ষাটের দশকের কথা। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শাসনের নামে শোষণের স্টিমরোলার চালাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উত্থানের সুযোগটা নিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। পূর্ব পাকিস্তান যেন পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে নিতান্ত এক উপনিবেশ। অথচ এর মাত্র দেড় দশক আগেই ইংরেজ উপনিবেশ থেকে বেরিয়ে এসেছে এই উপমহাদেশ। জাতিতে জাতিতে বিশেষ করে হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে তিক্ততার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়ে টানা অনেকদিন শাসন করেছিল ইংরেজরা।
তারপর ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলো। জন্মস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রাম ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে এসে আশ্রয় নিল একটি পরিবার। কিন্তু আবার সেই পুরোনো পন্থায় ইংরেজদের পথেই বিভক্তি তৈরির চেষ্টা করছে পশ্চিম পাকিস্তান। দমন-পীড়ন চালাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের। মেনে নিতে পারলেন না কলেজ পড়ুয়া এক প্রতিবাদী তরুণ। শুধু তাই নয়, এই প্রতিবাদের কারণে কলেজে তার মেধা-বৃত্তির ফাইল চাপা দিয়ে রাখেন কলেজ অধ্যক্ষ-নিজের চাকরিটা বাঁচানোর তাগিদে। কে এই তরুণ?
হাসান আজিজুল হক। জন্ম ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। জন্মস্থান ছেড়ে বাঙাল দেশে এসে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে একটুও চিন্তা করেননি। তখন অন্যায়ের প্রতিবাদের একটা সোজাসাপ্টা নামকরণ করা হতো- রাজনীতি। রাজনীতি বা অন্যায়ের প্রতিবাদের কারণে মেধা-বৃত্তি বঞ্চিতই শুধু হননি, পাকিস্তান সরকারের চরম নির্যাতন ভোগ করেছেন- জেল খেটেছেন। কলেজও ছাড়তে হয়েছে।
ম্যাট্রিকুলেশন পাস অবশ্য করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের যবগ্রাম কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে। তারপর ১৯৫৬ সালে খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। কলেজ ত্যাগে বাধ্য করার কারণে এরপর ভর্তি হন রাজশাহী সরকারি কলেজে। ১৯৫৮ সালে এ কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন।
শিক্ষকতা শুরু করেন ১৯৬০ সাল থেকে। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা গার্লস কলেজ ও দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য খান সারওয়ার মুরশিদ তাকে রাজশাহীতে নিয়ে আসেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন হাসান আজিজুল হক। ২০০৪ সাল পর্যন্ত টানা ৩১ বছর অধ্যাপনা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্থায়ী আস্তানা গাড়েন পদ্মাপাড়ের রাজশাহীতেই।
কাগজে কলমে তার লেখক জীবন শুরু হয়েছিল মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৫৭ সালে। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষের ছাত্র। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য লিখেছিলেন সামাজিক প্রতিচিত্রের এক বাস্তবধর্মী উপন্যাস-শামুক। ওই প্রতিযোগিতায় প্রধান সাতটি উপন্যাসের একটি ছিল শামুক। তবে উপন্যাসটি তিন কিস্তিতে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায়।
আর বই হিসেবে প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। ১৯৬০ সালে ‘বৃত্তায়ন’ নামে আরেকটি উপন্যাসও লিখেছেন তিনি। তবে ওই দুটো উপন্যাসকে নিজেই উপন্যাস হিসেবে স্বীকার করেননি হাসান আজিজুল হক। তিনি নিজেই ছিলেন তার প্রথম লেখা উপন্যাস দুটোর কঠোর সমালোচক। তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘আগুনপাখি’ ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয়।
উপন্যাসটি ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০০৮ সালে এ উপন্যাসের জন্য ভারতের কলকাতা থেকে ‘আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার’ পান তিনি। তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। এছাড়া ‘শিউলি’ নামে তার আরেকটি ছোট উপন্যাস আছে। এছাড়া সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আরেকটি উপন্যাস তিনি লিখতে চেয়েছিলেন। প্রায় একশ’ পৃষ্ঠাও লিখেছিলেন। সম্ভবত তিনি সেটা শেষ করতে পারেননি।
উপন্যাসিক হিসেবে তার খ্যাতি ঊর্ধ্বগগনে থাকলেও, মূলত তিনি ছোটগল্পের ব্যতিক্রমী রূপকার ছিলেন। ১৯৬০ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘শকুন’ গল্প। এ গল্প দিয়েই সাহিত্যজগতের দৃষ্টি কাড়েন। তারপর ছোটগল্পের মধ্যেই ডুবে থাকেন হাসান আজিজুল হক। ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ তার প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। তবে তার সবচেয়ে আলোচিত ও বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে।
এরপর ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘পাতালে হাসপাতালে’, ‘রাঢ়বঙ্গের গল্প’সহ অনেকগুলো ছোটগল্পে বই লিখেছেন। কিশোরদের জন্য লিখেছেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘লালঘোড়া আমি’ ও গল্পগ্রন্থ ‘ফুটবল থেকে সাবধান’। ‘কথাসাহিত্যের কথকতা’, চালচিত্রের খুঁটিনাটি’, ‘সক্রেটিস’সহ বেশ কিছু প্রবন্ধগ্রন্থ লিখেছেন। ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’, ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’, ‘এই পুরাতন আখরগুলি’। নামে ভিন্ন হলেও এগুলোই মূলত তিন খণ্ডে লেখা তার আত্মজীবনী। এছাড়া আরও কিছু আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও লিখেছেন। সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু সাহিত্য সংকলন ও স্মারকগ্রন্থ।
পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অপকৌশলের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন হাসান আজিজুল হক। অপকৌশলের বিরুদ্ধে তার লেখনী-লড়াই অব্যাহত ছিল। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের অত্যাচার ও স্বাধীন বাংলাদেশে মৌলবাদের বিষাক্ত ছোবলের বিরুদ্ধেও তিনি চালিয়েছেন কলমি লড়াই। এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি দেশের যেকোনো জাতীয় সংকটে সোচ্চার ছিলেন।
তরুণ বয়সের প্রতিবাদী মানসিকতা তার মধ্যে আজীবন বজায় ছিল। তবে তার লেখায় প্রতিবাদের ভাষা মোটেই গতানুগতিক ছিল না। ছিল না অন্য ধর্মের প্রতি বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ। যদিও এই বিদ্বেষেই হিন্দু সংখ্যাগুরু ভারত থেকে মুসলমান সংখ্যাগুরু পূর্ব পাকিস্তানে হিজরত করেছিলেন কৈশোরেই। প্রতিবেশী হিন্দুদের সম্পর্কের কখনও একটি অসাবধানী, অপমানজনক, অমার্যাদাকর, অসম্মানজনক শব্দ তিনি কোথাও উচ্চারণ করেননি, লেখেনি একটি বর্ণও। বিভাজনের কাঠগড়ায় তিনি কোনো ধর্মকেই দাঁড় করাননি। দেশত্যাগের জন্য হিন্দুকে দায়ী করে ক্ষতকে চিরস্থায়ী করার চেষ্টাও করেননি কোনো লেখাতে। যেকোনো ধর্মের প্রতি ছিল তার শ্রদ্ধাবোধ। এখানেই অনন্য হাসান আজিজুল হক।
বাংলাভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার যে বীজ রোপিত হয়েছিল বাঙালি হৃদয়ে, সে বীজের মহিরুহ ছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়, কাজী আবদুল ওদুদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুর রাহমান, আবু সাঈদ কাইয়ুম, সুফিয়া কামাল, আনিসুজ্জামান। আর সে বীজের শেষ মহিরুহ ছিলেন হাসান আজিজুল হক।
বাঙালি সংস্কৃতিকে লালন করার যে চেষ্টা বাংলাদেশের লেখক, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি করেছেন, তারা প্রায় সবাই ছিলেন রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রীক। রাজধানীর বাইরে সাধারণ এক মফস্বল শহরে থেকেও যে বুদ্ধিবৃত্তিক অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির চর্চা করা যায়, ধারক হওয়া যায়, সাধক হওয়া যায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন হাসান আজিজুল হক।
তিনি লেখক হিসেবে অর্জন করেছেন ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে একুশে পদক এবং ২০১৯ সালে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা।
বাংলা ছোটগল্পের রাজপুত্র হাসান আজিজুল হক প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে কখনও জড়াননি। কিন্তু আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক শোষণের বিরুদ্ধে গ্রামবাংলার মানুষের চেতনাকে তিনি তুলে এনেছেন পরম যত্নে। ৮২ বছর বয়সে তার প্রয়াণ বাংলা সাহিত্য তথা, দুই বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্ত সংস্কৃতি চর্চায় বাধাগ্রস্ত হবে নিঃসন্দেহে। তাই তো তার প্রয়াণে শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও। বাঙালি জাতি তার প্রয়াণে শোকাহত।
তথ্যসহায়ক:
হাসান আজিজুল হক সংক্রান্ত সনৎকুমার সাহা, যতীন সরকার ও জাহানারা নওশিনের রচনা, মনু ইসলাম সম্পাদিত সেন্টার ফর বাংলাদেশ কালচার প্রকাশিত ‘কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক সংবর্ধনা’, দৈনিক সমকাল ‘কালের খেয়া’ ২ নভেম্বর ২০১৮ ও ইন্টারনেট।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার।