১০ নভেম্বর বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ও ঐতিহাসিক দিন। ১৯৮৭ সালের এদিনে রাজপথে রক্ত দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন নূর হোসেন। সেসময় স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী তিন জোট ঐক্যবদ্ধভাবে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। এই কর্মসূচি বানচালের জন্য স্বৈরাচারী সরকার বিভিন্ন অপচেষ্টা চালায়। ওইদিন সরকার-ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে হাজারো মানুষ রাজপথে মিছিল করে। ৮, ৭ ও ৫ দলীয় জোট আহূত অবরোধ চলাকালে কয়েক স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা মিছিলকারীদের ওপর লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে। এসময় ৪ জন নিহত ও বহু নেতাকর্মী আহত হয়।
নিহতদের অন্যতম ছিলেন নূর হোসেন। তার জামাবিহীন শরীরে, বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ এবং পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লেখা ছিল। ছাত্র-জনতার বিশাল মিছিলের অগ্রভাগে থাকা নূর হোসেনই ছিলেন ওইদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রধান আকর্ষণ। যদ্দূর মনে পড়ে, প্রচণ্ড রোদের মধ্যে মিছিলের সামনের দিকে নূর হোসেনকে দেখেছিলাম। আরও মনে পড়ে, সাদা রঙের কালিতে লেখা সেই ঐতিহাসিক ও ব্যতিক্রমী স্লোগান শরীরে বহন করে বীরের মতো এগিয়ে যাচ্ছিলেন যুবকটি। সব পথচারীর আকর্ষণই ছিলেন নূর হোসেন।
“মিছিলটি গুলিস্তান এলাকার গোলাপ শাহ মাজার হয়ে জিপিওর সামনের জিরো পয়েন্টে পৌঁছানোর আগে ঘাতকের বুলেট নূর হোসেনের বুক ভেদ করে বের হয়ে যায়।” (ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, পৃ. ৩৩৫)। এটা স্বীকার করতেই হয়, নূর হোসেনের হত্যাকাণ্ড স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তীব্র গতি সঞ্চার করে। আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাই একে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য স্বৈরশাসকের দমন-পীড়ন ও নির্যাতন বেড়ে যায়।
সরকারের দমন-পীড়ন যত কঠোর হতে থাকে, আন্দোলন ততই শক্তিশালী ও সুসংগঠিত হয়। বিরোধী ৩ জোট আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়। ১১ নভেম্বর (১৯৮৭) সরকার ৮ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী শেখ হাসিনা ও ৭ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে তাদের নিজ বাড়িতে অন্তরীণ করে রাখে। শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াকে যথাক্রমে ঢাকার মিরপুর রোড ও রাজধানীর পূর্বাণী হোটেলের এক কক্ষ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
৯ নভেম্বর রাতে বেগম জিয়া সেখানে অবস্থান করছিলেন। দুই নেত্রী ছাড়াও ৩ জোটের বহু নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। নূর হোসেনসহ আরও কজনকে হত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ১১ নভেম্বর পূর্ণ দিবস হরতাল পালিত হয়। আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। ফলে স্বৈরাচার সরকার এতটাই বেসামাল হয়ে পড়ে যে- অগ্নিসংযোগ, বোমাবাজি ও লুটপাট প্রতিরোধে ১২ নভেম্বর পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়।
চলতে থাকে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ-মিছিল। ১৩ নভেম্বর আগের ৩ দিনে পুলিশের গুলিতে নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর সমাবেশ থেকে আন্দোলনের লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সরকারি দমননীতি ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৩ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। প্রতিদিনই সরকারি বাহিনী ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ চলে। এসময় শত শত রাজনীতিক, শ্রমিক-ছাত্রনেতা ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৪৭-এ পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশেও মিছিলে বহু হত্যাকাণ্ড হয়েছে। কিন্তু কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সরকারবিরোধী আন্দোলনকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে সরকারের পতন ঘটায়; আবার কখনও সরকারকে পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়।
১৯৮২-এর ২৪ মার্চ অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর জেনারেল এরশাদ প্রায় ৫ বছর দোর্দণ্ডপ্রতাপে ক্ষমতায় থাকে। মিছিলের সামনে থাকা নূর হোসেন গুলিতে শহিদ হওয়ার পর এরশাদের ক্ষমতার ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। এর ধারাবাহিকতায় এর ৩ বছর পর ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে পতন ঘটে স্বৈরশাসক এরশাদের।
