বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিশ্ব শিশু দিবসের ভাবনা: আলোকিত হোক ভবিষ্যতের পৃথিবী

  • আহমেদ রিয়াজ   
  • ২০ নভেম্বর, ২০২১ ১৮:০২

পৃথিবীর প্রত্যেক শিশু যেন ন্যূনতম জীবন যাপন করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সবারই। এজন্য শিশুদের সুযোগ দিতে হবে নানা ক্ষেত্রে। এমনকি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজেও। তাতে শিশু যেমন নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে বুঝতে পারবে, তেমনি সমাজের প্রতি তার দায়িত্ববোধের জায়গাও তৈরি হবে। এতে করে শিশুরা নিজেদের অবস্থানকে শক্ত জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে, নিজের জন্য, অন্য শিশুর জন্যও।

মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে অসহায় হচ্ছে শিশুরা। বড় হয়ে ওঠার জন্য বড়দের উপর শিশুদের নির্ভর করতেই হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, দুনিয়ায় যেকোনো দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। সে দুর্যোগ প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম- যে রকমই হোক না কেন। তার ওপর রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের প্রতি বড়দের দায়িত্বশীলতার ঘাটতি, সঠিক মনোযোগ এবং সঠিক পরিচর্যার অভাব।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিশুদের প্রতি অবহেলাটা একটু বেশিই। আর যুদ্ধবিধ্বস্ত কিংবা যুদ্ধকালে শিশুদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ যে ভুল পথে পরিচালিত হয়, সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

শিশুদের প্রতি দায়িত্ববোধ তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনেকেই করেছেন। কিন্তু দেশ ও জাতির জন্য শিশুর প্রয়োজনীয়তার অনুভবটা নগদানগদি হয় না বলে, সেটা নিয়ে খুব একটা ভাবনা চিন্তাও করা হতো না একসময়। তবে সময় বদলেছে।

বড়রা বুঝতে পেরেছে এবং জেনেছে যে, আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। চারাগাছ থেকে যেমন সহসাই ফল-ফল মেলে না, সুমিষ্ট ফলের জন্য এবং সুবাসিত ফুলের জন্য চারাগাছকে যেমন অতি যত্নে লালন-পালন করে বড় করে তুলতে হয়, তেমনি শিশুদেরও যত্ন প্রয়োজন। শিশুর প্রতি এই যত্নের গুরুত্ব থেকেই শিশু দিবসের জন্ম।

শিশু দিবসের জন্মের গুরুত্বটা কাগজে-কলমে প্রথমে বুঝেছিলেন ড. চার্লস লিওনার্দো ১৮৫৭ সালে। তখন তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের চেলসিয়ার ইউনিভার্সাল চার্চের যাজক। জুনের দ্বিতীয় রোববার শিশুদের যত্নের জন্য দিনটি বিশেষভাবে নির্ধারণ করেছিলেন তিনি।

লিওনার্দো দিনটির নাম দিয়েছিলেন রোজ ডে বা গোলাপের দিন বলে। পরে দিনটি ফ্লাওয়ার সান ডে বা ফুলেল রোববার নামে পরিচিত হয়। তারও পরে দিনটিকে চিলড্রেনস ডে যে বা শিশুদিবস হিসেবে অভিহিত করা হয়।

আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম শিশুদিবস পালনের কৃতিত্ব তুরস্কের। ১৯২০ সাল থেকে রীতিমতো ছুটি দিয়ে তুরস্কে ২৩ এপ্রিলকে শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হতো। যদিও সেটা কোনো রাষ্ট্রীয় ঘোষণার মধ্যে ছিল না। তুরস্কের জাতির জনক কামাল আতাতুর্ক রাষ্ট্রীয়ভাবে শিশুদিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন ১৯২৯ সালে।

আন্তর্জাতিকভাবে শিশুদিবসের ঘোষণা সামনে আসে ১৯২৫ সালে জেনেভায় বিশ্ব সম্মেলনে।

১৯৪৯ সালের ৪ নভেম্বর রাশিয়ার মস্কোতে অনুষ্ঠিত ওমেন্স ইন্টারন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১ জুনকে বিশ্ব শিশু দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৫০ সাল থেকে অনেকগুলো কমিউনিস্ট ও সাম্যবাদী দেশে ১ জুন থেকে শিশুদিবস পালন শুরু হয়ে যায়।

১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভারত ও উরুগুয়ের উদ্যোগে একটি প্রস্তাব পাস হয়, যাতে বিশ্বের সব দেশকে শিশুদিবস পালনে উৎসাহিত করা হয়। তবে এই শিশুদিবস পালনের মধ্যে ছিল প্রথমত শিশুদের মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদান ও বোঝাপড়ার প্রচার করা ও দ্বিতীয়ত জাতিসংঘ সনদের আদর্শ এবং বিশ্বের শিশুদের কল্যাণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

১৯৫৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের শিশু অধিকার ঘোষণা গৃহীত হয়। ২০ নভেম্বর থেকে বিশ্ব শিশু দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভিন্ন তারিখে শিশু দিবস পালন করে। বাংলাদেশে শিশু দিবস পালিত হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চে। তবে শিশু অধিকার ঘোষণার দিবস হিসেবে ২০ নভেম্বরের গুরুত্ব অবশ্যই অপরিসীম। কারণ এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই বিশ্বজুড়ে শিশু অধিকার সৃষ্টির সচেতনতা শুরু হয়। সে হিসেবে আজ ২০ নভেম্বর বিশ্ব শিশু দিবস।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি শিশু। তার মধ্যে আবার ১৫ শতাংশের বেশি শিশু দরিদ্র। আর অতিমারি করোনোর কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় এর প্রভাব পড়েছে তিন কোটি ৭০ লাখেরও বেশি শিশুর উপর।

ওদিকে ওয়ার্ল্ড ভিশনের জরিপে জানা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বিশ্বের ৯১ শতাংশ শিশু ও তরুণ মানসিক চাপ ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। আমাদের শিশুরাও এ পরিস্থিতির বাইরে নয়। ইউনিসেফের এক গবেষণায় জানা যায়, ২০২০ সালের মহামারির পর থেকে বাংলাদেশে কিশোরীদের বিয়ের হার বেড়েছে ১৩ শতাংশ।

মহামারির ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার শিশুরা। মহামারিতে বেড়ে গেছে শিশু নির্যাতন, শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে, অপুষ্টি। এজন্য শিশু অধিকার ও সুরক্ষায় প্রত্যেকের অবস্থান থেকে নজর দেয়া জরুরি। এর পাশাপশি সাংবিধানিক অঙ্গীকার অনুযায়ী সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করে শিশুর সৃজনশীলতা বিকাশ এবং আনন্দময় পরিবেশে শিশুকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমুখী শিক্ষায় গড়ে তোলাও জরুরি।

শিশুদের প্রতি সচেতনা তৈরির এই জরুরি কাজটা করবে কারা? এককথায় সমাজের সবাই। শিশুর বাবা-মায়ের পাশাপাশি শিক্ষক, নার্স ও ডাক্তার, সরকার, সমাজকর্মী, ধর্মীয় ও কমিউনিটির প্রবীণ, কর্পোরেট মোগল, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, তরুণ সমাজ এবং সর্বোপরি শিশুদের নিজেদের। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই শিশুর জন্য দেশ, জাতি-সমাজ হবে সুন্দর ও সাবলীল।

শিশু দিবসের জাতিসংঘের চাওয়া শিশুকে শিশুর সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ করে দেয়া। এতে করে শিশুরা নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান করবে জাতিতে, গোষ্ঠীতে। নিজেরা নিজেদের উৎসাহ দেবে, নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করবে।

আর এসবের মাধ্যমে এই শিশুরাই একদিন হয়ে উঠবে সমাজ-সচেতন, রাষ্ট্র-সচেতন, সর্বোপরি অধিকার সচেতন। বিশ্বে পনেরো কোটিরও বেশি পাঁচ থেকে ১৪ বছর বয়সি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত। যা জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থি, শিশু অধিকারের পরিপন্থি। করোনা ভাইরাসের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত শিশুদের জীবন আরও বেশি সংকটময়। সে কারণে এবার শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘প্রত্যেক শিশুর জন্য চাই উন্নত ভবিষ্যৎ’।

পৃথিবীর প্রত্যেক শিশু যেন ন্যূনতম জীবন যাপন করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সবারই। এজন্য শিশুদের সুযোগ দিতে হবে নানা ক্ষেত্রে। এমনকি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজেও। তাতে শিশু যেমন নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে বুঝতে পারবে, তেমনি সমাজের প্রতি তার দায়িত্ববোধের জায়গাও তৈরি হবে। এতে করে শিশুরা নিজেদের অবস্থানকে শক্ত জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে, নিজের জন্য, অন্য শিশুর জন্যও।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, শিশু অধিকার তৈরির জন্য অভিনব কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। এর মধ্যে যেমন রয়েছে, একদিনের জন্য কোনো শিশুকে কোনো শহরের মেয়র কিংবা, পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ কর্তা বানিয়ে দেয়া। কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় বসানো।

বাংলাদেশেও এমন অভিনব উদ্যোগ শুরু হয়েছে। যেমন কন্যা শিশু দিবসে রংপুর সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব পেয়েছিল এসএসসি পরীক্ষার্থী বৈশাখী। আর বিশ্ব শিশু দিবস হিসেবে দেশের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে একদিনের সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছে ঢাকার হলিক্রস স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রূপকথা রহমান।

এটুকুতেই বসে থাকলে চলবে না। শিশুকে এরকম আরও ব্যতিক্রমী সুযোগ করে দিতে হবে। এরকম ব্যতিক্রমী উদ্যোগ শিশুকে তার ভবিষ্যতের কর্মপন্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা দেবে, তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করবে, তেমনি শিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্বের কথাও মনে করিয়ে দেবে। মনে করিয়ে দেবে শিশুরাও এই পৃথিবীর কেবল অংশীদারই নয়, ভবিষ্যতের পৃথিবীটাও তো এক সময় শিশুদের হাতেই থাকবে।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার।

এ বিভাগের আরো খবর