বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মৌলবাদ দমনে সরকারকেই কঠোর হতে হবে

  • ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ   
  • ৯ নভেম্বর, ২০২১ ১৮:৩৫

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তর ঢেলে সাজাতে হবে। দেশের প্রতিটি মানুষকেও যার যার অবস্থান থেকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমেরও ভূমিকা আছে। ধর্ম-বর্ণের কুৎসিত রাজনীতির কবর রচনা করতেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। শুধু একটি লাল সবুজ পতাকা এবং একটি ভূখণ্ডের জন্য হয়নি।

“জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে

সে জাতির নাম মানুষ জাতি;

এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত

একই রবি শশী মোদের সাথী।”

‘মানুষ জাতি’ কবিতায় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মানবপ্রেমের দিকটি অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। কবি এ কবিতায় জাতি-ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের আসল পরিচয়কে অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন- বিশ্বের সব মানুষের দেহে লাল রক্তকণিকা বইছে। কালো আর সাদা কেবল বাইরের দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়। পৃথিবীতে যে যেখানেই বাস করুক না কেন, সবারই একটি পরিচয়- মানুষ। এছাড়া সব মানুষের ক্ষুধা-তৃষ্ণা, শীত-গরমের অনুভূতি এক।

চন্দ্র-সূর্য সবাইকে সমান আলো ও তাপ দেয়। জাতি বা বর্ণপ্রথা মানুষের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। তাই কবি বলেছেন, এই জাতিপ্রথা ভুলে পৃথিবীর সব মানুষকে এক জাতি হিসেবে গণ্য করতে হবে। ব্যক্তি-পরিবার, গোত্র-সমাজ ও জাতি থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি। সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভিন্ন গোত্রের মানুষের বসবাস। এছাড়া সমাজে বসবাসকারী মানুষ বিভিন্ন মতাদর্শে বিভক্ত হলেও, রাষ্ট্রীয় শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে তাদের মধ্যে কোনো বিভাজন থাকার কথা নয়।

কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ে জন্ম নিলেই কেউ সাম্প্রদায়িক হয়ে যায় না। একজন মানুষকে কোনো গোত্র বা বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো মানুষ যখন অসৎ উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিভিন্ন গোত্র-সম্প্রদায়ের মধ্যে হানাহানি, হামলা, পাল্টা হামলা এবং লুণ্ঠনের মতো অপকর্ম করে বা সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত হয়- তখনই তা সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে পরিণত হতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যা ঘটেছে তাকে সাম্প্রদায়িক হামলা বলা ঠিক হবে না। এটাকে বলা চলে পূর্বপরিকল্পিত একটি চক্রান্ত।

শারদীয় দুর্গাপূজার সময় হামলাকে বেছে নেয়ার উদ্দেশ্য হলো- ধর্মীয় ইস্যুটাকে উসকে দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা এবং সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে সরকারের ভরাডুবি এবং ভাবমূর্তি নষ্ট করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা।

“হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?

কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।”

(কান্ডারী হুঁশিয়ার/সর্বহারা)

উপরের উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় যে, জাতি-ধর্মের ভেদাভেদ বড় প্রশ্ন নয়। সব মানুষেরই সৃষ্টির উৎস এক। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রথম থেকেই কায়েমি স্বার্থবাদী মহল সহ্য করতে পারেনি। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের স্বার্থান্বেষী চক্র তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে। তার সাহিত্যে পেয়েছে সংকীর্ণতার গন্ধ। মুসলিমরা ক্ষেপেছে নজরুলের কবিতা ও গানে দেব-দেবীর নাম দেখে আর হিন্দুরা ক্ষেপেছে, যখন তিনি ‘ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে’ দিয়েছেন।

বস্তুত, বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি কামনার জন্যই তিনি কবিতায়-গানে একই সঙ্গে আল্লাহ-ঈশ্বর, মসজিদ-মন্দির-গির্জা, মোহাম্মদ-কৃষ্ণ-খালেদ-অর্জুন, কোরআন-বেদ-বাইবেল-ত্রিপিটক প্রভৃতি অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন। নজরুল ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি, বিদ্রোহ করেছেন ধর্ম-ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। একালের মতো সেকালেও ধর্মকে শোষণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই ভণ্ড মোল্লা-মৌলভি আর পুরোহিত-পাদ্রির বিরুদ্ধে সংগ্রামে তিনি সোচ্চার ছিলেন।

মানবাত্মার মুক্তি সাধনাই নজরুলের সাহিত্যকর্মের কেন্দ্রীয় অন্বিষ্ট। মানুষের সামূহিক অবচেতনায় তিনি জ্বেলে দিতে চেয়েছেন মানবিকতার আলো। ধর্মীয় কুসংস্কারকে তিনি অতিক্রম করেছেন মানবিকতার শক্তি দিয়ে। তার কাছে ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই ধর্ম।

একটি শিশুর অঙ্কুরোদগম ঘটে প্রাথমিক শিক্ষায়। আর এ শিক্ষা যদি উদার মানবতার হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে তার পথভ্রম হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। তাই উদারতার চর্চা জরুরি। এই উদারতা প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়ভাবেও। তা না হলে অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। নৈতিকতার শিক্ষা নিয়েই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া যাবে।

বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষ মুক্তচিন্তা-বিবর্জিত ধারায় আবর্তিত। নিজধর্মের মূল সারবস্তু না বুঝেই সংস্কারে আবদ্ধ হয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি করে। হিংসা-হানাহানি ঘটেই চলেছে। এ অবস্থাকে এককভাবে কোনো গোত্রীয় বা সাম্প্রদায়িক সমস্যা বলা যাবে না। তবে এ কথা বলা যায় যে, আন্তগোত্রীয় বিভিন্ন মহলের ইন্ধনে মহাজাল বা বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে। সাধারণ বিষয় থেকে শুরু করে অত্যন্ত নোংরা ও ন্যক্কারজনক ঘটনার সংঘটনে কারো কোনো দ্বিধা বা সংকোচ কাজ করছে না।

এসব অপকর্মকে আড়াল করার জন্য অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামাজিক প্রভাব, আর্থিক দাপটসহ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব পর্যন্ত কাজে লাগানো হয়। যদি দীর্ঘদিন ধরে এরকম অন্যায়-অবিচার চলতে থাকে তবে তা একসময় বিষাক্ত মহিরুহতে পরিণত হয়ে বিস্ফোরণ্মুখ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। ক্রমশ সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে উঠতে থাকবে। শুরু হবে দেশ-বিদেশে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও তোলপাড়। বাড়তে থাকবে গণমামলা ও হয়রানি।

এ মহূর্তে দেশে সব ধর্মের মানুষের জন্য ভয় ও শঙ্কামুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও যার যার ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করা সরকার এবং রাষ্ট্রের একান্ত দায়িত্ব। বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র বানাতে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের আত্মত্যাগ রয়েছে। কিন্তু ৫০ বছরেও সেই কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র পাওয়া যায়নি। এখনও ‘সংখ্যালঘু’ পরিচয়ে মানুষকে বাঁচতে হয়। এর চেয়ে দুঃখের কিছু হয় না।

প্রচুর অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেয়ে মানবিক, পরমতসহিষ্ণু, স্বদেশ ও সংস্কৃতি চেতনায় উদ্ভাসিত মানুষ তৈরি করা বেশি জরুরি। এদেশে অতীতেও নানা সময় ধর্মীয় ইস্যুকে ঘোলা জলে মাছ শিকারের মতো রাজনীতি করার মোক্ষম হাতিয়ার করা হয়েছে। এটা ততদিন হতে থাকবে যতদিন পর্যন্ত না মানুষ শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি চিন্তা-চেতনায়ও যৌক্তিক আচরণ করার মতো শুভবুদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ হবে।

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তর ঢেলে সাজাতে হবে। দেশের প্রতিটি মানুষকেও যার যার অবস্থান থেকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমেরও ভূমিকা আছে। ধর্ম-বর্ণের কুৎসিত রাজনীতির কবর রচনা করতেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। শুধু একটি লাল সবুজ পতাকা এবং একটি ভূখণ্ডের জন্য হয়নি।

এই উপমহাদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও ফায়দা আদায় করা স্বার্থান্বেষী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের চর্চিত বিষয়। বর্তমান যুগেও এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আসলে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো মাথাচাড়া দেয়ার এত সাহস ও শক্তি পেত না। যদি আগে সংঘটিত রামু, নাসিরনগর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর সুষ্ঠু বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে মূল হোতা ও সংশ্লিষ্টদের বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হতো। হয়নি বলেই এর পুনরাবৃত্তি ঘটে।

এছাড়া এদেশে পরিস্থিতি হয়েছে এমন- একটি ঘটনা সংঘটিত হবার পর আরেকটি ঘটনা ঘটলে আগের ঘটনা আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। ঘটনার তদন্ত হলেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও সুপারিশ কখনও আলোর মুখ দেখে না।

ইসলাম মানুষকে জাতি ও বর্ণ দিয়ে বিচার করে না। বিশ্বাস ও কর্মের মূল্যায়ন করে। কিছু জঘন্য মানুষ বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে সর্বনাশা খেলায় মেতে থাকে। যা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি ও ধর্মীয় উগ্রবাদের নাম করে ‘সংখ্যালঘু’ মানুষের উপর শোষণ ও নির্যাতন চালায়।

মৌলবাদী ও সুবিধাভোগী এ গোষ্ঠীর সঙ্গে কোনোক্রমেই আপস নয়। রাষ্ট্রীয় শান্তি-শৃঙ্খলা, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার স্বার্থে সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল থাকা প্রয়োজন। এর ব্যত্যয় ঘটলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। এর সঙ্গে বিসর্জন হবে সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব ও জাতীয় সংহতির। ফলে জাতি হিসেবে আমাদের আত্মাহুতি ঘটবে। বাংলাদেশ পরিণত হবে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে।

সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতাদের সামাজিকভাবে বর্জন ও প্রতিহত করে বিচারিক আদালতে সোপর্দ করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করতে হবে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘মানুষ’ কবিতার মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখা দরকার। যা একসূত্রে সমাজে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের বসবাসের জন্য অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে প্রাচীন লোক ও মরমি সাধক-কবিদের কাছ থেকে পাওয়া একটি বাণী যথেষ।ট প্রাসঙ্গিক-

“নানান বরণ গাভীরে ভাই

একই বরণ দুধ

জগৎ ভরমিয়া দেখলাম

একই মায়ের পুত।”

মানুষে মানুষে বৈষম্য আর ভেদাভেদ সৃষ্টি করা নেহায়েত মানবতার অবমাননা করা। এমনকি এটি রাষ্ট্রীয় সংবিধান অমান্য করার শামিল। সাম্প্রদায়িক কোনো হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মানসে ধর্মীয় আচার-আচরণে নাশকতা ও অনুভূতিতে আঘাত করা অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। যা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে গণ্য।

লেখক: গবেষক-কলাম লেখক। সাবেক উপমহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি।

এ বিভাগের আরো খবর