সম্প্রতি পূর্বঘোষণা ছাড়াই গণপরিবহনে ধর্মঘট ডেকে যে দুর্ভোগের সৃষ্টি করেছিল মালিক-শ্রমিকরা মিলে, তার অবসান হলেও বলির শিকার হলো সেই যাত্রীরাই। চাপের মুখে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। যে হারে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, তার কঠোর সমালোচনা করেছেন নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ, বিশিষ্টজন, ভোক্তা অধিকার সংগঠন ও যাত্রী অধিকার রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা করলেও ‘যাহা বাযান্ন তাহাই তেপ্পান্ন’!
এই একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কারো কিছু বলার নেই। বরাবরের মতো যাত্রীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এবারও পরিবহন মালিকদের অন্যায্য চাপ মেনে নেয়া হয়েছে। জনগণের কাঁধে বাড়তি ভাড়ার বোঝা চাপিয়ে বাস ও লঞ্চের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছেন মালিকরা। দূরপাল্লার রুটের বাসে ২৭ শতাংশ এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলরত বাসে ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে সরকার।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে মিনিবাসের ভাড়া ৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ও বাসের ভাড়া ৭ টাকার স্থলে ১০ টাকা করা হয়েছে। অপরদিকে লঞ্চের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৩৫ শতাংশ। নতুন ভাড়া নির্ধারণে তেলের দাম ছাড়াও এ খাতে বিনিয়োগ, ঋণের সুদ, রক্ষণাবেক্ষণ, যন্ত্রাংশ, বিভিন্ন ধরনের চার্জ, শ্রমিক বেতনসহ অন্যান্য ব্যয়ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গত সোমবার থেকেই বাড়তি এই ভাড়া গুনতে হচ্ছে সড়ক ও নৌপথের যাত্রীদের। ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে কৌশলে ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছে মালিকরা। এই অযৌক্তিক পদ্ধতিতে ভাড়া বাড়ানো কতটা অমানবিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সরকারের কিছু কর্মকর্তার হঠকারিতায় ডিজেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে জনগণকে এই দুর্ভোগের কবলে পড়তে হয়েছে। গত ৩ নভেম্বর রাতে ডিজেলের দাম একলাফে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা লিটার করেছে সরকার। এর ফলে ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে গত শুক্রবার ভোর থেকে সারা দেশে বাস চলাচল বন্ধ রাখেন মালিকরা। এর পর তিনদিন ধরে পথে পথে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে অগণিত মানুষকে। এর সঙ্গে লঞ্চ ধর্মঘট যুক্ত হওয়ায় পরিস্থিতি হয় শোচনীয়। ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ার জেরে দূরপাল্লা ও নগর পরিবহনের বাস ভাড়া গড়ে ২৭ শতাংশ বেড়েছে।
গত রোববার সারাদিন বৈঠক শেষে ভাড়া বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্তের পর মহাদুর্ভোগের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে বাস চলাচল শুরু হয়। এর মধ্য দিয়ে টানা তিনদিনের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পান যাত্রীরা। এটা হলো একটি জরুরি বিষয়। এর চেয়ে বড় বিষয় আর কী হতে পারে। এই ঘটনার পরের জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে লাগাতার ধর্মঘট ডেকে মানুষকে গণপরিবহনে বর্ধিত ভাড়া আদায় নিয়ে চলছে নৈরাজ্য।
এ নিয়ে দূরপাল্লা কিংবা দুই মহানগরীতে চলা পরিবহনে মানা হচ্ছে না সরকারি নির্দেশনা। ডিজেলে চলে- এই অজুহাতে সিএনজিচালিত বাসেও আদায় করা হয় বর্ধিত ভাড়া। এ কারণে কন্ডাক্টর ও যাত্রীদের মধ্যে হয়েছে বাদানুবাদও। এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। হঠাৎ করেই যাতায়াতে অনেকটা বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে তাদের। নিত্যপণ্যের চড়া দামের কারণে কষ্টে থাকা মানুষের জন্য বড় চাপ হয়ে দেখা দিয়েছে পরিবহন খরচ।
পরিবহন এমনি একটা বিষয় যারা এক পয়সার ভাড়া বাড়লে সব ধরনের পণ্যের ভাড়া বাড়ে। এই মুহূর্তে এ কাজটি হলো ‘মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা’য়ের মতো। এখানে সবচেয়ে বড় বিষয় যেটা, তাহলো যে বাসগুলো চলছে তা সিএনজি-চালিত। তাহলে জ্বালনি তেলের দাম বাড়লে পরিহনের ভাড়া বাড়বে কেন?
অন্যদিকে শুভংকরের ফাঁকি হচ্ছে- ধরা গেল বর্ধিত ভাড়া ২৭ ভাগ। যে যাত্রী মোহাম্মদপুর থেকে বনানী গেল তার থেকে ২৭ পার্সেন্ট। আবার ওই সিটে যে ক্ষিলক্ষেত এল, তার থেকেও ২৭ পার্সেন্ট, ওখান থেকে যে আব্দুল্লাহপুর গেল, তার থেকেও ২৭ পার্সেন্ট। তাহলে ভাড়া কত বাড়ল আর নেয়া হলো কত? এ গেল একটা কথা, এর পরেই আসা যাক বাস্তবতার গল্পে। মোহাম্মদপুর থেকে ক্ষিলক্ষেতের ভাড়া ছিল ৪০ টাকা। এখন সেখানে হয়েছে ৬০ টাকা। এহারে ভাড়া বাড়েনি। কিন্তু আদায় করা হচ্ছে। এটা কোনো শোনা গল্প নয়। বাস্তব অভিজ্ঞতা। এটা নিয়ে টানাহেঁচড়া করলে ৫ টাকা ফেরত দেয়া হয়। সড়কে কোনো নিয়মিত মোবাইল কোর্ট দেখা যাচ্ছে না। দেখার কেউ নেই।
বরং পরিবহন ধর্মঘট থেকে ভাড়া নির্ধারণী বৈঠকে দেখা গেল সরকারসমর্থিত কিছু নেতার দাপট। মন্ত্রী এমপি না থাকলেও যে তারা ক্ষমতাধর এটা তারা দেখাল। সেখানে সরকারের ভূমিকা গৌণ। অথচ এই জিম্মি নাটক ঠেকাতে সরকার ১০০ বিআরটিসি বাস ছাড়লে পরিবহন নেতাদের এই অপরাজনীতি থাকে না। সরকার সেখানে ঠুঁটোজগন্নাথ হয়ে বসে আছে।
শীত পড়েছে গ্রামগঞ্জে। শীতের সবজি উঠছে। ক্ষেতের টমেটো বিক্রি করছে ১০ টাকা, বেগুন, করোলা পাঁচ টাকা, কফি ৭/১০ টাকা। আর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আসতে আসতে দাম বাড়তে থাকে। রাজধানীবাসীর হাতে এলে ৫০ থেকে ৭০ টাকা। তাহলে দাম কৃষক পেল না। পেলটা কে।
এ খেলা আজকের নয়। প্রতি বছরের। বগুড়ার খামারের চিত্র এটা। ট্রাক মালিকদের ভাষ্য হলো- ট্রাক ভাড়ার সঙ্গে মোড়ে মোড়ে টাকা দিতে হয়। কাদের দিতে হয় কেন দিতে হয়। সবাই জানেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও পুলিশের ভূমিকা সবার জানা তারপরও অব্যবস্থা চলছে। পরিবহন শ্রমিকের যে কষ্ট তা কে বুঝবে? পরিবহণ শ্রমিক এখানে সাক্ষী গোপাল। একদিন গাড়ি না চালালে যে অভুক্ত থাকে। বাসে প্রতিদিন মার খায় সে। আর ক্ষির খেয়ে যায় দুধের মাছি। সড়কে যে নৈরাজ্য চলছে সেটা বন্ধ করতে যে শিরদাঁড়া লাগে তা কি সরকারের নেই? আছে।
সরকার পারে না এমন কিছু নেই। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? অথচ ভোটের সংখ্যায় নেতাকর্মী, পুলিশ না ওই জনগণ সবকিছু। একটি জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যদি শ্রমিকদের দাপটে সরকারকে জনগণের ওপর দায় ফেলে দিতে হয়, তাহলে আমাদের বলার কিছু থাকে না। পরিবহনে অনৈতিক ভাড়া বৃদ্ধি তার প্রভাবে পণ্য মূল্য বাড়ছে। এই নৈরাজ্য কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের উচিত ঘুরে দাঁড়িয়ে এই নৈরাজ্য ঠেকানো। সরকার কি তা পারবে?
২.
গত বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহে শনাক্ত হলো করোনা। তারপরে মৃত্যু যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। ঢাকার স্বাভাবিক পরিস্থিতি বদলে গেল। মানুষ নিরুপায় হয়ে গেল। লকডাউন, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন, স্যানিটাইজার, মাস্ক কত নতুন সব শব্দের সঙ্গে পরিচিত হলাম আমরা। উন্নত দেশগুলোতে মৃত্যুর পরিণতি দেখে সন্ত্রস্ত হলো মানুষ। কোন ওষুধে এর থেকে মুক্তি মিলবে তাও জানে না কেউ। ধীরে ধীরে ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হলো দেশে দেশে। আমাদের দেশে সে ভ্যাক্সিন আসতে শুরু করল।
মানুষ আশায় বুক বাঁধল এর মধ্যে আমরা হারালাম অসংখ্য গুণী মানুষকে। হারালাম আত্মীয়স্বজনকে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা থেমে থাকেনি। তারা ভ্যাক্সিনের পর এবারে বাজারে এনেছে ট্যাবলেট আকারে করোনার ওষুধ। এখন পাশের দোকানেই পাওয়া যাবে করোনার ওষুধ। করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার ক্যাপসুল ‘মলনুপিরাভির’ জরুরি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এতদিন করোনার চিকিৎসায় টিকা ছাড়া কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ ছিল না। গত ৪ নভেম্বর মলনুপিরাভির নামের নতুন ওষুধের অনুমোদন দেয় যুক্তরাজ্য সরকার।
এ ছাড়া ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি ও যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনসহ (এফডিএ) বিশ্বের অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থায় মলনুপিরাভিরের অনুমোদন পর্যালোচনাধীন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মার্ক, শার্প অ্যান্ড ডোম (এমএসডি) ও রিজব্যাক বায়োথেরাপিউটিকসের যৌথ গবেষণায় ওষুধটি তৈরি হয়। এটি ক্যাপসুল আকারে মুখে খেতে হয়। ওষুধটি ব্যবহারে করোনা আক্রান্ত হলেও খুব কমসংখ্যক রোগীর হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে বলে গবেষণায় জানা গেছে।
বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ হিসেবে করোনার এই বড়ি অনুমোদন পেল দেশে। আশা করা হচ্ছে, ওষুধটি মৃত্যু ঠেকাতে ও হাসপাতালে ভর্তি অর্ধেক কমাবে। তবে ওষুধটি ব্যবহারে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। করোনা আক্রান্ত রোগীকে এই ক্যাপসুলটি দিনে ৮টি করে মোট ৫ দিন খেতে হবে জানিয়ে এর প্রতিটির দাম কত পড়বে তা-ও বলে দিয়েছেন ডিজি। তিনি বলেছেন, ২০০ মিলিগ্রামের প্রতিটির ক্যাপসুলের দাম ৫০ টাকা করে পড়বে। সরবরাহ বাড়লে দাম কমতে পারে। ১৮ বছরের বেশি যেকোনো ব্যক্তি এটি সেবন করতে পারবেন। মলনুপিরাভির করোনা চিকিৎসার জন্য তৈরি মুখে খাওয়ার প্রথম ওষুধ।
এটা চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য যেমন আনন্দের সংবাদ তেমন দেশের জন্যও। করোনা চিকিৎসায় দেশ আরও অনেক দূর এগিয়ে গেল এটা নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য। আমরা চাই এর যথাযথ প্রয়োগ হোক এবং দেশের ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারীদের সিণ্ডিকেটও বিশাল। তারা এর নাগাল পেলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটাবে। ভেজালকারী গোষ্ঠী যাতে এর নাগাল না পায় এর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে নজর রাখতে হবে।
লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক