বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলা, বিকশিত করা ও এর ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার সাত কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে যে মানুষটি উদ্যমী ও সাহসী ভূমিকা পালন করেন তার নাম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। বাংলাদেশকে পাকিস্তানসৃষ্ট ধর্মীয় ধারা থেকে অসাম্প্রদায়িক ধারায় আনতেও তিনি মূল ভূমিকা পালনকারীদের একজন। ইতিহাস বলে, বড় কোনো ব্যাপারে একজন ব্যক্তির ভূমিকাও অনেক সময় নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হতে পারে। তেমনই আবার কারো একক ভূমিকায় আদৌ কোনো ঐতিহাসিক কাজ সম্পন্ন হয় না।
এখানেই মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব। যে পরিণতিতে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন- সে পথ প্রশস্ত করার লড়াই-সংগ্রামের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটাতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ভাসানী।
বঙ্গবন্ধু ও মওলানা ভাসানী একপর্যায়ে রাজনৈতিক মতবিরোধ সৃষ্টি হলেও তাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কখনও কমেনি।
মওলানা ভাসানী ব্যাপকভাবে অভিহিত হতেন ‘হুজুর’ হিসেবে। জন্মেছিলেন বৃহত্তর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ধানগড়া গ্রামে। গ্রামের স্কুলে প্রাইমারি পর্যায়ের লেখাপড়া শেষ করে চলে যান টাঙ্গাইলের কাগমারী। সেখানে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে হালুয়াঘাটে মাদ্রাসায় পুনরায় লেখাপড়া ও শিক্ষকতা চালিয়ে যান।
পরবর্তীকালে যোগ দেন খেলাফত আন্দোলনে। এখান থেকেই মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন শুরু। ১৯৪৯ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। দক্ষিণ টাঙ্গাইলে অনুষ্ঠিত এক উপনির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয় অর্জন করেন।
এরপর আসামে ‘বাঙাল খেদাও’ আন্দোলন শুরু হলে মওলানা ভাসানী বাঙালি রক্ষা আন্দোলনে আসাম প্রবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৩৭-এ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগে যোগদান করার পর একপর্যায়ে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। মূলত কংগ্রেসে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক জমিদার-জোতদাররা মুসলিম প্রজাদের ওপর নির্যাতন চালালে সে প্রতিবাদেই তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান চলে গেলেও, ১৯৪৯ সালে আবার ফিরে যান আসামের ধুবড়িতে। আন্দোলন করতে গিয়ে সেখানে কারারুদ্ধ হন। পরে মুক্তিলাভ করে পুনরায় পাকিস্তান ফিরে যান। আসাম সরকার তাকে স্থায়ীভাবে আসামে আর প্রবেশ না করার নির্দেশ জারি করে।
এরপর শুরু হয় তার পাকিস্তান, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে তিনি এই নতুন দলটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৭ পর্যন্ত দলটির সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। এর আগেই ১৯৫৫ সালে তিনি ও শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ নিয়ে দলটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দিয়ে পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক একটি দলে পরিণত করেন।
এর আগে ১৯৫২ সালে ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য অনুষ্ঠিত এক সর্বদলীয় বৈঠক গঠিত হয়। নাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনা কমিটি। এর সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটিতে অনেক ভিন্নমত প্রকাশিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টি প্রস্তাব রাখে ১৪৪ ধারা জারি হলে তা ভেঙে মিছিল করা হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তারা ছিলেন ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে। তবে তারা এ কথাও স্পষ্ট করে জানালেন যে, ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হবে- তাতে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষ ও বিপক্ষের মতামত ব্যাখ্যাসহ তুলে ধরতে হবে।
উভয়পক্ষের বক্তব্যের সপক্ষে সবাই মিলে যদি একমত হয়ে সমর্থন দেয়, তবে তো কথাই নেই। যদি তা না হয়, তবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী যে মত দেবে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বিশাল ছাত্রসভায় উভয় মতই যথার্থভাবে তুলে ধরলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করে।
ইতঃপূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠিত হলে, আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা ও আহ্বায়ক আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষের যুক্তিগুলো তুলে ধরে। পরে ছাত্রসমাজ হাত তুলে তাদের অধিকাংশের মত ১৪৪ ধারা অমান্য করবে জানালে, সিদ্ধান্ত হয় ১০ জন করে সারিবদ্ধভাবে মিছিল নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে বের হবে। তবে পুলিশ উসকানি দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পুলিশেকেই নিতে হবে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪৪ ধারার খড়গ মাথায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী মিছিল বের করলে, কজন পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। প্রতিবাদে মুখরিত হয়ে ওঠে ঢাকা, মওলানা ভাসানীসহ সব নেতানেত্রী।
পরবর্তীকালে পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাক-মার্কিন চুক্তি স্বাক্ষর করে। তখন পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনেও মওলানা ভাসানী ও ছাত্রসমাজ সক্রিয় হয়। ওই চুক্তি বাতিলের দাবিতে সংগঠিত গণস্বাক্ষর অভিযানে অন্যতম স্বাক্ষরকারী শেখ মুজিবুর রহমান। সেসময়ের ডাকসু ভিপি ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এসএ বারী এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন। দেশের ছাত্রসমাজও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নানা স্লোগানে দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে।
আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরোধিতা স্থান পেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের পশ্চিমাঘেঁষা অপর নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে মুসলিম লীগের সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহী বৈদেশিক নীতির প্রতি সমর্থন জানালে, দলীয় সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও দলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী তার তীব্র বিরোধিতা করেন।
এ পর্যায়ে মওলানা ভাসানী কাগমারীতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করলে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার আওয়ামী লীগ-দলীয় সদস্য ও আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিসভার সব সদস্য এবং দেশের অসংখ্য নেতাকর্মী তাতে অংশগ্রহণ করে। সেখানে পাকিস্তানের সোহরাওয়ার্দী অনুসৃত বৈদেশিক নীতি ও পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে তুমুল বিতর্কের পর দলীয় সাবেক কাউন্সিলের প্রস্তাব ও মেনিফেস্টোতে বর্ণিত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতি অব্যাহত রাখার প্রশ্নে সংখ্যাধিক্য দেখা দিলে- তা অনুমোদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী সম্মেলন ত্যাগ করে ঢাকায় চলে যান।
পরে পাল্টা বিশেষ কাউন্সিল আহ্বান করে বৈদেশিক নীতি ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী অনসৃত নীতি অনুমোদিত বলে ঘোষণা দিলে, মওলানা ভাসানী তাৎক্ষণিকভাবে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯৫৭ সালে দ্রুত নতুন একটি প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন।
পাকিস্তানের সব প্রদেশে এর শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করে। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় ছয় দফার অসাধারণ শক্তিতে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গোটা পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ন্যাপ মাত্র একটি আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানে? যেখানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ার অত তীব্র ছিল না- ছিল বৈষম্য-সাম্প্রদায়িকতার অবসান ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা এবং সমাজতন্ত্রের দাবিগুলোই প্রধান।
সেখানে দুটি প্রদেশে ন্যাপ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এবং প্রায় সবগুলো আসন তাদের দখলে আসে। ফলে বেলুচিস্তানে গাউস বখস বেজেঞ্জোর নেতৃত্বে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ন্যাপ সভাপতি ওয়ালি খানের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাপ নেতারা তাতে সমর্থন ঘোষণা করে; পাশাপাশি ইয়াহিয়া সরকারের নির্যাতন সহ্য করতে বাধ্য হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিতে যা ছিল অত্যন্ত দুঃসাহসী।
এর অনেক আগেই যে মওলানা ভাসানী চীনপন্থি রাজনীতি গ্রহণ করে আইয়ুবকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনিই ১৯৭১-এ তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা মনোনীত হন। অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, কমরেড মণি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ ছিলেন সেই উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য।
শেষ জীবনে তার নামে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘হক-কথা’য় পাকিস্তান মার্কা প্রতিবেদন ও নিবন্ধাদি প্রকাশ করা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের একটি অংশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন ভূমিকা গ্রহণ করলে তিনি স্বয়ং দেশের গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল শক্তির কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হন। তার সুদীর্ঘ জীবৎকালের সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ভূমিকা জীবন সায়াহ্নের কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ভূমিকার কারণে কোনো প্রগতিশীলশক্তি ভুলে যেতে পারে না।
এদেশের রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদ চিনিয়েছেন মওলানা ভাসানী। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপসহীন ভূমিকাও পালন করেন মওলানা ভাসানী। সমাজতন্ত্রকে এদেশের তরুণসমাজের মধ্যে জনপ্রিয় করার জন্যেও তাকে মনে রাখতে হবে। এছাড়াও গোপন কমিউনিস্ট পার্টির একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপে টেনে নিয়ে জনপ্রিয় হতে সহযোগিতা করেন মওলানা ভাসানী। ৯৬ বছর বয়সে ১৯৭৬-এর ১৭ নভেম্বর তার প্রয়াণ ঘটে।
লেখক: রাজনীতিক, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।