নূর হোসেনের হত্যার পর সরকারবিরোধী ৩ জোট আগের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়। একাধারে কয়েকদিন পূর্ণ দিবস ও অর্ধ দিবস হরতাল পালনের পর ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটের আহ্বানে বিরতিহীন ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক হরতাল এবং ২৩ ও ২৪ নভেম্বর সারা দেশে পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল। আন্দোলনের খবর প্রেরণের দায়ে বিবিসির ঢাকা সংবাদদাতা আতাউস সামাদকে ২৩ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। ভীত-সন্ত্রস্ত সরকার ২৫ নভেম্বর ঢাকার কয়েকটি স্থানে সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে পুলিশ এবং সরকারি দল জাতীয় পার্টির কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। ২৭ নভেম্বর এরশাদ দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে মৌলিক অধিকার স্থগিত করে। একই সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে সান্ধ্য আইন জারি করে হরতাল-ধর্মঘট ও লকআউট নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর আত্মজীবনী ‘রাজনীতির তিন কাল’ থেকে পাওয়া যায়- “আন্দোলন দমাতে সান্ধ্য আইন যে কতটা কার্যকর তা বোঝাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এরশাদকে হেলিকপ্টারে উঠিয়ে মধ্যাহ্নে আকাশ থেকে রাজপথের লোকজনহীন অবস্থা দেখান।” (পৃ. ২২৪)।
২৮ নভেম্বর এরশাদ বেতার-টিভির ভাষণে সব দাবি প্রত্যাখ্যান করে, সংকট নিরসনে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেন। এরশাদের আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ৩ জোট ২৯ নভেম্বর ৭২ ঘণ্টার লাগাতার হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করে। ৫ ডিসেম্বর জামায়াতের ১০ জন এমপি পদত্যাগ করে।
একই সময় আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সভায় আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত হয়। উপায়ান্তর না দেখে এরশাদ ৬ ডিসেম্বর ১৯৮৭ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। ৩ মার্চ ১৯৮৮ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতসহ সব বিরোধী দল বর্জন করে। নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ২৫১ ও জনসমর্থনহীন কয়েকটি দলকে বাকি আসন ভাগ করে দেয়া হয়।
বিরোধী দলবিহীন ওই নির্বাচন ছিল একতরফা। জনগণ ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।
এরপরের ইতিহাস সবার জানা। ১৯৮৮ সালের জুনের পর তিনদলীয় জোট ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আবারও পুরোনো দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে লিখেছেন- “১৯৮৮ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা সরকারের কার্যকলাপের সমালোচনার চেয়ে নিজেদের সমালোচনায় বেশি সময় ব্যয় করতে থাকেন।” (পৃ. ৩৪০)
ফলে যা হওয়ার তাই হলো। এরশাদ সময় পেয়ে যায়। নূর হোসেন হত্যার পর শুরু হওয়া আন্দোলনের চাপে এরশাদ ও তার দল খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ৩ জোট আন্দোলন অব্যাহত রাখতে পারলে ১৯৮৮ সালে নিশ্চিতভাবে এরশাদের পতন হতো। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। অবশেষে নব্বইয়ের ডিসেম্বরে এরশাদের পতন হয়। ৪ ডিসেম্বর রাতে এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
নূর হোসেনের আত্মদানের পর ৩৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। তার সেই কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র কি মুক্তি পেয়েছে? ১৯৯১-এ সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরায় চালু হলেও গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, এর কতটুকু হাসিল হয়েছে? সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা যত কম বলা যায়, ততই মঙ্গল। দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে যে নির্বাচন হচ্ছে, এগুলো আরও স্পষ্ট হওয়া দরকার। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিরস্থায়ী ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। গণতন্ত্রের জন্য নূর হোসেনদের জীবন উৎসর্গ যেন বৃথা না যায় তা দেখার দায়িত্ব আমাদের।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক গবেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক