বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভাড়া বাড়ি, নাকি শাঁখের করাত?

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স   
  • ৮ নভেম্বর, ২০২১ ১৯:০৯

এলাকাভেদে ঢাকায় বাসা ভাড়ার তারতম্য হয়। বাসার আকার-আয়তন ও সুযোগ-সুবিধার চেয়ে বাসাটি কোন এলাকায় সেটি গুরুত্বপূর্ণ। একই বাসার ভাড়া মিরপুর ও ধানমন্ডিতে এক নয়। তাই বাড়ি ভাড়ার লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়ে অনেকে যে এলাকায় ভাড়া একটু কম সে এলাকায় বাসা নেয়। তাও সম্ভব না হলে পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে কোনো মেসে উঠে যায়। দৃষ্টির আড়ালে প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটছে।

নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায় বাড়ি ভাড়ার পেছনে। নাগরিকদের আয় বাড়ছে, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যয়। বরং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যয়ের পাল্লাই ভারী। জীবনযাপনের খরচ মেটাতে সমাজের একটি অংশ ক্রমাগত আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ছে। করোনাকালে ঢাকা শহরের অনেক বাড়িতে মাসের পর মাস টু-লেট ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। অনেক মানুষ বাধ্য হয়েছে গ্রামের দিকে চলে যেতে। আবার অনেক পরিবারে হয়তো কেবল কর্মজীবী সদস্যটি উপায় না পেয়ে কোনোভাবে নিজের থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত।

মূলত বাড়ি ভাড়ার চাপের কারণেই মানুষকে এসব উপায় অবলম্বন করতে হয়। করোনাকালে ভাড়াটিয়াদের এই দুরবস্থা দেখে বাড়িওয়ালা ভাড়া কমিয়েছে এমন খবর খুব কমই শোনা গেছে। কোথাও যদি কমানো হয়ে থাকে সেটা ব্যতিক্রম।

এলাকাভেদে ঢাকায় বাসা ভাড়ার তারতম্য হয়। বাসার আকার-আয়তন ও সুযোগ-সুবিধার চেয়ে বাসাটি কোন এলাকায় সেটি গুরুত্বপূর্ণ। একই বাসার ভাড়া মিরপুর ও ধানমন্ডিতে এক নয়। তাই বাড়ি ভাড়ার লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়ে অনেকে যে এলাকায় ভাড়া একটু কম সে এলাকায় বাসা নেয়। তাও সম্ভব না হলে পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে কোনো মেসে উঠে যায়। দৃষ্টির আড়ালে প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটছে।

আর মাত্র দুই মাস পর আসছে নতুন বছর। নতুন বছর সবার জন্য আনন্দের হলেও নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়াদের কাছে ভাড়া বাড়ানোর বার্তা নিয়ে আসে। ভাড়াটিয়ার আতঙ্ক- বছর শুরু মানে ভাড়া বৃদ্ধি। বাড়ির মালিক কত বাড়াতে চাইবে আর ভাড়াটিয়া কত দিতে চাইলে সে রাজি হবে এ নিয়ে মনে মনে হিসাব কষতে হয়। আবার বেশি মুলামুলি করলে মালিক বাসা ছেড়ে দিতে বলতে পারে সে আশঙ্কাও থাকে।

বাড়িওয়ালার মন জুগিয়ে চলা এক প্রকার বাধ্যতামূলক। ভাড়া বাড়ালেও এর কোনো প্রতিবাদ করা যায় না। বাড়িওয়ালার সাফ জবাব- পোষাইলে থাকেন, না পোষাইলে চলে যান। ভাড়াটিয়াদের কিছুই করার থাকে না। না পোষালেও থাকতে হয়। আয়ের ৬০-৭০ শতাংশ বাড়ি ভাড়ার পেছনে চলে গেলেও কিছুই করার নেই। অসম্ভবকে সম্ভব করাই ভাড়াটিয়ার কাজ। বাচ্চাদের স্কুল-কলেজ, নিজের কর্মস্থল এসব চিন্তা করে বাধ্য হয়েই বেশি ভাড়া গুনতে হয়।

ভাড়া বাড়ানোার পেছনে বাড়িওয়ালা কোনো জবাবদিহি দিতে বাধ্য না। এরপরও মনগড়া কিছু অজুহাত বাজারে প্রচলিত আছে। যেমন, বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, সার্ভিস চার্জ, বিদ্যুৎ-গ্যাস ও পানির বিল বেড়ে যাওয়া, লিফটের চার্জ, জেনারেটরের তেলের দাম, সিঁড়ি মোছার জন্য বুয়ার বেতন, দারোয়ানের বেতন, এলাকার পাহারাদারের খরচ ইত্যাদি বেড়ে যাওয়া। যদিও সার্ভিস চার্জ, বিদ্যুৎ-গ্যাস ও পানির বিল সাধারণত ভাড়াটিয়ারাই বহন করে থাকে। কিন্তু ভাড়া বাড়ানোর এ রকম নানা অদৃশ্য খাতের অভাব নেই।

নতুন করে বাসা ভাড়া নিতে হলে ভাড়াটিয়াদের কমপক্ষে দু্ই মাসের অগ্রিম ভাড়া গুনতে হয়। মানে, নতুন কোনো বাসায় উঠতে হলে ভাড়াটিয়াকে দুই মাসের অগ্রিম ভাড়া ও সে সঙ্গে বাসায় ওঠার ১০ দিনের মধ্যে চলতি মাসের ভাড়াও দিয়ে দিতে হয়। পাশাপাশি আছে বাসা বদলের বাড়তি খরচ। এসব বিবেচনা করে ভাড়াটিয়ারা সহসা বাসা বদল করতে চায় না।

এ দেশে ভাড়াটিয়ারা যেন প্রজা। তারা সবাই পরাধীন। বাড়ির গেটে বড় করে লেখা থাকে ‘রাত ১১ পরে গেট বন্ধ’। অনেক চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ীদের ৯ থেকে ৫টা অফিস থাকে না। অনেক পেশা ও ব্যবসাতেই বাড়তি সময় দিতে হয়। রাত ৯টা বা ১০টা পর্যন্ত অনেককেই কাজের জন্য বাইরে থাকতে হয়। আর ঢাকার ট্রাফিক ঠেলে বাসায় ফিরতেও সময় লেগে যায়। বাড়ি ফেরার সময় টেনশন করতে হয়, যদি ১১টার বেশি বাজে তবে দারোয়ানের কথা শুনতে হবে। মাসে দু-একবারের বেশি এমন দেরি হলে বাড়িওয়ালা নিজেও দুকথা শুনিয়ে যাবে। আর ভাড়াটিয়া পরিবারের কোনো নারী সদস্য যদি রাত করে বাড়ি ফেরে, তবে তো তাকে নিয়ে রীতিমতো কানাঘুষা শুরু হয়। বাসা ছাড়ার নোটিশ চলে আসতে পারে যেকোনো সময়।

ভাড়াটিয়াদের আরও নানা শর্ত মেনে বাড়িতে থাকতে হয়। যেমন- বাড়ির ছাদে ওঠা যাবে না, বাসায় বেশি মেহমান আসা যাবে না, এলেও বেশি দিন থাকা যাবে না, পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়া যাবে না ইত্যাদি। এ ছাড়া ভাড়া দিতে ২/১ দিন দেরি হলে কথা শোনানো, ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া না দেয়া- এ রকম আরও নানা শর্ত ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে ভাড়াটিয়াদের বাসায় থাকতে হয়।

অনেক মালিক ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে সহসা কোনো কথাও বলে না। দারোয়ানের মাধ্যমে সব যোগাযোগ করে। বাড়ি ভাড়া নেয়া থেকে শুরু করে বাড়ি ছাড়া পর্যন্ত সব কাজই দারোয়ানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। সব মিলিয়ে ভাড়াটিয়ারা যেন এই শহর ও দেশের তৃতীয় শ্রেণির প্রজা। তাদের সঙ্গে শুধু যে প্রজাসুলভ আচরণই করা হয় তা নয়, গত চার-পাঁচ বছর ধরে শুরু হয়েছে আরেক নতুন বিড়ম্বনা। ‘ভাড়াটিয়ার তথ্য দিন’ নামে নতুন এক প্রচারণার ফাঁদে বর্তমানে ভাড়াটিয়া মানেই যেন অপরাধী। জঙ্গি দমনের নামে সংশ্লিষ্ট থানা থেকে রাজধানীর সব ভাড়াটিয়ার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ভালো উদ্যোগ সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধু ভাড়াটিয়ার তথ্য কেন?

প্রচারণাটি হওয়া প্রয়োজন ছিল সব এলাকাবাসীর তথ্য সংগ্রহের জন্য। সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদে শুধু কি ভাড়াটিয়ারাই জড়িত হয়? বাড়ির মালিক বা তার পরিবারের লোকজন জড়িত হয় না, এ ধরনের অনুমানের ভিত্তি কী? এটি কি রাষ্ট্রের একটি বিশেষ শ্রেণিকে হেয়প্রতিপন্ন করার শামিল নয়? তাই শুধু ভাড়াটিয়ার তথ্য চাওয়ার পরিবর্তে এলাকার সব বাসিন্দার তথ্য সংগ্রহের প্রচারণা শুরু করা প্রয়োজন। তবে সব বাড়িওয়ালাই যে একরকম তা নয়। ভাড়াটিয়াদের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেক বাড়িওয়ালাও আছে।

আপাতদৃষ্টিতে বাড়িওয়ালার শর্ত মেনে যদি ভাড়াটিয়া থাকতে পারে তো থাকবে, না হলে জোরপূর্বক উচ্ছেদ এমনকি বিনা নোটিশে তৎক্ষণাৎ বাড়ি ছাড়ার হুমকিও দেয়া হয়। ভাড়াটিয়ারা উদ্বাস্তু। আজ এখানে, কাল ওখানে। বাড়িওয়ালারা স্থানীয়, তাই তারা প্রভাবশালী। এ ছাড়া তাদের আছে সমিতি বা সোসাইটি। ভাড়াটিয়াদের ওপর প্রভাব বিস্তার করা কোনো ব্যাপারই নয়।

বাড়িওয়ালাদের নানা রকম সিন্ডিকেটও থাকে। তারা স্থানীয় হওয়ায় পরস্পর পরিচিত। কোনো ভাড়াটিয়ার সঙ্গে বনিবনা না হলে এক মালিক তার সম্পর্কে অন্য মালিকের কাছে অভিযোগ করে। ফলে, ওই ভাড়াটিয়া ওই এলাকার অন্য বাড়িতেও থাকতে পারে না। বাড়িওয়ালারা ওই ভাড়াটিয়াকে নিজেদের বাড়িতে উঠাতে চায় না। কী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, কার দোষ- সেসব বিবেচনা করা হয় না।

দেশে বাড়ি ভাড়াবিষয়ক আইন আছে। আইন কার্যকর করতে হাইকোর্টের আদেশও আছে। সে আদেশে কয়েক দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কে এসব মানছে? নিউজবাংলার মতামত বিভাগে গত ৪ নভেম্বর প্রাবন্ধিক চিররঞ্জন সরকার তার ‘পণ্যের লাগামছাড়া দাম ও বাসা ভাড়ার চাপে পিষ্ট নাগরিক’ শিরোনামের প্রবন্ধে বাড়ি ভাড়াবিষয়ক আইন ও ভাড়াটিয়াদের অধিকার নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন (https://www.newsbangla24.com/column/165086/The-unbridled-price-of-the-productCitizens-crushed-under-the-pressure-of-renting-a-house)

কাজেই আইনগত বিষয়গুলোর আর পুনরাবৃত্তি না করে শুধু এটুকুই বলা প্রয়োজন যে, আইন থাকলেই হবে না। আইনের প্রয়োগ চাই। এ বিষয়ে ভাড়াটিয়াদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। সাম্য ও ন্যায্যতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার সম্পর্ক।

লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর