বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিতর্কে কমিশন, উদ্বিগ্ন জনগণ

  •    
  • ১৬ নভেম্বর, ২০২১ ১৩:৫০

প্রথম ধাপের নির্বাচনের পর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় নির্বাচন কমিশন ‘বিব্রত ও উদ্বিগ্ন’ বলে জানিয়েছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। তিনি বলেছেন, এসব বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় ভূমিকা থাকা দরকার।

কেমন হচ্ছে, কেমন হয়েছে এবং কেমন হবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন? এই প্রশ্নে সাধারণ উত্তর হতে পারে, আর নির্বাচন, দেখছেন না? একে নির্বাচন বলতে কষ্ট হয়, নির্বাচন নয় বলতে ভয় হয়। মুচকি হেসে এড়িয়ে যাওয়াই নিরাপদ। কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া তো সহজ নয়। মানুষকে থাকতে হবে গ্রামে। যেতে হয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে নানা ধরনের প্রয়োজনে। আগে তো দলের পরিচয় দেখে সহায়তা পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করত এখন দলের কোন অংশ তা দিয়ে যাচাই এবং সিদ্ধান্ত হবে। কী করবে তাহলে গ্রামের মানুষ?

দুই ধাপের নির্বাচন হয়ে গেল। প্রথম ধাপে ৭২, দ্বিতীয় ধাপে ৮১ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হয়েছেন। চলতি মাসের শেষদিকে অনুষ্ঠিতব্য তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে একাধিক প্রার্থী না থাকায় ১০০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন। তিন ধাপে ২৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান! এটা একটা রেকর্ড। এর আগে ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন ২১৭ চেয়ারম্যান।

দুটো রেকর্ডই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদটার সঙ্গে একটা সম্মান ও মর্যাদা জড়িয়ে ছিল একসময়। এলাকার সম্ভ্রান্ত বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেই বছরের পর বছর চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন টাকা ও শক্তির কাছে শ্রদ্ধা সম্মান যে পরাস্ত হয়েছে তার নজির ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও প্রকাশিত। তাই একটা বিষয় পরিষ্কার যে যারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন, শ্রদ্ধায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়ায়নি কিংবা তারা এত পরিচিত মানুষ তার বিরুদ্ধে কীভাবে ভোটে দাঁড়াই- এই শরম থেকেও তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন এটা ভাবলে ভীষণ ভুল হবে। ভয়ে কেউ দাঁড়াননি। শ্রদ্ধার স্থান দখল করেছে সহিংসতা।

নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা এবং দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সৃষ্টি হয় শুধু নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণে। কিন্তু পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার চাইতে বহুগুণে জরুরি। পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ শুধু ব্যক্তির ক্ষমতায় সম্ভব হয় না সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় প্রতিষ্ঠানের।

অবশ্য এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমস্ত দায়িত্ব এবং দক্ষতা নিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সিদ্ধান্ত ঘোষণার কাজ তাকেই করতে হয়। তিনি যদি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে তাহলে দেশের মানুষ ভরসা পায়। কিন্তু যদি দেখা যায় তার নিজের কথার উপরই নিয়ন্ত্রণ নেই তাহলে প্রথমে উদ্বেগ এবং পরবর্তী সময়ে কৌতুক অনুভব করা ছাড়া উপায় থাকে না।

দেশে যতগুলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আছে তার মধ্যে অন্যতম নির্বাচন কমিশন। বাংলাদেশের মতো নির্বাচনে আগ্রহী দেশে যেখানে নির্বাচনের সঙ্গে আবেগ-আঞ্চলিকতা, পারিবারিক মর্যাদা-দল, ব্যক্তির পরিচিতি-আর্থিক সুবিধা, এলাকার কর্তৃত্ব আর রাজনৈতিক ক্ষমতা যুক্ত হয়ে আছে সেখানে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করা সহজ বিষয় নয়।

আবার পৃথিবীতে খুব কম দেশই আছে যেখানে জনসংখ্যা ১১ কোটি। সেখানে বাংলাদেশের ভোটারের সংখ্যা ১১ কোটির কাছাকাছি। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন গণতন্ত্রের চর্চার জন্য যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন স্থানীয়পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্যও। নির্বাচনকে ঘিরে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা সহিংসতা হয় তার রেশ থাকে বহুদিন এবং বহু ঘটনায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাই নিরপেক্ষ নির্বাচন এত প্রয়োজন।

প্রথম ধাপের নির্বাচনের পর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় নির্বাচন কমিশন ‘বিব্রত ও উদ্বিগ্ন’ বলে জানিয়েছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। তিনি বলেছেন, এসব বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় ভূমিকা থাকা দরকার। তারা আরও একটু সক্রিয় হলে সহিংসতা কমবে।

নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি এ কথা বলেছিলেন। এর আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ইসি কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন কমিশনের সদস্যরা। রুদ্ধদ্বার ওই বৈঠকে সিইসি, তিনজন কমিশনার, ইসি কার্যালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালকসহ নির্বাচন পরিচালনা শাখার কর্মকর্তারা অংশ নেন। আলোচিত কমিশনার মাহবুব তালুকদার বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে সিইসি বলেন, নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। কমিশন সেটা প্রত্যক্ষ করছে। নির্বাচনের ব্যাপারে মাঠপর্যায়ে কী ধরনের নির্দেশনা দেয়া দরকার তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ৪ নভেম্বরের বৈঠকে আরও বিস্তারিত আলোচনা হবে।

কে এম নূরুল হুদা বলেন, অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেছে। যা নিয়ে কমিশন বিব্রত। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কমিশনে আলোচনা করে মাঠপর্যায়ে দিকনির্দেশনা দেয়া হবে।

সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ইতিবাচক নয় বলে মন্তব্য করেন সিইসি। তবে পরিস্থিতি ইসির নিয়ন্ত্রণে আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইসির যথাযথ নিয়ন্ত্রণ আছে। নির্বাচনে যারা অংশ নেয়- যেমন রাজনৈতিক দল, ভোটার ও প্রার্থীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়।

সুতরাং ইসি যতই যা করুক, মাঠপর্যায়ে সহনশীলতা না থাকলে এ নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তার পর বুড়িগঙ্গায় অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ফলাফল তো দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল।

এখন তারা জড়িয়ে গেলেন বাগযুদ্ধে। বাক স্বাধীনতা নিয়ে অনেক কথা থাকলেও নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরীণ বাগযুদ্ধ বেশ ভালোই চলছে। এটা অবশ্য শুরু থেকেই। এতে পরস্পর ঘায়েল হলেও নির্বাচনি ব্যবস্থা এবং কমিশনের ভূমিকার কোনো উন্নতি হয়নি।

দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের পর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে কমিশনার মাহবুব তালুকদার তার কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এতে তিনি বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ যতই ফুরিয়ে আসছে নির্বাচন ব্যবস্থা ও অবস্থা দেখে ততই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি। আজও রূপকার্থে কিছু কথা বলতে চাই। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন এখন আইসিইউতে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বে আদর্শ নির্বাচনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা ও চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা। আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্যপদে ৬৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসন লাভ করে।

অন্যদিকে রাউজান উপজেলায় ১৪ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ১২৬ পুরুষ ও ৪২ জন সংরক্ষিত আসনের সদস্য সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পদে আসীন হয়েছেন। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো উপজেলায় চেয়ারম্যান ও সদস্যের ১৮২টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন না হয়ে ‘নির্বাচিত’ হন।

নির্বাচনে কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী বা প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় নির্বাচন ছিল শান্তিপূর্ণ। সারা দেশে যদি সন্ত্রাসমুক্ত এ ধরনের নির্বাচন করা যায়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের বদলে একজন সচিবের অধীনে একটি সচিবালয় থাকলেই যথেষ্ট!’ মাহবুব তালুকদার কথাটি রূপক অর্থে বললেও তাতে নির্বাচনের আসল রূপটাই প্রকাশিত হয়েছে।

এর কড়া জবাব দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কে এম নূরুল হুদা বলেন, তিনি সাত দিন ধরে চিন্তা করে এই শব্দগুলো ঘেঁটে বের করেন। তারপর ছেড়ে দেন। এটা পাঁচ বছর ধরে দেখছি। এটা উনি করেন। আমাদের কিছু করার নেই। দুজন কমিশনার বার বার ওনাকে বুঝিয়েছেন। একটা টিমে আছি, দেখতে হবে নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু হয়।’ এই হলো নির্বাচন কমিশনের টিমের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। একজন সমালোচনা করেন নির্বাচনের অন্যজন কটাক্ষ করেন তার দায়িত্ববোধের। কিন্তু যে বিষয় নিয়ে বিতর্ক তার তো সমাধান হয় না। সুষ্ঠু নির্বাচন কি অধরাই থেকে যাবে তাহলে?

ইউনিয়ন পরিষদ দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থার সর্বনিম্ন ধাপ আবার নির্বাচনি ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপও বটে। সেই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া অন্যদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়া, সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটা, ইতোমধ্যে ৪০ জনের মৃত্যু তার মধ্যে গুলিতে ২০ জনের মৃত্যুবরণ; এসব খবরের কোনোটাই গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়। ভবিষ্যতের জন্য এ এক অশনিসংকেত।

লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এ বিভাগের আরো খবর