দারুণ এক ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে টি-২০ ফর্মেটের নতুন চ্যাম্পিয়ন হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। এটা পুরোনো খবর। তবে এবারের বিশ্বকাপে যাদের পারফরম্যান্স সবাইকে চমকে দিযেছে, সেই দলটি হলো পাকিস্তান। অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের দারুণ মিশেলে দারুণ এই দলটি সুপার ১২তে সবগুলো ম্যাচ জিতলেও সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের কাছে, আসলে দুর্ভাগ্যের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়েছে পাকিস্তানকে। তবে তাদের এই বিদায়ে কোনো গ্লানি ছিল না। দুই ওপেনার দারুণ বিস্ফোরক তো ছিলেনই, বোলাররাও দারুণ করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা তাদের একক কোনো ম্যাচ উইনার ছিলেন না। একেক ম্যাচে একেকজন দলকে জিতিয়েছেন।
বিশ্ব ক্রিকেটে প্রায় একঘরে হয়ে থাকা দলটির এভাবে বদলে যাওয়া বিস্মিত করেছে সবাইকে। অবশ্য পাকিস্তান সবসবময়ই ক্রিকেটের ‘মোস্ট আনপ্রেডিক্টেবল’ দল হিসেবে পরিচিত। যদিও টি-২০ আমাকে একদমই টানে না, তবুও আমি বিশ্ব ক্রিকেটের একজন অনুরাগী দর্শক। তবে যেকোনো পর্যায়ে পাকিস্তানের যেকোনো সাফল্য আমাকে বেদনার্ত করে। তাই টুর্নামেন্টজুড়ে পাকিস্তানের দারুণ পারফরম্যান্স আমাকে পুড়িয়েছে অনেক, আর সেমিফাইনালে তাদের বিদায় আমাকে অপার আনন্দ দিয়েছে।
টি-২০ থেকে বিদায় নেয়া পাকিস্তান দল এখন বাংলাদেশে। তারা তিনটি টি-২০ এবং দুটি টেস্ট খেলবে। খেলায় হার-জিৎ থাকবেই। আমি সব ম্যাচেই বাংলাদেশের জয় চাই। কিন্তু সব ম্যাচে জেতা কোনো দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। টি-২০ বিশ্বকাপের আগে দেশের মাটিতে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জিতেছিল।
বাংলাদেশের কাছে হেরে যাওয়া দুই দলই টি-২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলেছে। আর বাংলাদেশ কোনোরকমে টি-২০ বিশ্বকাপের সুপার ১২এ যেতে পারলেও সেখানে সবগুলো ম্যাচই হেরে বিদায় নিযেছে। এখন আবার দেশের মাটিতে বাংলাদেশ, প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। আমি চাইব, এবারও সবগুলো ম্যাচই জিতুক বাংলাদেশ, অন্তত ভালো খেলুক। টি-২০ বিশ্বকাপ ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়াক।
মাঠের পারফরম্যান্স কী হবে, সেটা মাঠেই দেখা যাবে। কিন্তু পাকিস্তান দল বাংলাদেশে নেমেই বিতর্কের ঝড় তুলে দিয়েছে। অনুশীলনের সময় তারা নজিরবিহীনভাবে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মাঠে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ যখন হবে, তখন নিয়ম অনুযায়ীই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার পাশে পাকিস্তানের পতাকাও উড়বে, পর্যায়ক্রমে বাজবে দুই দেশের জাতীয় সংগীতও। বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানের পতাকা উড়তে দেখলে বা পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত বাজতে শুনলে আমার খারাপ লাগবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিয়ম আমাকে মানতেই হবে। আন্তর্জাতিক ম্যাচে পাকিস্তানের পতাকা উড়বেই। কিন্তু অনুশীলনের সময় পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানোটা বেআইনি, ঔদ্ধত্য, কূটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন।
আপনি অন্য দেশে এসে নিজের জাতীয় পতাকা ওড়াতে পারবেন না। আর বাংলাদেশেও জাতীয় পতাকা ওড়ানোরই কিছু নিয়ম কানুন আছে। চাইলেই কেউ তার বাড়ি বা গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়াতে পারবেন না। সেখানে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানোটা স্পষ্টতই আইনের বরখেলাপ।
যারা কুতর্ক করতে অভ্যস্ত, তারা বলছেন, ফুটবল বিশ্বকাপের সময় যে সবাই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা পতাকা ওড়ায়? বাংলাদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়ানোটাই বেআইনি। তবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা আর পাকিস্তানের পতাকা এক নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের একটা রক্তাক্ত অতীত আছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের মুক্তি সংগ্রাম আর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ করেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। আর যে মিরপুরে পাকিস্তান বেআইনিভাবে তাদের পতাকা উড়িয়েছে, সেই মিরপুরের লড়াইয়ের ইতিহাস আরেকটু দীর্ঘ।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও মিরপুর মুক্ত হয়েছিল ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি। বিজয় অর্জনের পরও মিরপুরে প্রাণ দিতে হয়েছিল অনেককে।
অনেকে খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাতে আপত্তি করেন। আমি ভাই অত নির্মোহ হতে পারি না। দেশটির নাম যখন পাকিস্তান তখন আমি রাজনীতি থেকে খেলাকে আলাদা করতে পারি না। আমি ভুলতে পারি না পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা, ৩০ লাখ শহীদের কথা, ২ লাখ নির্যাতিত নারীর আর্তনাদ, কোটি শরণার্থীর হাহাকার। ৫০ বছর পরও কেন পাকিস্তান নিয়ে একটা ঘৃণা পুষে রাখছি, তা নিয়ে অনেকের খুব আপত্তি।
পাকিস্তান এখনও একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি, বিচার করার কথা বলে নিয়ে যাওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি, আমাদের পাওনা বুঝিয়ে দেয়নি, আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেয়নি। এই কাজগুলো করে পাকিস্তান খোলা মনে এলে ভালো না বাসলেও অন্তত বিদ্বেষটা কমবে আমার এবং আমার মতো আরও অনেকের।
ক্রিকেটে বাংলাদেশের উত্থানের আগে বাংলাদেশে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সমর্থক ছিল। কিন্তু গত কয়েকবছরে ভারতের নানামাত্রিক দাদাগিরি এবং ক্রিকেটের নানা সমীকরণে বাংলাদেশে ভারতের ক্রিকেট দলের সমর্থন শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের চেয়ে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে উত্তেজনা বেশি। বাংলাদেশে ভারতের সমর্থন শূন্যের কোটায় নামলেও, পাকিস্তানের সমর্থন তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। আগে চক্ষুলজ্জার কারণে পাকিস্তানের সমর্থকরা চুপচাপ থাকলেও ইদানীং তারা নির্লজ্জের মতো পাকিস্তানের পক্ষে সাফাই গায়।
পাকিস্তানের ক্রিকেট সমর্থন করার মতো অনেক কারণ আছে। ক্রিকেটটা তারা ভালোই খেলে। বিশেষ করে পাকিস্তান হলো ফাস্ট বোলারদের স্বর্গভূমি। যারা নিছক ক্রিকেটীয় কারণে পাকিস্তানকে সমর্থন করেন, তাদের ব্যাপারে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু যারা ক্রিকেটকে অজুহাত করে আসলে হৃদয়ে পাকিস্তানকে ধারণ করেন, তাদের ব্যাপারে আমার প্রবল আপত্তি। তাদেরকে আমি বলি মানসকিভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানি।
বাংলাদেশে শারীরিকভাবে আটকেপড়া অনেক পাকিস্তানি আছেন, যারা বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকেন। আর মানসিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিরা দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে; তারা আমাদের রাজনীতিকে দূষিত করছে, বাংলাদেশের অগ্রগতি ঠেকাতে চাইছে। এই মানসিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিরা মনে করে পাকিস্তানই ভালো ছিল। ভারত নিজেদের স্বার্থে পাকিস্তানকে দুর্বল করার জন্য পাকিস্তান ভেঙেছে। এরা বাংলাদেশের ভালো চায় না, পাকিস্তানের ভালো চায়।
টি-২০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিদায়ে উল্লাস প্রকাশ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। তারপর এই মানসিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিরা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে গালাগাল করেছে। আর আমাকে ‘ভারতের দালাল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাদের ধারণা পাকিস্তানকে ঘৃণা করতে হলেই ভারতের দালাল হতে হবে বা ভারতকে ভালোবাসতে হবে। ব্যাপারটা হলো চোর সবসময় সবাইকে নিজের মতো চোর মনে করে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।
বাংলাদেশ অর্থনীতিতে, খেলাধুলায় এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এখন সব ভাবনা বাংলাদেশকে ঘিরে, বাংলাদেশের স্বার্থেই আমরা অন্য দেশের বিবেচনা করব। ভারত হারলেও আমার আনন্দ হয়, পাকিস্তান হারলেও হয়। শুধু বাংলাদেশের বিজয়ই আমাকে উল্লসিত করে, গর্বিত করে। অনেকে কুতার্কিক আবার ভারত-পাকিস্তানকে এক পাল্লায় মেপে পাকিস্তানের মতো ভারতকেও ঘৃণা করার পরামর্শ দেন। ভারত এবং পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কটাও ভিন্নমাত্রার।
একাত্তর সালে পাকিস্তান যখন আমাদের ৩০ লাখ লোককে হত্যা করেছে, তখন ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা করেছে। তাই দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই দুই দেশকে এক পাল্লায় মাপার কোনো সুযোগ নেই। একাত্তরের ভূমিকার জন্য পাকিস্তানের প্রতি আমার চিরকালীন ঘৃণা, একাত্তরের ভূমিকার জন্য ভারতের প্রতি আমাদের চিরকালীন কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতা আছে, তাই বলে ভারতের কোনো অন্যায্য আচরণ আমরা মানি না, মানব না। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, ভারত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্ক নির্ধারিত হবে পারস্পরিক মর্যাদা ও স্বার্থের ভিত্তিতে। যেখানেই মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে, সেখা্নেই রুখে দাঁড়াতে হবে। বিএসএফ যখন সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যা করে, আমরা প্রতিবাদ করি। ভারত যখন তিস্তার ন্যায্য পানি দেয় না, আমরা প্রতিবাদ করি। ভারত যখন খেলার মাঠে আমাদের সঙ্গে অখেলোয়াড়োচিত আচরণ করে, আমরা প্রতিবাদ করি। ভারত যখন আমাদের সঙ্গে দাদাগিরি করে, আমরা প্রতিবাদ করি। ভারত নয়, পাকিস্তান নয়; আমাদের হৃদয়জুড়ে শুধুই বাংলাদেশ। আর আছে মানসিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের জন্য করুণা।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক