বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চৌত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি

  •    
  • ১০ নভেম্বর, ২০২১ ১৬:৩৭

আমরা ভেবেছিলাম গণতন্ত্র পেয়ে গেছি, আমাদের আর ভাবনা নেই। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুই প্রধান দলের মধ্যে অবিশ্বাস, অনাস্থা ক্রমশ বাড়তে থাকে। দুই দলের অবস্থান এখন দুই মেরুতে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে বিএনপি সেই দূরত্বকে অলঙ্ঘনীয় করে ফেলেছে। আর নিজেদের পাপে বিএনপি আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক।

৩৪ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিনগুলোর একটি- ১০ নভেম্বর। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে সামরিক শাসক এইচএম এরশাদ ক্ষমতায় আসেন ৮২ সালের মার্চে, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদের সূচনা করেছিল ৮৩-এর মধ্য ফেব্রুয়ারিতে।

এরশাদও তার পূর্বসুরি জিয়াউর রহমানের স্টাইলেই দেশ চালান। কিন্তু জনগণ মানেনি। ৮৩-এর মধ্য ফেব্রুয়ারিতে যে আন্দোলনের শুরু হয়েছিল, তা পরিণতি পেয়েছিল ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতনের মাধ্যমে। সময় লেগেছে। কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছার আগে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন কখনও থামেনি। হয়তো ভাটা এসেছে, কখনও জোয়ার। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের তুঙ্গস্পর্শী একটি দিন- ১০ নভেম্বর, ১৯৮৭।

১৯৮৭ সালের উত্তাল নভেম্বরে আমি কুমিল্লায় ছিলাম। ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে যোগ দিতে আমারও ঢাকা আসার কথা ছিল। জরুরি কাজে আটকে যাওয়ায় আসতে পারিনি। তবে সহযোদ্ধাদের বিদায় দিতে রাতে কুমিল্লা রেল স্টেশনে গিয়েছিলাম। সেদিন ঢাকা আসাটাও এক যুদ্ধ ছিল।

পুরো স্টেশন ঘিরে রেখেছিল পুলিশ। অবস্থা দেখে আমরা সবাই স্টেশনের আগে পিছে রেললাইনের পাশে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিলাম। যখনই ট্রেন ছাড়ার হুইসেল বাজে, তখনই সবাই অসহায় পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনে চড়ে বসে। তাদের নিরাপদে বিদায় করে ফিরি নিউ হোস্টেলে। পরদিন আমরা কুমিল্লায় কর্মসূচি পালন করেছি। আর ঢাকার খবর রেখেছি। অনেক পরে জানলাম নূর হোসেনের কথা। বুকে ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক’, পিঠে ‘গনতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে জীবন্ত পোস্টার হয়ে, পুলিশের সহজ টার্গেট হয়ে মাঠে নেমেছিল যুবলীগ কর্মী নূর হোসেন।

শেখ হাসিনা তাকে সাবধান থাকতে বলেছিলেন, মাথায় আদর করে দিয়েছিলেন। কারো শঙ্কা পাত্তা না দিয়ে মাঠে নেমে জীবন দিয়েছিল নূর হোসেন। ৮৭-তে না হলেও নূর হোসেনদের দেখানো পথ ধরে ১৯৯০ সালে নিপাত যায় স্বৈরাচার, মুক্তি পায় গণতন্ত্র। কিন্তু ৩৪ বছর পরে এসে আজ নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন সত্যিই কি মুক্তি পেয়েছে গণতন্ত্র? এই প্রশ্নের উত্তর পাই না। গণতন্ত্র মুক্তি তো পায়ইনি, আরও বেশি বন্দি হয়েছে। গণতন্ত্র আজ সুদূর পরাহত। এখনও গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা, ভোটাধিকারের জন্য আক্ষেপ, নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে অনাস্থা, নির্বাচন নিয়ে সংশয় আমাদের বেদনার্ত করে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮-দলীয় জোট আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭-দলীয় জোটের যুগপৎ আন্দোলনে পতন ঘটেছিল প্রবল স্বৈরাচার এরশাদের। আমরা ভেবেছিলাম গণতন্ত্র পেয়ে গেছি, আমাদের আর ভাবনা নেই। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুই প্রধান দলের মধ্যে অবিশ্বাস, অনাস্থা ক্রমশ বাড়তে থাকে।

দুই দলের অবস্থান এখন দুই মেরুতে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে বিএনপি সেই দূরত্বকে অলঙ্ঘনীয় করে ফেলেছে। আর নিজেদের পাপে বিএনপি আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের রাজনীতির দ্বিদলীয় ধারা এখন এক যুগ আগের স্মৃতি। বাংলাদেশে এখন একদলীয় রাজনীতি। কিন্তু ফাঁকা মাঠে নির্বাচন করতে গিয়েও আওয়ামী লীগ অনেক ফাউল করছে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি।

ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন সে নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস করেছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি এলেও সেবার ভোট হয়েছিল আগের রাতে। এখন দেশজুড়ে ধাপে ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে। বিএনপি মাঠে নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ আর বিদ্রোহী আওয়ামী লীগে কাটাকুটি খেলছে, মানুষ মরছে, গণতন্ত্র বার বার মরছে।

দুই প্রধান দলের অবিশ্বাস-অনাস্থার ফাঁক গলে গণতন্ত্রের লেবাস ধরে স্বৈরাচার মিশে গিয়েছিল রাজনীতির মূলধারায়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর কেউ কি ভেবেছিলেন এরশাদ এমপি হবেন, রাজনীতি করবেন, মন্ত্রীর পদমর্যাদা পাবেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হবেন? ক্ষমতায় থাকার ৯ বছরে এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতিকে ধ্বংস করেছেন। আর পতনের পর বেঁচে থাকার বাকি ১৯ বছর রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন।

পতনের পরের পাঁচ বছরই এরশাদ কারাগারে ছিলেন। এরপর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে সময় নেননি। বিএনপির সঙ্গে মিলে চারদলীয় জোট করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। এভাবে শোচনীয় পতনের বছর সাতেকের মধ্যে এরশাদ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে নিজেকে জায়েজ করে নিয়েছেন। মৃত্যুর আগে এরশাদ ছিলেন সরকারের অংশ। তার দল জাতীয় পার্টি আজ সংসদে প্রধান বিরোধী দল।

আশির দশকে আন্দোলনটা স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে ছিল বটে, তবে এখন আর আমি এরশাদ বা জাতীয় পার্টিকে অত দোষ দেই না। এরশাদ একজন ব্যক্তিমাত্র। পতনের পর নানান কিছু করেছেন বটে, তবে পতিত স্বৈরাচার এরশাদ ক্লাউনের বেশি কিছু ছিলেন না। জাতীয় পার্টি এখনও বিরোধী দল, তবে গৃহপালিত।

এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করতে, জোট করতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতাদের কেমন লাগে জানি না; দেখতে আমাদের খুব লজ্জা লাগে। তেমন একটি দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। সম্ভবত ১৯৯৯ সাল। চারদলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক হবে ২৯ মিন্টো রোডে বিরোধীদলীয় নেতার সরকারি বাসভবনে। ভোরের কাগজের রিপোর্টার হিসেবে আমার তখন সেখানে অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। একে একে নেতারা আসছেন। এরশাদের গাড়ি আসছে শুনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্য।

সবাই অপেক্ষা করছেন গাড়ি বারান্দায়। হঠাৎ আমানউল্লাহ আমান মাঝের ফুলের বাগান পায়ে দলে ছুটে গেলেন এরশাদকে মূল ফটকেই রিসিভ করতে। তারপর স্বৈরাচার এরশাদের গাড়ির সঙ্গে হেঁটে আসেন স্বৈরাচারবিরোধী সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আমানউল্লাহ আমান। আমান ভাই হয়তো জানতেও পারবেন না, শুধু বিরোধীদলীয় নেতার বাসভবনের ফুল বাগান নয়; তিনি সেদিন তছনছ করে দিয়েছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে তার সঙ্গে পা মেলানো এক কর্মীর হৃদয়ও। এরপর এমন অশ্লীল দৃশ্য আরও অনেক দেখেছি।

জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এরশাদের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের সবচেয়ে জরুরি মামলাটি করেছিলেন। এরশাদের আরো অনেক মামলার মতো সে মামলাও কোনো পরিণতি পায়নি। বরং বাদী ইনু আর বিবাদী এরশাদ একসময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট করেছেন। রাজনীতিতে সবচেয়ে অশ্লীল বাক্য হলো- রাজনীতিতে আসলেই শেষ কথা বলে কিছু নেই।

আমার দুঃখ এত রক্ত, এত সংগ্রাম করেও আমরা পূর্ণ গণতন্ত্রের স্বাদ পাইনি। নূর হোসেন জীবন দিয়েছেন ৩৪ বছর আগে। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। নূর হোসেনের বুকে-পিঠের দুটি স্লোগানই ভুল বানানে লেখা। আমরা কি তাহলে ভুল আন্দোলনে অপচয় করেছি আমাদের উজ্জ্বল যৌবন?

যতবার প্রশ্ন করি, ততবারই জবাব পাই না। জাতীয় পার্টি যখন আজ ১০ নভেম্বর পালন করে ‘গণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে, তখন বুঝি গণতন্ত্র আজও মুক্তির জন্য ডানা ঝাঁপটায়। জুরাইন কবরস্থানে শুয়ে থাকা নূর হোসেনের আত্মা কি একটু কষ্ট পায় না?

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আমাদের যৌবনকে মহিমান্বিত করেছে। রাজনীতিবিদদের আপসের চোরাবালিতে হয়তো হারাতে বসেছে আমাদের মহৎ অর্জন। কিন্তু তাতে অর্জনের মাহাত্ম্য ম্লান হয় না। খেটে খাওয়া যুবক নূর হোসেনের কাছে বানানটা মুখ্য ছিল না, মুখ্য ছিল গণতন্ত্রের মুক্তি।

নুর হোসেন দিবসে ভোটাধিকারের জন্য আমাদের আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হয়, গণতন্ত্রের জন্য আমাদের তৃষ্ণা আরও বাড়ে। ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ এই স্লোগান এখনও প্রাসঙ্গিক মনে হয়। এটা মানতেই হবে, গত একযুগে বাংলাদেশে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশ চমকে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। আশির দশকে আমরা ভাবিইনি, বাংলাদেশ আজকের জায়গায় পৌঁছবে। বাংলাদেশকে উন্নয়নের বিস্ময়ে বদলে দেয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই শেখ হাসিনার, আওয়ামী লীগের। সেই আওয়ামী লীগের কাছেই আমাদের আকাঙ্ক্ষা, উন্নয়নের যে ধারা, তা আরও বেগবান হোক, টেকসই হোক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। গণতন্ত্র না থাকলে, মানুষের ভোটাধিকার না থাকলে সবকিছুই অর্থহীন হয়ে যায়।

লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর