বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাংবিধানিক ইতিহাসে ষোড়শ সংশোধনী একটি বড় কেসস্টাডি। কেননা, এই সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরে দেশের সংসদ ও বিচার বিভাগে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসেই বিরল। এই ঘটনায় সৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতিকে তার পদ এমনকি দেশ ছাড়তে হয়। শুধু তাই নয়, ঘটনার পরে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা দুর্নীতির মামলায় সম্প্রতি তাকে ১১ বছরের কারাদণ্ডও দেয়া হয়েছে।
যদিও এসব ঘটনাপ্রবাহে অনেক দিন আলোচনার বাইরে ছিল সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী তথা বিচারকদের অভিশংসনের ইস্যুটি। তবে গত মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) জাতীয় সংসদে পাসের জন্য উত্থাপিত ‘বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতা (পারিতোষিক ও বিশেষাধিকার) বিল-২০২১’ বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, সেটির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ আবেদনের বিষয়ে শিগগিরই শুনানি হবে।
২০১৭ সালের ৩ জুলাই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন আপিল বিভাগ। ওই রায়ে হাইকোর্টের রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ ‘এক্সপাঞ্জ’ করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ‘সর্বসম্মতভাবে’ খারিজ করে দেয়া হয়। পরে একই বছরের ১ আগস্ট এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এর প্রায় পাঁচ মাস পরে ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের দেয়া রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
২০১৪ সালে অসামর্থ্য ও অযোগ্যতার কারণে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিয়ে জাতীয় সংসদে পাস হয় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল। এর আগে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে এ ক্ষমতা ছিল। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে ৯ জন আইনজীবী রিট করলে হাইকোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংশোধনীটি বাতিল ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে রায় দেন। যা পরবর্তী সময়ে বহাল রাখেন আপিল বিভাগও।
আপিল বিভাগের রায় নিয়ে যতটা না, তার চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া আসে রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কিছু পর্যবেক্ষণে। ফলে রায় প্রকাশের দিন থেকে শুরু করে ১৩ অক্টোবর তার দেশত্যাগের পরেও বিষয়টি রাজনীতির মাঠে আলোচনায় ছিল।
রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ আবেদনে আপিল বিভাগের দেয়া রায় বাতিল এবং আদালতের পর্যবেক্ষণে সংসদ সদস্যদের নিয়ে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে এবং বিচারকদের জন্য যে আচরণবিধি করা হয়েছে, তা বাতিল চাওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় ৯০৮ পৃষ্ঠার ওই রিভিউ আবেদন দাখিল করা হয়।
আবেদন জমা দেয়ার পর সেসময়ের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, “আবেদনে ৯৪টি গ্রাউন্ড পেশ করা হয়েছে। দুই মাস নিরলস শ্রম দিয়ে একটি আইনজীবী প্যানেল এই আবেদন প্রস্তুত করেছে।” তিনি তখন বলেন, “যেখানে জাতীয় সংসদ সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদে ফিরে যেতে চায়, সেখানে আদালত এর বিপরীতে কোনো আদেশ বা রায় দিতে পারেন না।”
অ্যাটর্নি জেনারেলের এই মন্তব্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে যে জাতীয় সংসদের সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট বা মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানে পরিবর্তন আনলেন, সেটি আদালত বাতিল করতে পারেন কি না? আবার সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের কোনো সংশোধনী বাতিল করলেও সংসদ সেটি মানতে বাধ্য কি না! কারণ আদালত কোনো সংশোধনী বাতিল করলেও সংসদ যদি সেটিকে গ্রহণ করে সংবিধানে যুক্ত না করে, তাহলে ওই রায় অর্থহীন কি না— সেটিও প্রশ্ন।
স্মরণ করা যেতে পারে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের তিনদিন পর ২০১৭ সালের ৪ আগস্ট সিলেটে এক অনুষ্ঠান শেষে সেসময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত পরিষ্কার ঘোষণা দেন, “আদালত যতবার এই সংশোধনী বাতিল করবেন, ততবারই সংসদ এটা পাস করবে। করতেই থাকবে।” মি. মুহিত বেশ উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলেন, “ দেখি তারা কতদূর যেতে পারেন।’’
সুতরং এটা স্পষ্ট যে, ষোড়শ সংশোধনীর মূলে রয়েছে বিচার বিভাগের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব বজায় রাখা। পক্ষান্তরে এ প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, ক্ষমতা আছে বলে আদালত কি কোনো সংশোধনী বাতিল করতে পারেন? আবার ক্ষমতা আছে বলে সংসদ কি আদালতের নির্দেশনা এড়িয়ে যেতে পারে? যদি এটা হয় তাহলে রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গসমূহের মধ্যে কেবল ক্ষমতার চর্চাই হবে।
