বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শহীদ নূর হোসেন ও কবির কল্পডানা

  • মোজাম্মেল হোসেন   
  • ১০ নভেম্বর, ২০২১ ১৯:৪৮

ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিএনপি এখন পেছনে পড়ে গেছে এবং আওয়ামী লীগ ১২ বছর ধরে টানা ক্ষমতায়। কিন্তু মারামারি-হানাহানির কমতি নেই। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো মাথাচাড়া দেয়ার চেষ্টা করছে। বিএনপি যে দুর্বল সে অবস্থায় আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যেই এখন বেশি মারামারি-হানাহানি করছে সারা দেশে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন নিয়ে। ২০২৩ সালে যে জাতীয় নির্বাচন তা ঘিরে নানা রকম উদ্বেগ-অনিশ্চয়তা আছে।

আমাদের সময়ে আমাদের প্রাণপ্রিয় কবি, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি, শামসুর রাহমান ‘আসাদের শার্ট’ কবিতা লিখেছিলেন ১৯৬৯ সালে। “গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা/ সূর্যাস্তের জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/ উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।... আমাদের প্রাণের পতাকা।” কত শত জায়গায় কত সহস্রবার যে আবৃত্তি করেছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে শহীদ হন পাকিস্তানি জেনারেল আইউব খানের স্বৈরশাসন উৎখাতের ছাত্র-গণ-আন্দোলনে, যা গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়, যা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পদধ্বনি।

বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের নিগড়ে থাকার পঁচিশ বছর গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে করতেই দেশ স্বাধীন করেছে মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করে রক্তসাগরে ভেসে। এর পরেও যে আবার সামরিক শাসন, আবার গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে হবে- এ ইতিহাসের একটু বেশিই নির্মম দাবি আমাদের কাছে। কিন্তু উপায় নেই। বিশ্বজুড়ে, ইতিহাসজুড়ে নানা দেশে এমন আখ্যানের অভাব নেই। টান টান সজাগ থাকাই স্বাধীনতার দাম চোকানো। নইলে বিপদ। ১৯৮৭ সালে শামসুর রাহমান আবার লিখলেন তেমনি এক অমর কবিতা ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ নাম দিয়ে।

কার বুক? কবিতায় পাঁচবার আছে নামটি। আজ ১০ নভেম্বর ২৪ বছরের সেই সুঠামদেহী তেজি যুবকের শহীদ হওয়ার দিন। ৩৪ বছর আগে। ১৯৮৭ সালে। বাংলাদেশি লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদের আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে। কবিতাটির শেষ স্তবক:

‘উদাম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে পিঠে

রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য স্লোগান,

বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ

শহরে ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা

নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়

ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ

বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার

বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।’

কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক একতায় ১৯৮৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস সংখ্যায়। আমি তখন ওই পত্রিকায় সংবাদকর্মী ছিলাম। যেদিনের ঘটনা, ১০ নভেম্বর, গণবিক্ষোভে উত্তাল হৈমন্তিক শীতেও রৌদ্রালোকিত অগ্নিময় সেই দিনটিতে আমরাও উত্তেজনাসহ খবর সংগ্রহ ও লেখায় ব্যস্ত ছিলাম।

কবিতাটিতে যা লেখা হয়েছে তাই ঘটেছিল দুপুরে রাজধানীতে সচিবালয়ের কাছে রাজপথে। নূর হোসেনের শ্যামলা উদোম বুকে সাদা রঙে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক’, আর পিঠে ‘গনতন্ত্র মুক্তি পাক’। এই ভুল বানানই জানান দেয় যে, নূর হোসেন ছিলেন স্বল্প শিক্ষা পাওয়া আমজনতার একজন, খেটে খাওয়া মানুষ। পরে তার ও পরিবারের অনেক খবরই জানা গেছে ও নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। নূর হোসেন তখন অবিবাহিত। ওদের ছোট বোনটি স্কুলে পড়ত, চার ভাই নানা রকম মজদুরি করত, বাবা স্কুটারচালক মজিবুর রহমান স্ত্রীসহ সাতজনের পরিবার নিয়ে বনগ্রামে গরিবের ছোট্ট বাসায় বসবাস। পুত্রশোকের গভীর বেদনা নিয়ে অনেক দুঃখকষ্টের জীবনের অবসান ঘটেছে ২০০৫ সালে।

তখন সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক ও এখন দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান নূর হোসেন শহীদ হওয়ার দুই সপ্তাহ পরে আকস্মিকভাবে বেবিট্যাক্সিতে যাত্রী হয়ে যাওয়ার সময় মজিবুর রহমানের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ হন, তাদের বাসায় যান, পরবর্তী কয়েক বছরে সময় দিয়ে তাদের নিয়ে অর্ধডজন সংবাদ প্রতিবেদন ও নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এই লেখাগুলো ও শামসুর রাহমানের তিনটি কবিতা নিয়ে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর অঙ্গসজ্জায় একটি চমৎকার বই প্রকাশিত হয়েছে।

সেখানে মতিউর রহমান আমাদের জানান, নূর হোসেনের বাবা কীভাবে তার শহীদ সন্তানের স্বপ্নপূরণ কামনা করতেন, অনেক পরিচিত হয়েও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে হাত পেতে সাহায্য চাননি, বরং কষ্ট পেয়েছেন, মৃত্যুর কয়েক বছর আগে রোগশয্যায় নূর হোসেনের বড় ভাইকে বলেছেন, ‘ছেলেটা যা চেয়েছিল তা তো হলো না। স্বৈরতন্ত্র নিপাত হলো। এখনো দেশে এত হানাহানি, সন্ত্রাস। গণতন্ত্র তো মুক্তি পেল না।’ মতিউর রহমান ১৯৮৮ সালের একটি লেখায় জানান, এরশাদ সরকারের সুবিধা হয় এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে বিনষ্ট করা যেতে পারে এমন বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেয়ার জন্য মজিবুরকে প্রলোভন দেখিয়ে প্রভাবিত করা অনেক চেষ্টা হয়েছে কিন্তু তিনি বিনীতভাবে সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।

একজন শ্রমজীবী মানুষের এই চারিত্রিক দৃঢ়তা আমাদের আশান্বিত করে।

গণতন্ত্র মুক্তি পাক পিঠে লেখা মিছিলে হাঁটা নূর হোসেনের ঐতিহাসিক ছবিটি তুলেছেন প্রখ্যাত ফটোসাংবাদিক পাভেল রহমান। তিনিও সেই অভিজ্ঞতা ও স্বীয় অনুভূতির বিবরণ নিজের বইয়ে লিখেছেন। নূর হোসেন মারা যাওয়ায় ছবিটি নিয়ে অনেক চাঞ্চল্য হয় ও তা পরে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করে। ওইভাবে গায়ে স্লোগান লিখে মিছিলে যাওয়ায় পুলিশ নিশানা করেই মারতে পারে। সামনে থেকে বুকে স্বৈরাচার নিপাত যাক লেখা ছবিটি অন্য ফটোসাংবাদিকের তোলা। মিডিয়ায় ঝুঁকি নিয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবহার ও গুণগত কারণে পাভেলের ছবিটি বেশি পরিচিতি পেয়েছে।

ঘটনার দিন নূর হোসেনের পরিচয় সংবাদিকরাই বের করেন। অন্য দুই লাশের সঙ্গে বেওয়ারিশ হিসেবে রাতে কড়া পুলিশি প্রহরায় জুরাইনে দাফন করা হয়েছিল। গায়ে স্লোগান লেখা থাকায় পরে গোরখোদকদের সাহায্যে কবরটি শনাক্ত করা হয়েছে।

নূর হোসেনের এমন আত্মদান এরশাদবিরোধী আন্দোলনে প্রবল গতি সঞ্চার করেছিল। তার ছবি দিয়ে বানানো পোস্টার হয়ে ওঠে রাজপথে এক প্রভাবক শক্তি। এরশাদের আট বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একাধিকবার ঢেউয়ের মতো ওঠা-পড়া আন্দোলনে অনেক ছাত্র-তরুণ ও নাম জানা-অজানা মানুষ শহীদ হয়েছে। তাদের মধ্যে নূর হোসেন ও পরে এরশাদের পতনের বছর ১৯৯০ সালে সরকার সমর্থক গুন্ডাদের গুলিতে শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের নাম ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল অক্ষরে ভাসছে।

কোনো শহীদেরই মর্যাদা খাটো করে দেখা যায় না। তবে নানা বাস্তব কারণে ইতিহাসে কারো কারো বেশি গুরুত্ব পাওয়া ইতিহাসেরই ধর্ম। বহু দেশে বহু নাম না জানা শহীদকেও স্মরণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হয়।

১৯৮০-এর দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নূর হোসেন মেহনতি শ্রেণির একজন সচেতন অংশগ্রহণকারী। কোনো সংগঠনে সংঘবদ্ধ না হয়েও বন্ধুদের নিয়ে এসেছিল জনতার মিছিলে। দেশের অনেকগুলো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের তিনটি জোটের যুগপৎ কর্মসূচিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দেলন হয়েছিল তখন এরশাদ শাসনের বিরুদ্ধে।

সেই জোটগুলো ছিল আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ ১৫ দল, বিএনপিসহ ৮ দল ও জাসদসহ বামপন্থীদের ৫ দল। এ রকম পরিচয় হলেও আন্দোলনের মধ্যেই বিভিন্ন সময়ে জোটগুলোতে দলের সংখ্যা ওঠা-নামা বা কিছু ভাঙচুর হয়েছিল। তবে এরশাদকে উৎখাতের প্রশ্নে সবাই একমত ছিল।

১৯৮৭-এর ১০ নভেম্বরর ছিল এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে অবরোধ ও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি। সরকারই লোকসমাগম বন্ধ করতে জন্য গণপরিবহন আটকিয়ে এমন ব্যবস্থা করে যে হরতালের মতো অবস্থা তৈরি হয়। নূর হোসেন নিজের গায়ে স্বপ্নের কথা স্লোগানে লিখে মিছিলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আগের রাতে ঘর ছেড়ে মতিঝিলের একটি নির্মাণাধীন দালানে এক বন্ধুকে নিয়ে রাতে জেগে থাকে। ওই বন্ধুই তার গায়ে রং লেপে লিখে দেয়। বাবা-মা খুঁজতে এলে চাদর গায়ে ঢেকে রেখে নূর হোসেন মিছে কথা বলে তাদের ফিরিয়েছিল। এসব কথা ধীরে ধীরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।

গত ৩৩ বছর আমরা নূর হোসেন দিবস পালন করে আসছি। ডা. মিলনকেও সেভাবে স্মরণ করি। এই তিন দশকে আমাদের রাজনীতিতে অনেক ঘটন-অঘটন হয়েছে। যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একসঙ্গে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে অনেক রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। সংঘাত ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বই গত তিন দশকের লাগাতার রাজনৈতিক ধারা।

ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিএনপি এখন পেছনে পড়ে গেছে এবং আওয়ামী লীগ ১২ বছর ধরে টানা ক্ষমতায়। কিন্তু মারামারি-হানাহানির কমতি নেই। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো মাথাচাড়া দেয়ার চেষ্টা করছে। বিএনপি যে দুর্বল সে অবস্থায় আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যেই এখন বেশি মারামারি-হানাহানি করছে সারা দেশে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন নিয়ে। ২০২৩ সালে যে জাতীয় নির্বাচন তা ঘিরে নানা রকম উদ্বেগ-অনিশ্চয়তা আছে। কারণ নির্বাচনি ব্যবস্থা ও নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর রাজনৈতিক দল ও জনগণের আস্থা এখন একেবারে তলানিতে।

নূর হোসেনকে স্মরণ করতে গিয়ে এখন তাই প্রশ্ন, তার বুকে-পিঠে লেখা সরল ভাষার সেই আকাঙ্ক্ষা, যা জনগণেরই আকাঙ্ক্ষা, তা কতটুকু পূরণ হয়েছে? এরশাদের ক্ষমতাচ্যুতি ও ১৯৯১-এর নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ছেড়ে জনকাঙ্ক্ষিত সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। সে অর্থে স্বৈরাচারের নিপাত ঘটলেও স্বৈরাচারী এরশাদ আমৃত্যু আরও ৩০ বছর টিকে থেকেছেন বাংলাদেশর রাজনীতিতে দোর্দণ্ড প্রতাপে নানা ঘটন-অঘটন, নানা দর-কষাকষিসহ নানা নেপথ্য-প্রকাশ্য ভূমিকায়।

সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের মর্যাদা এবং রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সবই পেয়ে গেলেন পরম আদরে। সংসদে সরকার সমর্থক উদ্ভট বিরোধী দল হয়ে এরশাদের আত্মীয়স্বজনসহ জাতীয় পার্টি এসব আনুকূল্য ভোগ করবে। এখানেই গণতন্ত্রের জন্য জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করে বর্তমান রাজনীতিবিদদের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ভেতরের অন্তঃসারশূন্যতা স্পষ্ট হয়।

জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি তিন জোটের রূপরেখা রাজনীতিবিদরা সম্পূর্ণ ভুলে গেলেন। রূপরেখার মূল কথা ছিল, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা করে স্বৈরশাসনের পুনরাগমনের আশঙ্কা দূর করা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অসাম্প্রদায়িক দেশ, সাম্প্রদায়িক প্রচারণা সমবেতভাবে প্রতিরোধ করা, জোটভুক্ত সব দলের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও পরমতসহিষ্ণুতা, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান, নির্বচনি সংঘাত পরিহার করা এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য একগুচ্ছ অঙ্গীকার। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতা ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক মূল্যবোধটি মনে রেখেছেন তা দেশবাসী দেখছে।

একজন অতিসাধারণ শ্রমজীবী নূর হোসেনের পিঠে লেখা গণতন্ত্র মুক্তি পাক স্লোগানটির ব্যঞ্জনা অনেক। স্বৈরশাসন নেই, গণতন্ত্র আছে দাবি করতেই পারি। তবে এ গণতন্ত্র কতটা মুক্ত ও কতটা নানা বেড়াজালে বন্দি তা দেশবাসীর চেয়ে ভালো কেউ জানে না। অচিরেই নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সংঘাতের অশঙ্কা করা হচ্ছে, কারণ সংবিধান মোতাবেক কমিশন গঠনের নিয়ম-নীতি ও প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট করে আইন প্রণয়ন করতে রাজনীতিদিরা চান না। নির্ভয়ে নিরাপদ পরিবেশে ভোট দেয়া, জাতীয় সংসদের কার্যকর বিরোধী দল, মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতাসহ মুক্ত সংবাদমাধ্যম- এসব দিয়েই বিচার করতে হবে গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে কি না।

কবিদের অন্তর্দৃষ্টি গভীর আমরা জানি। একতার পাশাপাশি একই দিনের সংখ্যায় সাপ্তাহিক দেশবন্ধু নামের পত্রিকায় প্রকাশিত শামসুর রাহমানের ‘একজন শহীদের মা বলছেন’ কবিতাটির শেষ স্তবক আমাদের বিস্ময় জাগাবে:

‘হয়তো ভবিষ্যতে অনেকেই

তার কথা বলে দিব্যি মাতাবে শ্রোতার ভিড় আর

করবে এমন কেউ কেউ উচ্চারণ

ওর নাম, হোমরা-চোমরা তারা, যারা

তার কথা বলছে শুনলে সে আবার অকস্মাৎ

জিন্দা হয়ে পতাকার মতো হাত তুলে

জনসভা পণ্ড করে জানাবে তুমুল প্রতিবাদ,

ওদের মুখোশ-আটা ভণ্ড মুখে দেবে ছুড়ে থুথু, শুধু থুথু।’

এখানেই শেষ করতে পারতাম। কিন্তু শহীদী মৃত্যুর মহিমা আমাদের বারবার এসে জাগাবে, সংগ্রামে নতুন নতুন প্রেরণা দেবে। দুই বছর পর ১৯৮৯ সালের নূর হোসেন দিবসে সাপ্তাহিক একতায় শামসুর রাহমানের ‘আলো-ঝরানো ডানা’ কবিতায় পাই নূর হোসেনের রক্তাক্ত দুই কাঁধে-

‘গজিয়ে উঠেছে আলো-ঝরানো ডানা। আমাদের

চোখ কখনো কখনো ঝলসে ওঠে সেই আলোয়।

না, তাকে হত্যা করতে পারেনি। তা হলে

কে অমন আলো-ঝরানো এক জোড়া

ডানা নিয়ে উড়ে যাচ্ছে মেঘে মেঘে, হেঁটে চলেছে

রাজপথে? ওর চোখ নক্ষত্রের নীড়, বাহুতে

অনির্বাণ বরাভয়। নূর, নূর, নূর হোসেন বলে

ডাকছে রাজপথ, নদীনালা, গাছপালা, নীলকণ্ঠ

বাংলাদেশ। কখন আবার দশমিক

ওলট পালট করে জেগে উঠবে নতুন যৌবন?’

কবির এ কেমন কল্পডানা!

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এ বিভাগের আরো খবর