াত, ব্যাংক এবং অন্যবিধ সেবাদাতার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের মানুষ ই-টিআইএন নম্বর নিয়ে থাকে। বর্তমানে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা প্রায় ৬৭ লাখ। বাস্তবে এর ৩৫ শতাংশ মাত্র রিটার্ন জমা দেয়। আবার রিটার্ন জমাদানকারীদের একটা বড় অংশ ০ (শূন্য) কর দেয়।

অনুরূপভাবে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও সকলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর দেয় না। ব্যবসার আকার ও ধরনভেদে যেখানে ফাঁকি দেয়া সম্ভব হয় না, সেক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে কর দেয়। করের আওতা সম্প্রসারণ এনবিআরের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে করহার কমানো হয়েছে ব্যক্তিশ্রেণি ও কর্পোরেট উভয় ক্ষেত্রে। দীর্ঘদিন ধরে করপোরেট করহার বেশি বলে আমাদের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছে।

সেজন্য গত চার বছরে করপোরেট করহার সাড়ে ৭ শতাংশ কমানো হয়েছে। বর্তমানে এ হার ৩০ শতাংশ, তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে সাড়ে ২২ শতাংশ। নতুন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এ হার ২৫ শতাংশ। তবে সিগারেট ও তামাকজাত দ্রব্য এবং মোবাইল কোম্পানির করপোরেট করহার সবচেয়ে বেশি- ৪৫ শতাংশ। সরকার এই দুই উৎস থেকে যেমন কর পায় বেশি তেমনি এসব কোম্পানির কর প্রদানে মোটামুটি স্বচ্ছতা রয়েছে। ব্যাংক খাতের করহারও তেমন কমানো হয়নি। তিনটি খাত উচ্চ করহার মেনে নিয়েছে।

ব্যবসা সহজীকরণ, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, ডিজিটালাইজেশন ও আইসিটি সেবা সম্প্রসারণ প্রভৃতি কারণে কর রেয়াত, নিম্ন করহার, কর অব্যাহতি প্রভৃতির প্রচলন রয়েছে। আবার কোনো কোনো বিশেষ দ্রব্য ও সেবায়ও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর হ্রাসকৃত হারে নেয়ার নজির রয়েছে। এসব কারণে এনবিআর এর রাজস্ব আহরণ কম হয়। তাই রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য এনবিআরকে নানা ফন্দি-ফিকির বের করতে হয়।

গত প্রায় দুই দশক যাবৎ উৎসে অগ্রিম কর, কর্তন কর আহরণের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। আয়করের প্রায় ৮০ শতাংশের অধিক উৎসে কর থেকে আদায় হয়। এছাড়া ব্যক্তি কিংবা ব্যবসায়ী উভয় শ্রেণিতেই করজাল তেমন সম্প্রসারণ হয় না বিধায় চালু করদাতাদের কাছ থেকেই প্রয়োজনীয় কর বা বাড়তি কর আদায়ের চেষ্টা করা হয়। এতে হয়রানির অভিযোগও পাওয়া যায়।

কর প্রদানে মিথ্যা ঘোষণা অনেক দিন ধরে আমাদের দেশে চলে আসছে। ‍প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় করের ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে অনেক ব্যবসায়ী তাদের বিক্রয় ও লাভের পরিমাণ কম দেখায়। আবার আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণায় এবং ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দেয়া এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। শুধু তাই নয়, বিদেশে অর্থপাচারের একটা বড় অংশ যায় আমদানি-রপ্তানি দ্রব্যমূল্যের ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। ব্যবসাভিত্তিক অর্থপাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওভার ইনভয়েসিং বা আন্ডার ইনভয়েসিং কেইস ধরা পড়লে উচ্চহারে করারোপ ও জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

কাস্টমস আইন ও কর আইন সংশোধন ও যুগোপযোগী করার জন্য ৬-৭ বছর যাবৎ কাজ চলছে। ইতোমধ্যে কাস্টমস আইন জাতীয় সংসদ থেকে ৩ বার ফেরত এসেছে। বর্তমানে কাস্টমস আইন, আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগের ভেটিংয়ের জন্য পরীক্ষাধীন রয়েছে। নতুন কর আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। উভয় আইন বলবৎ হলে ব্যবসা, কর সংগ্রহ ও রাজস্ব প্রশাসনে সুশাসন ফিরে আসতে পারে।

রাজস্ব প্রশাসন অটোমেশনের আওতায় আনার প্রচেষ্টা গত শতাব্দীর নব্বই দশকেই শুরু হয়। কাস্টমস অফিসে এসাইকুডা সিস্টেম চালু করে স্বয়ংক্রিয় শুল্কায়ন শুরু হয় ১৯৯৩-৯৪ সালে। বর্তমানে এ সিস্টেম আপগ্রেড করে এসাইকুডা++ সিস্টেম চালু হয়েছে। এ ব্যবস্থায় সকল কিছু যেমন- শিপিং ডকুমেন্ট, ইনভয়েস, দ্রব্যের পরিমাণ ইত্যাদি অনলাইনে আসার কথা থাকলেও কাস্টমস অফিস এখনও আমদানিকারকদের যাবতীয় মূল কাগজপত্র দাখিল করতে বলে।

নানা জটিলতা ও জালিয়াতির সম্ভাবনায় অনলাইন ব্যবস্থা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করে ডিজিটাল কর ব্যবস্থা প্রণয়নের চেষ্টাও দীর্ঘদিনের। তবে অনলাইনে টিআইএন সংগ্রহ বা কর নিবন্ধন চালু হয় ২০১৩ সালে, অনলাইন পেমেন্ট চালু হয়েছে ২০১২, অনলাইন রিটার্ন দাখিল কার্যক্রম ২০১৬ সালে। তবে ই-টিআইএন সংগ্রহ ছাড়া অন্য দুটি ব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়নি; ফলে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নও হয়নি।

১৯৯১ সালে প্রণীত মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন ২০১২ সালে সংশোধিত হওয়ার কথা থাকলেও এটি সংশোধিত আকারে জারি হয় ২০১৯ সালে। এনবিআরের প্রত্যাশা ছিল, এ আইন জারির ফলে ভ্যাট আহরণে স্বচ্ছতা ও গতি আসবে এবং করের সংগ্রহ বাড়বে। কিন্তু এ আইনের বিভিন্ন ধারায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতপার্থ্যক্যের কারণে ব্যবসা সহজীকরণ, উদ্যোক্তাদের উৎসাহ প্রদান এবং একই সঙ্গে রাজস্ব বৃদ্ধির কথা বিবেচনায় রেখে গত ২টি বাজেটে এ আইনে আরও কিছু পরিবর্তন আনা হয়।

দ্রব্য ক্রয়ের সঙ্গে সাধারণ মানুষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভ্যাট প্রদান করলেও অনেক ব্যবসায়ী আদায়কৃত ভ্যাট সরকারকে প্রদান করে না। অসৎ ব্যবসায়ীদের ভ্যাট ফাঁকির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভ্যাট অফিসের অসৎ কর্মচারীরাও যুক্ত থাকে। সেজন্য ভ্যাট আদায় স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় আনার স্বার্থে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইলেক্ট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু গত ২ বছরে মাত্র ৩৫০০ ইএফডি মেশিন স্থাপন সম্ভব হয়েছে। দেশের অন্তত ৭ থেকে ১০ লাখ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এ মেশিন সচল থাকলে বর্তমানে আদায় করা ভ্যাটের তিন-চার গুণ ভ্যাট আদায় করা সম্ভব হতো বলে অনেকের ধারণা।

বিগত কবছর দেশের মোট রাজস্বের প্রায় ৩২-৩৩ শতাংশ আসে প্রত্যক্ষ কর থেকে, ৩৮-৩৯ শতাংশ আসে ভ্যাট থেকে আর বাকি রাজস্ব আদায় হয় কাস্টমস শুল্ক হিসেবে। ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীশ্রেণির করজাল সম্প্রসারণ করে ২০২০-২১ সালের মধ্যে কর রাজস্ব ৫১ শতাংশে উন্নীত করার একটি পরিকল্পনা এনবিআরের ছিল। কিন্তু এর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। ফলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি।

সমুদ্র ও স্থলবন্দর দিয়ে আগত আমদানি ও বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত রপ্তানির স্বচ্ছতা, ঘোষণা ফাঁকি ইত্যাদি রোধকল্পে বন্দর কাস্টমস অফিসে উন্নতমানের বৃহদাকার স্ক্যানিং মেশিন স্থাপনের একটি পরিকল্পনা প্রায় দুবছর আগে নেয়া হলেও এখনও ক্রয়কাজে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

করজাল ‍বৃদ্ধি, কর সংগ্রহের গতি আনা, সব জেলা ও উপজেলায় রাজস্ব অফিস স্থাপন এবং কর জরিপ পরিচালনার জন্য প্রশাসনিক সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি ব্যাপক বৃদ্ধি পেলেও ২০১১ সালের পর রাজস্ব প্রশাসনে আর কোনো সংস্কার হয়নি। জনবল ও অফিস সংখ্যা বৃদ্ধি তথা প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য কয়েক বছর আগে প্রস্তাব প্রণীত হলেও এ প্রস্তাব সরকারের অনুমোদনের জন্য এখনও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে পাঠানো সম্ভব হয়নি। ফলে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার বিলম্বিত হচ্ছে।

করের আওতা সম্প্রসারণ করে, করহার সুষম করে, প্রয়োজনীয় অটোমেশন সম্পন্ন করে মোট দেশজ উৎপাদনে করের অনুপাত বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা ও লক্ষ্য থাকলেও উদ্দেশ্য অর্জনে বিলম্ব হচ্ছে। এসডিজি বাস্তবায়নের স্বার্থে ২০২১ সালের মধ্যে কর জিডিপি অনুপাত ১৫ শতাংশে উন্নীত করার স্বপ্ন এখনও অধরা থেকে গেল। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও ২০৪১ সালের মধ্যে এ অনুপাত ২৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যস্থির করা হয়েছে। এনবিআর পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করলে জনগণ ও ব্যবসায়ীদের সঠিকভাবে উদ্বুদ্ধকরণ ও নৈতিক দায়িত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।

উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে নিচের সুপারিশগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক:

১. কর প্রদানে জনগণের ‘ভয় ও দ্বিধা’দূর করে সক্ষম করদাতা ও ব্যবসায়ীদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে কর প্রদানে আগ্রহী করে তুলতে হবে। সেজন্য কর কর্মকর্তাদের সৎ ও নিষ্ঠাবান হতে হবে। কর অফিসে ‘হয়রানি’দূর করতে হবে।

২. রিটার্ন দাখিল ফর্ম ও জমাদান প্রক্রিয়াটি যথাসম্ভব সহজ করতে হবে। কর প্রশাসনে ডিজিটালাইজেশন সহজ, গ্রহণযোগ্য ও বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৩. কর আইন এমনভাবে যুগোপযোগী করতে হবে, যাতে ব্যবসা সহজ ও কর আদায় বৃদ্ধি পায়। প্রতিটি ক্ষেত্রে আইন ও বিধির স্পষ্টতা থাকলে আইন অমান্য করা কিংবা হয়রানির সুযোগ থাকবে না।

৪. রাজস্ব প্রশাসনে দক্ষতা আনয়নের জন্য দেশ-বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের নীতি নৈতিকতার প্রশিক্ষণও প্রয়োজন। এনবিআরের অধীন কর এবং ভ্যাট ও কাস্টমস ক্যাডারের সম্প্রসারণ এবং কর ও শুল্ক অফিস সম্প্রসারণ করে উপজেলাপর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত করা প্রয়োজন। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে প্রশাসনিক সংস্কারের ফলে রাজস্ব উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।

৫. বন্দরের শুল্ক অফিসের আধুনিকায়ন, ডিজিটালাইজেশন এবং পর্যাপ্ত স্ক্যানার স্থাপন করে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সবরকম ফাঁকি ও অনিয়ম বন্ধ করে স্বচ্ছতা আনতে হবে। অনুরূপভাবে মূল্য সংযোজন আদায়ে শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকান-পাট, সুপার মার্কেট, শপিংমল প্রভৃতি বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে ইএফডি মেশিন স্থাপন করতে হবে।

৬. সর্বোপরি কম্পিউটারাইজেশন, ডিজিটালাইজেশন, আধুনিকায়ন, অটোমেশন যা-ই বলি না কেন এতে এনবিআর কর্মকর্তাদের শতভাগ সম্পৃক্ততা ও অংশীদারত্ব থাকতে হবে। এ ধরনের যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের পর যাতে কর্মকর্তারা প্রক্রিয়াটি দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে পারে সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিতে ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বিভাগীয় কর্মকর্তারা কাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত না হলে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অটোমেশনে স্থায়িত্ব আনা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সিনিয়র কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকদের বিশেষ মনোযোগী ও দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায় থেকে উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। জিডিপির আকার বেড়েছে, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, দেশে অন্তত চার কোটি লোক কর প্রদানে সক্ষমতা অর্জন করেছে। তাদেরকে করের আওতায় আনার উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। কর-জিডিপি অনুপাতে বিশ্বে সর্বনিম্ন স্থান থেকে বেরিয়ে এসে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে সরকারকে আরও পারদর্শিতা দেখাতে হবে।

লেখক: বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, জার্মানি। সাবেক সিনিয়র সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান, এনবিআর।

এ বিভাগের আরো খবর