বস্তুত, রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গসমূহ যাতে এরকম ক্ষমতার চর্চায় অবতীর্ণ না হয় এবং তাদের মধ্যে যাতে একটি ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকে; যাতে তারা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে— সেরকম পরিস্থিতিই গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শর্ত। সবচেয়ে বড় কথা- আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ যদি একটি আরেকটির উপরে খবরদারি করতে চায়; যদি কোনো একটি অঙ্গ দেশ ও জনগণের স্বার্থের বাইরে গিয়ে এমন কোনো কাজ করে বা সিদ্ধান্ত দেয় যেখানে তাদের ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ‘ইগো’ মুখ্য হয়ে ওঠে— সেটি দেশের জন্য ভালো নয়।
মনে রাখা দরকার, বিচার বিভাগকে চাপে রেখে জনগণের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা তথা রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বিচারকদের স্বাধীন রাখতে না পারলে, তাদের রায়গুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হবে না। আবার বিচার বিভাগের সঙ্গে যারা যুক্ত, তারাও যদি দেশ, জনগণ ও পেশার প্রতি দায়বদ্ধ থেকে, নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে না পারেন; নির্বাহী বিভাগ যদি মনে করে তাদের ছাড়া আইন ও বিচার বিভাগ অচল বা তাদের কলমের খোঁচায় সবকিছু বদলে যেতে পারে; সরকার বদল হলেও যেহেতু তাদের বদল নেই, অতএব তারাই ‘সুপিরিয়র’— তাহলে সেটিও রাষ্ট্রের ভেতরে শুধু বিশৃঙ্খলারই জন্ম দেবে।
এখন প্রশ্ন হলো, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়টির রিভিউ শুনানি আসলেই কবে হবে এবং রিভিউতে কি হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায় বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে?
রাষ্ট্রপক্ষের বড় কনসার্ন আসলে রায়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ। কিন্তু পর্যবেক্ষণ কোনো রায় নয়। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে আপিল বিভাগ যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তার অনেক কিছুর সঙ্গে দেশবাসীরও দ্বিমত বা ভিন্নমত আছে। সুতরাং রিভিউতে সর্বোচ্চ আদালত যদি প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণগুলো এক্সপাঞ্জ করেন, তাতেও রায় পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ বিচারপতির অপসারণের জন্য ষোড়শ সংশোধনীর আগে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান ছিল, আইনত এখন সেটিই বহাল রয়েছে এবং রিভিউতে রায় বদলে না গেলে এই বিধানই বহাল থাকবে।
একজন বিচারক রায়ে তার ব্যক্তিগত অভিমত ব্যক্ত করতে পারেন—যেটি রায়ের অংশ নয়। যেমন সম্প্রতি রাজধানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ে বিচারক সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন এবং সেইসঙ্গে একটি পর্যবেক্ষণ দিয়ে বলেছেন যে, ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরে ধর্ষণের মামলা নেয়া যাবে না।
এটি নিয়ে বেশ সমালোচনা শুরু হয় এবং ওই বিচারকের বিচারিক ক্ষমতার প্রত্যাহার করে তাকে আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু এতে তিনি যে রায় দিয়েছেন, সেটি বাতিল হয়ে যায়নি। একইভাবে ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনানিতে যদি সর্বোচ্চ আদালত পর্যবেক্ষণগুলো এক্সপাঞ্জ বা বাতিলও করেন, তাতেও রায় বদলে যাবে না।
অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, রিভিউতে পুরো রায় বাতিল হয় না বা যে রায় দেয়া হয়েছে, তার বিপরীত কোনো সিদ্ধান্ত আসে না। কেননা, আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন, সেটিই চূড়ান্ত। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়েছিল এবং পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ সেটি বহাল রেখেছেন। সুতরাং এখন রিভিউ শুনানি যদি হয়ও, তাতেও মূল রায় হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা কম।
ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ নিয়ে একজন সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে আমার কথা হয় ২০১৯ সালে। তিনি বলেছিলেন, সাধারণত রিভিউ চাওয়া হয় তখনই, যদি রায় ঘোষণার আগে কোনো এভিডেন্স অর্থাৎ তথ্যপ্রমাণ ভুলবশত বাদ পড়ে থাকে। এছাড়া রিভিউ চাওয়ার আর কোনো গ্রাউন্ড নেই। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বাতিল চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ যে রিভিউ আবেদন করেছে, সেখানে এভিডেনশিয়াল গ্রাউন্ড নেই বলে তিনি মনে করেন।
সুতরাং সরকার বা রাষ্ট্রপক্ষ ষোড়শ সংশোধনীর রায় এবং রায়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণগুলো বাতিল বা এক্সপাঞ্জ চেয়ে যে আবেদন করেছে, রিভিউতে যদি সেই রায় ও পর্যবেক্ষণ বাতিল হয়ে যায়, তাহলে দেশের সাংবিধানিক ও বিচারিক ইতিহাসে আরেকটি বড় কেস স্টাডি হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।